২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বাজেট ২০২৪-২৫

গতানুগতিক ও বিনিয়োগ বিমুখ

গতানুগতিক ও বিনিয়োগ বিমুখ - নয়া দিগন্ত

সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে উচ্চমূল্যের বাজার থেকে তারা স্বস্তি পাবে। ব্যবসায়ীরা মনে করে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে, বেসরকারি খাতে উৎপাদন বাড়বে। মধ্যবিত্তরা আশা করে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়াতে হবে না। সবার আশা কি ঘোষিত বাজেটে পূরণ হবে?

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট দিলেন তাতে আশার কথা শুনিয়েছেন। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলছেন। যদিও বিগত দু’টি বাজেটে নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও তা ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার। আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষিত হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমে সাত কোটি ১৪ লাখ ৪১৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। চলতি বছরের তুলনায় ঘোষিত বাজেটের আকার আমি মনে করি বাস্তবসম্মত। তবে আকার না বাড়লেও ব্যয় কিন্তু কমেনি। বর্তমানে অর্থনীতি যে চাপের মুখে রয়েছে, যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে অবস্থান করছে তাতে ঘোষিত বাজেটে উদ্ভাবনী ও সাহসী পদক্ষেপ দরকার ছিল। বাজেট হয়েছে একেবারে গতানুগতিক ও বিনিয়োগ বিমুখ। টার্গেট হয়েছে উচ্চাভিলাষী।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হয়নি। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করলেও তা আনা সম্ভব হবে না। বাজেটের বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.৫ শতাংশ। কিন্তু শেষে এখন বলা হচ্ছে তা ৫.৮ শতাংশ হতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৭৫ শতাংশ। তা কিভাবে অর্জিত হবে বোধগম্য নয়। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো ইতিবাচক এবং বেশ কিছু পণ্যের শুল্কহার হ্রাসও ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে বাজারে যেন তার প্রভাব পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ নির্ধারণ কিছুটা কর ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারে। করপোরেট করও আড়াই শতাংশ কমানো হলো। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা করপোরেট কর কমানোর দাবি করে আসছিলেন। এক ব্যক্তির কোম্পানির করপোরেট কর শর্তসাপেক্ষে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। তবে শেয়ারবাজার নিয়ে তেমন কোনো কিছুই দেখা যায়নি।

কালো টাকা
কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা নিয়ে মিডিয়াসহ বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। সিপিডি বলছে, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদার সুযোগ আওয়ামী লীগের ইশতেহারের পরিপন্থী। সরকার ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত ও কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দিয়েছে তা দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলানোর মতো। বৈধ আয় হলে কর দিতে হবে ৩০ শতাংশ আর অবৈধ আয় হলে কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ। যা রীতিমতো অর্থপাচারকারীদের ও অবৈধ সম্পদ উপার্জনকারীদের আরো উৎসাহিত করবে। দেশে সর্বোচ্চ কালো টাকা সাদা হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তখন কোভিড অতিমারী ছিল। অর্থ পাচারের জায়গা ছিল না। তাই বিশেষ কোনো পরিস্থিতি ছাড়া কালো টাকা সাদা হয় না। এ ধরনের সুযোগ প্রদান করা দুঃখজনক ও অনৈতিক। বাজেটে এ ধরনের সুযোগ রাখলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম আরো বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান
চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছিল জিডিপির ২৮ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিদায়ী অর্থবছরে আসলে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২৩.৫১ শতাংশ যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের থেকেও কম। যার প্রভাব দেখা দিয়েছে জিডিপিতে। লক্ষ্য ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ অর্জনের হার বলা হচ্ছে ৫.৮২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা আবার ধরা হয়েছে ২৭.৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৯ শতাংশ, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ১০ শতাংশ। ঋণ কমিয়ে জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি কিভাবে হবে তা পরিষ্কার নয়। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে এডিপির আকার দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। সামগ্রিক দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশেজ উৎপাদন বা জিডিপির ঘাটতি ৪.৬ শতাংশ। ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার আশা করছেন বাকি এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। যার মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এমনিতেই ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট ও খেলাপি ঋণের পাহাড়। তার ওপর ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে গরমিল
সরকারের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে কমে ৬ শতাংশের একটু বেশি রাখা হয়েছে অথচ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে পৌনে ৭ শতাংশ। বিনিয়োগ কমিয়ে অর্জন করা দুরূহ। পরিকল্পনা বাস্তবতার মধ্যে দূরত্ব অনেক। এসব কারণে প্রতি বছর বাজেট বাস্তবায়নে দেখা দেয় অনেক ঘাটতি।

সঙ্কট কাটাতে অন্যের উপর
নিজের পরিকল্পনা না করে বৈশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে অনুমাননির্ভর বাজেট তৈরি করলে তা কতটা বাস্তবসম্মত হবে তা সহজেই অনুমেয়। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। নতুন বাজেটের মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বাজেটে ঋণ পরিশোধ বাবদ বেশি টাকা বরাদ্দ রাখার কারণে সরকারের অনেক অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, উচ্চমূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর সীমা বাড়ানোর আশা অনেকেই করেছে। সাধারণ করদাতারা আশা করেছিল করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা হলেও বাড়ানো হবে। ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে নতুন কর স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা খাতেও এবার বরাদ্দ ১২ শতাংশ পার হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরের জন্য বাজেটের প্রায় ১১.৫৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। দীর্ঘ দিনের দাবি শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের। তা এবারো পূরণ হলো না। যদিও টাকার অঙ্কে চলমান বাজেটের চেয়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের ১১.৪ শতাংশ। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে এই বাজেট যথেষ্ট নয়। স্বাস্থ্য খাত এবারো গুরুত্ব পেলো না। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের ৪.৯৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় এটি ০.২ শতাংশ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে বললেও এবারো তা উপেক্ষিত। তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে জনগণের কাছে সঠিক সেবা পৌঁছে না। দক্ষ কর্মক্ষম ও সুস্থ জাতিগঠনে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন জরুরি। নাহলে জাতি হিসেবে আমরা দুর্বলই থেকে যাবো।

প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকনির্দেশনা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, স্বভাবতই তাতে লাগাতার মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, কাগজে-কলমে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই; বরং অর্থমন্ত্রী আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বাজেটে অর্থ সংগ্রহের দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। ফলে বহু নিত্যপণ্য ও সেবার ওপর করারোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়বে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা নামমাত্র বাড়িয়ে আশা করা হয়েছে, এর ফলে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। অথচ বাস্তবতা হলো, গত কয়েক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে; বরং করজালের সম্প্রসারণে মধ্যবিত্তের দুর্ভোগ আরো বাড়বে।

বস্তুত প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই। ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি মেনে নেয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, বাজেটে ভ্যাট ও শুল্ক-কর খাতে এমন অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যয় আরো বাড়বে। এদিকে মেট্রোরেলের টিকিটের দাম নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ঠিকই বসানো হচ্ছে। ইন্টারনেটসেবা ও মোবাইলফোনের কলরেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তও মধ্যবিত্তবান্ধবের জন্য কষ্টকর হবে।

বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে রফতানি খাত। রফতানির উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং নগদ প্রণোদনার ওপর উৎসে কর হ্রাসের দাবি আমলে নেয়া হয়নি। উপরন্তু কাঁচামাল আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে, যার ফলে চাপে পড়তে পারে এ খাত।

দেশে বাজেট ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। এটি কাটিয়ে ওঠা জরুরি। বাজেটের যথার্থ বাস্তবায়নে বরাদ্দের অর্থ সঠিক সময়ে খাতগুলোতে পৌঁছাতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহারে প্রতিটি খাতে বাড়াতে হবে দক্ষতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা। রোধ করতে হবে অপচয়। সংসদে বাজেট নিয়ে অর্থবহ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সংসদের বাইরে বিশেষজ্ঞরাও তাদের মতামত দেবেন। বাজেটে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুক এটি সবার প্রত্যাশা।

ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement