বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৮ জুন ২০২৪, ০৫:৩৯
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুঘল ও নবাবী আমলের শেষ পরিণতি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। যেহেতু মুঘল ও নবাবী আমলের শাসনব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। তাই ওই সময় উপমহাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব না থাকাই ছিল তখনকার বাস্তবতা। রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ১৮৮৫ সালে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজ-উদদৌলাকে পরাজিত করে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বীজ রোপণ করার পর ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার সুযোগ ব্রিটিশ শাসকরা দেননি।
এই সময়ের মধ্যে ব্রিটিশরা তাদের শাসনক্ষমতা উপমহাদেশের জনগণের উপর পুরো মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। অবশ্য হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে যখন ব্রিটিশ রাজের উপর চাপ সৃষ্টি করে; তখন কৌশলগত কারণে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ রাজের ইচ্ছাতে ইংরেজ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের পরামর্শে এবং তার উদ্যোগে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা। যাতে করে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জনগণ তাদের দাবি-দাওয়ার কথা বলতে পারে। অবশ্য অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনে আরেকটি সূক্ষ্ম কৌশল ব্রিটিশ রাজ লুকিয়ে রেখেছিল। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষের দাবি-দাওয়া ব্রিটিশ রাজের সামনে তুলে ধরার কথা থাকলেও কার্যত হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থসিদ্ধি নিয়ে বেশি কাজ করে। ব্রিটিশরাও হিন্দুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখেছিল। যার কারণে শিক্ষা-দীক্ষায়, সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের থেকে হিন্দুরা অনেক এগিয়ে যায়। ফলে অধিকার বঞ্চনার জায়গা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণ হিন্দুদের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ জন্ম নেয়। হিন্দু-মুসলিমের এ ক্ষোভ থেকে ভারতের জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদে ব্যস্ত রেখে ব্রিটিশরা ১৯০ বছর শাসন করে ভারতীয় উপমহাদেশ।
অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে ১৯০৬ সালে মুসলমানরাও আলাদা রাজনৈতিক দল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে দেখা গেল অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের উদ্যোগে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওই একই কারণে। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের সুযোগে সাধারণ জনগণও রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে এবং তারা রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তো বটেই ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের ইস্যু ঘিরে। পরবর্তীতে দলটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত পুরো আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণও ছিল জনগণের অধিকারগুলো সামনে হাজির করার কারণে। তবে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজেরা আলাদা দল গঠন করেন। যেমন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ বা ন্যাপ গঠন করেন। এমনকি ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় ‘বাকশাল’।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল গঠিত হয় সেগুলোর মধ্যে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’-বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ সামনে রেখে।
আমরা যদি রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো ‘বিএনপি’ শুধু কিছু অধিকার বা দাবি-দাওয়া আদায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি; বরং বিএনপি গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শন সামনে রেখে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে। যার মূলমন্ত্র ছিল জনগণ হবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক। এ কারণে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত হরে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন।
আদর্শহীন রাজনীতি সবসময় ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়, যা জনগণের দীর্ঘমেয়াদে উপকারে আসে না। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থসিদ্ধি হাসিল হলো ক্ষমতায় যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য। গণতান্ত্রিক এবং আদর্শিক রাজনৈতিক দলগুলোর স্পৃহা থাকে জনগণের মতামত নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে জনকল্যাণে কাজ করা, অপর দিকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মতামতে বিশ^াস করে না। যার কারণে তারা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা প্রয়োগ করে গদি টিকিয়ে রাখতে চায়।
দেশে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামল ছিল স্বৈরশাসনের আবরণে মোড়া। ‘জাতীয় পার্টি’-নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেও এখানে আদর্শের বালাই ছিল না। দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছিল মূল উদ্দেশ্য। গণ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গণতন্ত্রের ছোঁয়া লেগেছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের পর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দীনের শাসনামলে দুই বছরে রাষ্ট্র থেকে গণতন্ত্র মুছে ফেলার পথ তৈরি করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এখন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
আজকের বাস্তবতা হলো- আদর্শহীন রাজনৈতিক চর্চা সমাজের মধ্যে হত্যা, গুম, রাহাজানি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক চেষ্টা, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা, আইনের শাসনের পরিবর্তে হুকুমের শাসন কায়েম করা, রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় লোক অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া, জবাবহীনতার সংস্কৃতি চালু করা ইত্যাদি নানা বিচ্যুতি সমাজটিকে কলুষিত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সমাজিক অস্থিরতা বেড়েছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল একসময় (জাসদ, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, যারা সর্বহারা নামে পরিচিত) যারা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিল তারা সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন থেকে সরে গিয়ে সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। এসব দলের অনেক নেতা সাম্য কায়েমের পরিবর্তে নিজেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন, ফলে তাদের জনপ্রিয়তা আঁতুর ঘরে মরা পড়ে।
শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল দেশের ক্ষমতায় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হতে হয় নির্ভীক, সাহসী ও ধৈর্যশীল। বিশেষ করে নেতাকে হতে হয় গতিশীল, দূরদর্শী, সমসাময়িক সব সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন এবং চরম সঙ্কট মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। কর্মীদের মধ্যে হতাশা আসতে পারে; কিন্তু তা দূর করে তাদের আন্দোলনে উজ্জীবিত করতে সঠিক বয়ান তৈরি করা একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের কাজ। আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে, সফল হওয়ার জন্য কখনো দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বছরের পর বছরও লেগে যেতে পারে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে। হয়তো এ সময়ের মধ্যে অনেক রক্ত দিতে হতে পারে, জীবন দিতে হতে পারে তবে এটি নিশ্চিত, টিকে থাকলে বিজয় নিশ্চিত।
আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল হওয়ায় গুম-খুন, জেল-জুলুম, নির্যাতন হজম করে ‘বিএনপি’ জনপ্রিয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। ১৭ বছরের ভয়াবহ নির্যাতনের পরও নেতাকর্মীদের দলত্যাগের হিড়িক পড়েনি; বরং প্রতি মুহূর্তে কর্মীসংখ্যা বাড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে- আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দমন করা খুব কঠিন। আদর্শ ধারণ করায় ‘বিএনপি’ জনপ্রিয়তা নিয়ে টিকে আছে। এই একটি মাত্র কারণে এই দলটি সামনের দিনেও টিকে থাকবে, এ কথা সহজে বলা যায়।
অন্য দিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের জুলুম, নির্যাতন এবং গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থা দুর্বল করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নাগরিক অধিকার হরণ করে বর্তমান শাসক দল যেভাবে দেশ চালাচ্ছে , তাতে দীর্ঘমেয়াদে কোনো অবস্থাতে দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা