২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
স্মরণ

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ : বিস্মৃত এক শিক্ষানুরাগী

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ - ফাইল ছবি

ঢাকার নবাব আব্দুল গণির পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করার পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ৩০ বছর বয়সী সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। এই তরুণ নবাব যথার্থই উপলব্ধি করেন যে, বাংলার পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি করতে না পারলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসবে না। তিনি মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে মনোযোগী হন।

তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতিরেকে তাদের নৈতিকতার ভিত্তি রচিত হবে না। এ জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য মাদরাসায় নিয়মিত আর্থিক অনুদান পাঠাতেন। (উল্লেখ্য, ইংরেজ শাসনে মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত কমবেশি ৮০ হাজার মাদরাসা অনুদানের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিরাগ আর চরম দারিদ্র্যের কারণে মুসলমানরা মূলত একটি শিক্ষাশূন্য জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এক হিসাব মতে জানা যায়, তখন প্রতি ১০ হাজার মুসলমানের মধ্যে শিক্ষিত ছিল মাত্র ২২ জন আর হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১১৪ জন)।

তৎকালীন সময়ে বাংলার ৯৫ শতাংশ হতদরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলমানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করাটাই ছিল দুষ্কর। হিন্দু জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত ও হিন্দু শিক্ষক কর্তৃক পরিচালিত স্কুলে মুসলিম ছাত্র ভর্তি করা হতো না। এ জন্য বাংলার মুসলমানদের বাধ্য হয়েই মাদরাসা শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। নবাব সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরাম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, পণ্ডিত আবুল হাশিম, খাজা নাজিমুদ্দিন, শাহ্ আজিজুর রহমান প্রমুখ রাজনীতিবিদ ছিলেন মাদরাসার ছাত্র। নবাব সলিমুল্লাহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি ছিল তার সজাগ দৃষ্টি। কংগ্রেস নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ১৯১১ সালে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করেন। ১৯১২ সালের ৩ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের পঞ্চম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে দূরদর্শী নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর কংগ্রেস নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলের উত্থাপিত বিলটির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে তা কার্যকর করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

পতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টেনে উপরে তোলার লক্ষ্যে তিনি গণশিক্ষা প্রচলনে ব্রতী হন। নবাব হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নবাবের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা এবং তাদের উন্নত ও সম্মানিত কওমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। শিক্ষা খাতে দান অব্যাহত রাখতে হিন্দু মহাজনের কাছে নিজের জমিদারি বন্ধক রেখে অর্থ নিয়েছেন এবং অবশিষ্ট জমিদারি গচ্ছিত রেখে ব্রিটিশ সরকার থেকে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা কর্জ করেছেন যা তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আর পরিশোধ করতে পারেননি।

নবাব সলিমুল্লাহর পরামর্শ মতে সীমানা বর্ধিত করে ভাইসরয় কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেন। ঢাকাকে রাজধানী করে তিনি ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠন করেন। নতুন প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের কলকাতার প্রজা শোষক হিন্দু জমিদাররা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে নিজেদের জমিদারি রক্ষার স্বার্থে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।
মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু ও বিত্তশালী হিন্দু জমিদারদের মোকাবেলা করে বঙ্গভঙ্গ রক্ষা করা যায়নি। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে নবাব সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। বঙ্গভঙ্গ রহিত করার কারণে সদ্য বিলুপ্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা নবাব সলিমুল্লাহর ক্ষোভ এবং অসন্তুষ্টি প্রশমিত করার উদ্দেশে তার দেয়া প্রস্তাব মতে, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে ব্রিটিশ সরকার সম্মত হয়। সেই সাথে নবাবের দেয়া মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের দাবিও মেনে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদয় জমি দান করেন নবাব সলিমুল্লাহ। নবাবের দান করা জমির উপরে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত।

বাংলার পশ্চাৎপদ, শোষিত ও নিরক্ষর মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা, ভারতীয় মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ গঠন ও পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুরের (১৮৭১-১৯১৫) জীবনের অনন্য সাধারণ কীর্তি ও অবিস্মরণীয় অবদান। আজ ৭ জুন ২০২৪ এই স্বেচ্ছাসেবী মহান নবাবের ১৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে তার অসামান্য অবদান ও অমলিন ত্যাগকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। করুণাময় আল্লাহ তার মানবকল্যাণে ইতিবাচক কর্মময় জীবনের বিনিময়ে তার রূহকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।

লেখক : স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য,
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল