প্রতিহিংসার রাজনীতি কার স্বার্থে
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২৩ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৪৭
রাজনীতির প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এখানে বিভাজন থাকবে, পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। একেক দল বা পক্ষ একেক নীতি-আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য নিজেদের নীতি-কৌশলকে জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং বৃহত্তর জনগণকে নিজেদের পক্ষে টেনে আনার চেষ্টা করে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা যারা তাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে তাদের অত্যাচার করার কারণ ছিল, তাদের শাসনশক্তিকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের শাসনকার্যে কেউ যাতে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, তা দমন করা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন বিরোধী শক্তির ওপর ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলের নির্যাতন, নিপীড়ন বহাল থাকল? আমরা তো এগুলোর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এত আন্দোলন, সংগ্রাম করেছি। রক্ত দিয়েছি। ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। রাজনীতির নামে কেন মানুষ হত্যা করতে হবে? তাহলে এই রাজনীতি কার স্বার্থে? শুধু ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করার জন্যই কি রাজনীতি? এ প্রশ্নগুলো আজ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজনীতির অঙ্গনে ভেসে আসছে।
অতিসম্প্রতি ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ : বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠান হয়। চিত্র প্রদর্শনীতে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের ও যারা আহত হয়েছেন তাদেরকে হাজির করে তাদের কাছ থেকে হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনা হয়েছে। সেই কাহিনী শুনে প্রধানমন্ত্রী কেঁদেছেন। জনগণের কাছ থেকে সহানুভূতি নেয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন। বিদেশী কূটনীতিকরাও সেখানে ছিলেন। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে- বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল। প্রধানমন্ত্রীর কান্না দেখে হয়তো আরো অনেকে কেঁদেছেন। অনেক মানুষের মনে আবার অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। সেটি হচ্ছে- অন্যান্য সময়ে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, যাদের হত্যা করা হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাদের সবাইকে বা তাদের আত্মীয়স্বজনদের তিনি কেন আনেননি?
১৯৯৬ সালে আন্দোলনের নামে গান পাউডার দিয়ে যে ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের পরিবারের লোকজনকে কেন আনা হয়নি? কেন আনা হয়নি দিন-দুপুরে হাজার হাজার মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা বিশ্বজিতের পরিবারের কাউকে? কেন আনা হয়নি ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরারের পরিবারের কাউকে? কেন ডেকে আনা হয়নি বর্তমান সরকারের সময়ে গুম, খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের? এ প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেঁদেছেন। আমরাও কাঁদতাম। কারণ, রাজনীতি তো সহিংসতার জন্য নয়। মানুষ হত্যা, গুম, খুনের জন্য নয়। রাজনীতি মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
এখন বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক আন্দোলনে যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের এবং যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের লোকজনকে ডেকে এনে তাদের লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ যে কাউকেই আবেগতাড়িত করতে পারে; কিন্তু কেউ কি জিজ্ঞাসা করেছে, যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত এত বছর পার হলেও তাদের বিচার হয়নি কেন? বিচার হয়নি; হয়তো হবেও না। কারণ, অভিযোগ আছে- ছাত্রলীগ, যুবলীগ এমনকি আওয়ামী লীগের লোকজন গাড়িতে আগুন দিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করে দায় দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে। প্রকৃতপক্ষে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার ভয়ে সরকার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে এর বিচার করতে চাইছে না।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই দেশে একটি সংবিধান ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচন সেই সংবিধানের আলোকে করতে চায়নি। তারা সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল, অফিস যাত্রীদের দিগম্বর করা, গান পাউডার দিয়ে বাসে অগ্নিসংযোগ করা, অবরোধ দিয়ে পোর্ট অচল করে দিয়ে ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে জনতার মঞ্চ তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগের ভাষায় সেটিই আন্দোলন ছিল। আজকে একই দাবিতে বিএনপি বা রাজপথের বিরোধী দল আন্দোলন করলে সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে? বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করেছিল। আওয়ামী লীগ কেন তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিলো? এখন বিএনপির দাবিই বা কেন মেনে নিচ্ছে না?
২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ৩০ সেপ্টেম্বর-২০২২ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর এর আগের ৯ মাসে ৩৮৭টি রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও সহিংসতার ঘটনায় ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪০০ জনের মতো। স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক নানা কারণে ৬৪ জেলার প্রায় সব ক’টিতে এ সময় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই নির্বাচনগুলোতে বিএনপি বা জামায়াতের কোনো প্রার্থী অংশগ্রহণ করেননি। আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এই চিত্র কিন্তু ওই প্রদর্শনীতে ওঠে আসেনি। আসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও রহস্যজনক নিখোঁজ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে হয়রানি, সীমান্তে নির্যাতন, হত্যাসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এই ভুক্তভোগী পরিবারের কাউকে আমরা ওই প্রদর্শনীতে দেখতে পাইনি।
২০১৩ সালে আসক প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন দুই হাজার ২৩৪ জন। ওই সময়ের রিপোর্টে দেখানো হয়, দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ (১৯৯১-২০১৩) বছরে প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজার ৫১৯ জন মানুষ। আর একই সময়ে কমবেশি আহত হয়েছেন দেড় লাখ মানুষ। যে মানুষগুলো মারা গেলেন কিংবা যে লক্ষাধিক মানুষ আহত হলেন, কে তাদের দায়িত্ব নিয়েছে? অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচনী সহিংসতা ও দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কোনো সভ্য সমাজে এটি চলতে পারে না। রাজনীতির এই সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে।
বিএনপি বিভাগীয় শান্তিপূর্ণ সমাবেশে লাখ লাখ লোক আসছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে জনস্রোত ঠেকানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু জনগণ কোনোকিছুকেই তোয়াক্কা করছে না। চিঁড়া-মুড়ি সাথে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে, বাইসাইকেলে, মোটর বাইকে, তিন চার দিন আগে থেকে সমাবেশস্থলে এসে হাজির হচ্ছে। পুলিশ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পথে পথে নানারকম হয়রানি করেও জনগণকে সমাবেশ বিমুখ করতে পারছে না। এর অর্থ হচ্ছে জনগণ সরকারের শাসনে তুষ্ট নয়। তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু সরকার জনগণের এই মেসেজকে বুঝতে চাইছে না; বরং সমাবেশের জন উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। বিএনপির সমাবেশ দমনের চেষ্টা আওয়ামী লীগকে কেন করতে হবে? আওয়ামী লীগের সক্ষমতা থাকলে তারা পাল্টা সমাবেশ ডেকে প্রমাণ করুক, জনগণ তাদের সাথে আছে। সেই জায়গায় ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ এখন প্রতিহিংসার পথ বেছে নিচ্ছে। প্রশ্ন হলো- এই প্রতিহিংসার রাজনীতি কার স্বার্থে?
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা