৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভুলে যাওয়া অতীতের নিরিখে

ভুলে যাওয়া অতীতের নিরিখে - ছবি : সংগৃহীত

গত ১১ অক্টোবর নয়া দিগন্তে ইকতেদার আহমেদের ‘ধর্ম যার যার, নাকি তার তার’ শিরোনামে প্রকাশিত কলামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ষাটের দশকে (১৯৫৭-৫৮ খ্রি:) স্কুলে সরস্বতী পূজায় স্বেচ্ছায় দিয়েছি চাঁদা। স্রেফ অজ্ঞতার কৈশোরে সহপাঠী হিন্দু বন্ধুদের সাথে এর পূজায়ও দিয়েছি আরতি (প্রদীপাদি দ্বারা দেবমূর্তি বরণ)। কিন্তু কিছু স্বধর্মীয় ছাত্রদের সবার পক্ষে অন্তত আট আনা করেও চাঁদা দেয়ার অক্ষমতায় ‘হুজুর’কে স্কুলে নামমাত্র ফাতেহা ইয়াজদহম অনুষ্ঠান করায় বুঝতে পারি ধর্মীয় বিভাজন- সাধারণ নয় যদিও এক স্যার ক্লাসে আমাদের মাঝেমধ্যে বলতেন, তার স্বধর্মীয়দের জলফইকে পানিফই এবং পানিকচুকে জলকচু বলতে। ভারতীয় দেবভাষা সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন হিন্দি ভাষায় বাংলাভাষা বেশ প্রভাবিত। এতে অনুপ্রবেশিত আরবি, ফারসি ও উর্দুর বহু শব্দ শুধু বাঙালি মুসলমানেরই ব্যবহারে ভাষাটির পবিত্রতা নষ্টের অভিযোগ ও তীব্র সমালোচনা ছিল প্রায় শতাব্দীকাল। হিন্দির সাথে একই দেবভাষা থেকে উর্দুরও উৎপত্তি। কিন্তু এটা আরবি ও ফারসি প্রভাবিত ইসলামী রূপায়িত হওয়ায় ১৮৬৭ সালে সর্বপ্রথমে ‘হিন্দু মেলা’কে (হিন্দু নবজাগরণ) কেন্দ্র করে হিন্দি ব্যতীত উর্দুর প্রকাশনা বন্ধের দাবিতে বেনারসে আন্দোলন করা হয়। পরিণামে উত্থিত দ্বিজাতি তত্তে¡র মুসলিম জাতীয়তাবাদী আলাদা সত্তার জাগরণে বাংলাসহ ভারত ভাগ হলো। পরবর্তীকালে ধর্মীয় জাতীয়তার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবার ভাষাগত জাতীয়তাবাদী জাগরণের বিচ্ছিন্নতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। তা সত্তে¡ও এই পূর্বাপর দ্বিজাতি সত্তার যখন যেটার প্রয়োজন, আমরা প্রকারান্তরে সেটারই পরিচয় দিয়ে আসছি।

৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত বলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দাবিদার কারো কাছেই সেকালে আমার বিধর্মী কার্যকলাপে সমর্থিত ছিল না, আজো হওয়ার নয়। পক্ষান্তরে ভাষাগতদের অনেকের কাছে এটা আজ অসাম্প্রদায়িকতার নজির ছাড়াও অতীতের উদাহরণে অসমর্থিত হওয়ার নয়। ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’, পৃ-১৩৭ মতে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি:) সর্বপ্রথম হিন্দু-মুসলমান ধর্মের মিলনাত্মক সত্যপীরের পূজা প্রচলিত হয়। ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, খণ্ড-৩, প-১, পৃ-১১৯ মতে, ‘শেখ ফয়জুল্লা সত্যপীরের বন্দনায় হিন্দু দেবদেবী এবং চৈতন্য দেবের বন্দনা করিয়াছেন। তিনি আল্লাহ ও ব্রহ্মা-বিষ্ণুকে এক করিয়া বলিয়াছেন, তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি নারায়ণ।’ সত্যপীর কাহিনীর অন্যতম কবি, কৃষ্ণহরিদাস লিখিয়াছেন, ‘সত্যপীর বলে, যদি তুমি মোর মুরশিদ। আমাকে বাঁচাও তুমি করিয়া মুরিদ।’ শ্রী সুকুমার সেনের ‘ইসলামী বাংলা সাহিত্য’ পৃ-৮০ মতে, ‘মক্কার রহিমকে অযোধ্যার রাম বলে স্বীকার করে বহু হিন্দু কবি সত্য নারায়ণ বা সত্যপীর পাঁচালী লিখেছেন।’ বইটির ৯৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির বিরোধ মিলনের এক ইতিহাস রয়ে গেছে দক্ষিণা রায় (হিন্দুর ব্যাঘ্র দেবতা) এবং বড় মা গাজীর (মুসলমানের ব্যাঘ্র দেবতা) গল্পের মধ্যে।’ পূর্বোল্লিখিত ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘বৌদ্ধ সহজিয়া মতের মূলতত্ত¡ ও দর্শন হলো, প্রত্যেক পুরুষ কৃষ্ণ এবং প্রত্যেক নারী রাধা। এই সহজিয়ারই শাখাস্বরূপ আবির্ভূত বাউলদের গুরু হলেন : হাউরে গোঁসাই, শিলাইদহের গোঁসাই গোপাল, নিতাই ক্ষ্যাপা, নবদ্বীপ দাস, শ্রমতি হরিদাস, নেহাল শাহ, বেহাল শাহ, গহর শাহ, আব্বাস শাহ এবং পাঞ্জা শাহ।’ বইটির ৬৮ পৃষ্ঠা মতে, ‘মুসলিম ফকির আউল চাঁদের প্রবর্তিত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি ঘটে দুলাল চাঁদের সময়।’ সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাংলা অভিধান, পৃ-৭০৬-এ বলা হয়েছে, ‘রামশরণ পাল এটা প্রতিষ্ঠা করেন নদীয়ায়।’ অভিধানটির ৮৮২ পৃষ্ঠা মতে সেখানে মেহেরপুরে জন্ম নেয়া বলরাম ভজার বিস্তৃতি ঘটে নদীয়া, পাবনা ও বর্ধমান অঞ্চলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রাক্তন প্রফেসর ড. রফিউদ্দিন আহমদের The Bengal Muslims, 1871-1906, P-22, 199's N-146-এ বলা হয়েছে, রাজশাহীর ন্যাড়া ফকির সম্প্রদায় নিজের প্রস্রাব পান করার তদ্রুপ অদ্ভুত ও নিকৃষ্ট কাজ করে ময়মনসিংহের পাগলা পন্থীরা।

বইটির ৫৪ পৃষ্ঠায় ঢাকা জিলার স্কুল ইন্সপেকটরের প্রতিবেদনে মানিকগঞ্জের ফরাজিদের অর্ধেক হিন্দু বলা এবং মুসলমানদের হোলি, দিওয়ালী, দ্বিতীয়া, ভাইফোঁটা, লক্ষ্মীবারে (বৃহস্পতিবার) কোনো ঋণ গ্রহণ বা না দেয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। বইটির ৬৮ পৃষ্ঠায় ATAVISTIC, অর্থাৎ কয়েক প্রজন্ম পরে কোনো প্রাণীর বা ব্যক্তির চরিত্রে পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্যের পুনঃপ্রকাশ, নিয়ে বলা হয়েছে, ‘শুভ বা অশুভের ইঙ্গিত এবং শুভ দিনের বিশ্বাস পূর্বের মতোই প্রচলিত থাকে, যখন মুসলমানেরা গ্রাম্য দেবতাকে আনুগত্যের দান প্রদান করত ধান বীজ রোপণের পূর্বে এবং প্রায়ই অসুস্থতার জন্য ভ‚ত ঝাড়ার মন্ত্রের আশ্রয় নিত। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও অনেকেই ছিল হিন্দু দেবী দুর্গার ভক্ত। একজন মুসলমান লেখক দাবি করেছেন যে, পাবনার সিরাজগঞ্জে অনেক মুসলমান দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ এবং প্রতিবেশী হিন্দুদের মতো নতুন জামাকাপড় ক্রয় করার কথা। এসব তথ্য বিহারীলাল সরকারের ‘তিতুমীর’, কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’ এবং ১৮৭৬ সালে লন্ডনে প্রথম প্রকাশিত বরিশালের ভ‚তপূর্ব জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর H. BEVERIDGE-Gi THE DISTRICT OF BAKERGANJ বইগুলোয় সমর্থিত। বেভারেজ তার বইটির ২২৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত ড. টয়লরের কথায়, ‘ঢাকা ও বাখরগঞ্জে নৌকার মাঝিরা পূজা করে ‘বছর’ নামক এক নৌ-দেবতার, যিনি একজন মুসলমান পীর এবং চট্টগ্রামে তার সমাধিস্থ হওয়ার কথা বলা হয়।’

পূর্বোল্লিখিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, খ-৩, প-১, পৃ-৭৮৫-এ উদ্ধৃত মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘হারামনি’ নামক বাউল গানের সংগ্রহ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্মরণীয় উক্তিটি, ‘এ দেশের অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধর্মগত জাতিতে মুসলমান।’ এই অপ্রিয় সত্যের নিরিখে আজ কেউ যদি ‘ধর্ম যার যার, অনুষ্ঠান সকলের’ বলে ধারণা পোষণ করেন, তবে অবশ্যই তা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ চেতনাধারীদের জন্য নয়।


আরো সংবাদ



premium cement