৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

৭ নভেম্বর : দেশপ্রেমের চেতনায় পরিপূর্ণ বিপ্লব

৭ নভেম্বর : দেশপ্রেমের চেতনায় পরিপূর্ণ বিপ্লব - ছবি : সংগৃহীত

৭ নভেম্বর আমাদের জীবনে একটি গভীর তাৎপর্য সম্পন্ন দিন। সময়ের প্রয়োজনে এ দিন দেশের আপামর জনসাধারণ ও সিপাহি এক হয়ে একটি রক্তপাতহীন বিপ্লবের জন্ম দেয়। দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণাই জন্ম দিয়েছিল পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের এ বিপ্লব। একটি জাতির জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন ইতিহাস তার অনিবার্য নিয়মেই পালা বদল করে, রূপান্তর ঘটায় তার জীর্ণ, মরচেধরা অবয়বের, জন্ম দেয় নতুন ইতিহাসের। এ নতুন প্রভাতের অভ্যুদয়ের প্রত্যাশায় তাকে অপেক্ষা করতে হয় একটি যুগসন্ধিক্ষণের জন্য, সেই মুহূর্তটি যখন এসে যায়, আপনা থেকেই ইতিহাস আপন শক্তির পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে সব বিপরীত স্রোতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ৭ নভেম্বর এ দেশে তাই ঘটেছিল। সিপাহি জনতার এই দেশপ্রেমিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ঐক্য ও সংহতি ছিল যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মূল শক্তি, তেমনি সেই একই সংহতির পুনরুত্থান ঘটে ৭ নভেম্বরে। এই পুনরুত্থান অনিবার্য, অত্যাবশ্যকীয় ছিল এ কারণে যে, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবী সংগ্রাম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কালো মেঘমুক্ত করেছিল।

এটি শুধু মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা নয়, এটি এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অভ্যুদয়ের সূচনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা পরবর্তী সেনা-অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানে দেশে যখন চরম নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তখন সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দেশ ও জাতিকে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। অভূতপূর্ব সেই বিপ্লব-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাময়িক বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ঢাকার রাজপথে সেদিন সৈনিকদের সাথে একাকার হয়ে সাধারণ মানুষ বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন আধিপত্যবাদী অপশক্তি ও তাদের দেশীয় চরদের বিরুদ্ধে।

পরবর্তীকালে দিনটিকে মানুষ উৎসবের আবহে পালন করে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে মূল্যায়ন করতে শুরু করে। যদিও রাজনৈতিক কারণে মহলবিশেষ এটিকে বাদ দিতে চায় এ দেশের ইতিহাস থেকে। কেউ বা এটিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করতে তৎপর। কিন্তু ইতিহাস তার স্বাভাবিক নিয়মেই একটা পর্যায়ে সবকিছুর নিরপেক্ষ ও যথাযথ মূল্যায়ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটে চলেছে।

৭ নভেম্বরের ফলে আমাদের হাজার বছরের লড়াকু চেতনা নতুন এবং স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমাদের জাতীয় পরিচয় সুনির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে ৭ নভেম্বর এক বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নির্ধারণ করেছে নভেম্বর বিপ্লব। এই স্বাতন্ত্র্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পরিমণ্ডলেই লক্ষণীয়। সমগ্র জাতিকে এক যুগান্তকারী পথনির্দেশনা দিয়েছে এ বিপ্লব।

৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতি ভাষাগত জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি পেয়ে দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে, যা এক নতুন রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্ম দেয়। ৭ নভেম্বরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে চলে আসা সামরিক বাহিনী ও জনতার মধ্যকার দূরত্ব অনেকাংশে কমে আসে। এ দুইয়ের মধ্যে এমন এক সংহতি এনে দেয়, যা দেশ গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

এ বিপ্লবে কে নেতৃত্ব দেয় এবং কার পতন ঘটে সেটা বড় ছিল না। সমগ্র জাতি এর ফলে এক হতে পেরেছিল, আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব সংহত ও অর্থবহ করে তুলতে হাতে হাত রেখে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল- এটা এক অনন্য অর্জন ছিল। কিন্তু আমাদের যে সংহতি ও ঐক্য আসা উচিত ছিল এখন মনে হচ্ছে তা আসেনি। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে বিভক্ত করার লক্ষ্যে মহলবিশেষ নতুনভাবে পুরনো ইস্যুগুলোকে জীবন্ত করছে। শান্তির বদলে হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানির সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, কিন্তু সংহতি দিবসের চেতনার কথা বলি না। এটি দুর্ভাগ্যজনক, কেননা একটি অপরটির পরিপূরক।

স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকচক্রের ব্যর্থতার পর ব্যর্থতায় দেশ বহির্বিশ্বে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিল। উপরন্তু মহল বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনা ও ঈমান আকিদাবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী নিশানা মুছে ফেলতে শুরু করে, এমনকি প্রতিষ্ঠানের ইসলামী নামকরণ পর্যন্ত বাদ দেয়া হতে থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক মর্মন্তুদ ও শোকাবহ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন সাধিত হয়। বাকশালী বিভীষিকায় জনগণ এতটাই অতিষ্ঠ ছিল যে জনগণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার পরিবর্তনকেও সমর্থন করেছিল। আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়। এ ঘটনার পর থেকে দেশ এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হতে থাকে। জাতীয় জীবনের সেই যুগ সন্ধিক্ষণে অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন বিপন্ন অবস্থায় উপনীত হয় ঠিক এমনি মুহূর্তে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতি দিবসের মাধ্যমে এ দেশের আকাশের কালো মেঘটি কেটে যায়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ সঠিকভাবেই নির্ধারিত হয়ে যায়।

আজ ৪৭ বছর পরও ৭ নভেম্বর আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এ মহান বিপ্লবের চেতনা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার রক্ষাকবচ, আমাদের প্রেরণার উৎস। এ বিপ্লব হয়েছিল দেশ বাঁচাতে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত করতে সর্বোপরি দেশের জনগণকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় পরিচয় সুনির্ধারিত হয়েছে। এ দেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর এসেছিল। এটা ব্যর্থ হলে জাতির এক হওয়ার এ বিপ্লবই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ বিপ্লব ও সংহতি দিবস কোনো দল বা ব্যক্তির একার কৃতিত্বে ফসল নয়, যেমন ছিল না একাত্তরের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ। অতএব, বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর এ দিনটাকে অবহেলা করার কোনো যুক্তি নেই। আমাদের জাতিসত্তার ভিক্তিমূল এখনো নড়বড়ে। কেউ বলে আমরা বাঙালি কেউ বলে বাংলাদেশী। আসলে এ দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা আমরা দুটোই এবং এর একটা আরেকটার পরিপূরক।

বলা বাহুল্য, উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান যে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী রাজনীতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে সে পরিস্থিতিতে ভূ-রাজনৈতিক কারণেই ভারতের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর বারবার তাদের আধিপত্যবাদী থাবা বিস্তার করতে চায়। উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতির এ সত্য যারা চোখে দেখেও না দেখার ভান করেন, তারা প্রকৃতই জেগে ঘুমায় এবং তারা বাস্তবিক পক্ষেই আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের সেবায় নিয়োজিত। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, যারা ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকে অস্বীকার করে তারা আধিপত্যবাদের সেবাদাস। তবে বাংলাদেশের জনগণ প্রতি ৭ নভেম্বর নতুন করে স্বাধীনতা রক্ষার শপথ গ্রহণ করে থাকেন। জাতীয় প্রয়োজনেই নতুন প্রজন্মকে ৭ নভেম্বরের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর এবং
সদস্যসচিব, শত নাগরিক, রাজশাহী

ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement