৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বৈষম্যহীন সমাজ ও চিকিৎসা সেবা

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন - ছবি : লেখক

অধিকার
রাষ্ট্র ও সমাজের স্বীকৃত সুযোগ-সুবিধা যা মানুষের প্রাপ্য সেটাই অধিকার। যেমন, পরিবার গঠন, ভোট দান ইত্যাদি।

অধিকার হলো এমন কিছু সুযোগ সুবিধার সমষ্টি যা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত, সমাজ ও স্ব স্ব ধর্ম কর্তৃক স্বীকৃত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের সর্বজনীন মৌলিক অধিকার।

অধিকারকে আমরা দুই ভাবে চিন্তা করতে পারি। একটি হলো নৈতিক অধিকার যা মানুষের বিবেকবোধ থেকে আসে। অন্যটি আইনগত অধিকার।

যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারের কথা দেশের সংবিধানে উল্লেখ থাকে এবং সরকার কর্তৃক অলঙ্ঘনীয় তাই-ই মৌলিক অধিকার। আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের বিশেষ মর্যাদা বা সম্পদের ওপর নির্ভরশীল নয়। এক কথায় মানবাধিকার হলো জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত এমন কতগুলো অধিকার যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে ভোগ করা যায়।

গরিব কাকে বলে
যার টাকা পয়সা নাই, নিঃস্ব অসহায় সাধারণভাবে তাকেই আমরা গরিব বলি। ইসলামে গরিব হলো সেই ব্যক্তি যার নেসাব পরিমাণ (ক্রমবর্ধমান ও ক্রমবর্ধমান নয়) মাল নেই।

যোগ্যতা থাকার পরেও চেষ্টা-তদবির না করা বা যোগ্যতার যথাযথ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হবার কারণে গরিব হওয়ার উদাহরণ নেহায়েত কম নয়। তবে ধনীদের দ্বারা শোষিত হওয়া বা গরিবের প্রাপ্য হক আদায় না করার কারণে গরিব হবার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

কেন গরিব-ধনীর এই সৃষ্টি
সমাজে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ভিন্নধর্মী সুযোগ সুবিধা নিয়ে জন্মায়। ফলে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার পর প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকেই সমাজে ধনী গরিবের সৃষ্টি হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, ‘যে সমাজে বাস করে না সে হয়তো পশু, নয়তো দেবতা।’ সমাজে বসবাস করতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

আল্লাহ দুনিয়াতে জীবনোপকরণ সর্বত্র এবং সব মানুষের মাঝেই ছড়িয়ে দিয়েছেন কিন্তু কাউকেই পূর্ণাঙ্গ করে দেননি। সহায় সম্বল, জ্ঞান-বুদ্ধি-মেধা এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন যাতে প্রত্যেক মানুষ এবং প্রত্যেক রাষ্ট্র একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকে। আর এসব করা হয়েছে মূলত দু’টি কারণে। একটি হলো যাতে মানুষ একজন আরেকজনের কথা শোনে এবং মানে। অন্যটি হলো, পরীক্ষা করার জন্য। মর্যাদা এবং সম্পদে একজনের থেকে আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্বও মূলত পরীক্ষা করার জন্যই।

সুবিধাবঞ্চিত মানেই মর্যাদাহীন নয়
পৃথিবীর মানুষের বিচারে মানুষ মর্যাদাশালী হয় মূলত দুই ভাবে। প্রথমত, যদি কোনো ব্যক্তি মর্যাদাশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত, মানুষ নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখে, অর্থ উপার্জন করে বা ভালো কাজ করে যে মর্যাদা অর্জন করে।

গরিব মানে মর্যাদাহীন নয়। আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার ভিত্তি হলো কেবল মাত্র আমল। সৎ কর্মের ওপর ভিত্তি করে যে সমাজে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয়, সে সমাজে সামাজিক বৈষম্য থাকে না।

কেন সামাজিক বৈষম্য দূর করা জরুরি
প্রকৃতিতে গরিব বলে কিছু নেই। আকাশে উড়ে বেড়ানো পক্ষিকূল, গভীর সমুদ্রের মাছ কিংবা গহিন বনের পশুদের কেউই গরিব নয়। জগতের কোনো শিশুই গরিব বা ধনী হিসেবে জন্মায় না। বরং পৃথিবীতে এসে বাবা-মায়ের কারণে কেউ গরিব আবার কেউ ধনী।

প্রকৃতির কোথাও কোনো দুর্ভিক্ষ আর গরিব নেই। দুর্ভিক্ষ আর গরিব শুধু মানবসমাজে। এ জন্য দুর্ভিক্ষ যেমন মানব সৃষ্ট, তেমনি গরিব কিংবা ধনীও মানবসৃষ্ট সঙ্কট।

মানব সমাজে বিভিন্ন কারণে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানুষ অধিক মুনাফার লোভে অতিরিক্ত খাদ্য ও সম্পদ সঞ্চয় করে। পৃথিবী থেকে বিদায়ের মুহূর্তে খালি হাতে বিদায় হলেও মানুষ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যায় অঢেল সম্পদ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ সারা জীবনে যা আয় করে তার খুব সামান্যই ভোগ করে, বেশির ভাগ আয়ের অংশই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যায়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস বলে রেখে যাওয়া সম্পদ অপচয়, অবৈধ দখল এবং অবৈধ ব্যবহারের ফলে মানবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাস এটাও বলে যে, যেসব সম্পদ মানুষের কল্যাণে দান করা হয় তার বেশির ভাগই মানবতার কল্যাণে কাজে লাগে।

মানুষের মধ্যে আয়ের বৈষম্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য থাকা উচিত নয়।

সব মানুষের যোগ্যতা, প্রতিভা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা একরকম থাকে না। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের প্রতিভা শুধু ধনীক শ্রেণী কিংবা সুবিধাভোগীদের মধ্যে আবর্তিত হয় না। বরং প্রতিভা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পৃথিবীর সর্বত্র ধনী-গরিব সবার মধ্যেই দেখা যায়।

মনে রাখতে হবে, প্রতিভার জন্ম হয়, তৈরি হয় না। তবে তার স্ফুরণ ঘটানোর সুযোগ করে না দিলে অথবা কেউ ইচ্ছাকৃত বা অবহেলা করে তার জন্য চেষ্টা যত্ন না করলে প্রতিভার মৃত্যু হবে।

বিশ্বে যেহেতু সুবিধাবঞ্চিতদের সংখ্যাই বেশি, সেহেতু এদের প্রতি যত্নবান না হলে সমাজে যোগ্য লোকেরও অভাব হবে। আবার, সামাজিক বৈষম্য দূর না হলে সুবিধাবঞ্চিতরা রাষ্ট্র বা সমাজের সর্বোচ্চ পদে আরোহণ করতে পারবে না। সুতরাং সমাজের সব মানুষের স্বার্থেই সামাজিক বৈষম্য দূর করা জরুরি।

বিশ্বের ধনী ও কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে আয় বৈষম্য থাকলেও সামাজিক বৈষম্য নেই। এই কারণে সেসব দেশের দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার সুযোগ পান। অর্থাৎ সামাজিক বৈষম্য দূর করার মূল দায়িত্ব সরকারের। তারপরেই দায় হলো সামর্থ্য অনুসারে সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের।

সামাজিক বৈষম্য না থাকলে দরিদ্রদের ধনী হবারও প্রয়োজন নেই। আবার সামাজিক বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সবাই ধনী হয়েও সুখী সমাজ গড়তে পারবে না। কারণ সমাজের সব ধনীই তখন সম্পদ গড়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। সামাজিক বৈষম্য থাকলে কোনো দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নতিও সম্ভব নয়।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে উৎপাদিত গমের ১৮ দশমিক ২ শতাংশ অপচয় হয়। আর মাছের অপচয় হয় ১২ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত। ধানের ক্ষেত্রে অপচয় হয় ১২ শতাংশ। আর সর্বাধিক ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত সবজি ও ফল নষ্ট হয়। অপচয় না হলে এই খাদ্য দিয়ে দেশের বাড়তি এক কোটিরও বেশি মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব বলে অভিমত কৃষি বিজ্ঞানীদের।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৯২ কোটি ৫০ লাখ। অথচ প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়।

সমাজে সুবিধাভোগীরাই বেশি সুবিধা পায়
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা করতে গিয়ে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ গরিব হয়ে যায়। আর সেটা যদি হয় জটিল কোনো রোগ তা হলে তো কথাই নেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপ বলছে, স্বাস্থ্য খাতের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ধনীরা এগিয়ে। বিশেষ করে শিশুস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্যসুবিধা ও তথ্য জানার প্রবণতা ধনীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার হার বেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেশি। পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে তারা এসব তথ্য জেনে থাকে।

গুচ্ছ জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশের মাত্র ৪৬ শতাংশ মায়েদের শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার দু’টি লক্ষণ, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথার মধ্যে একটি সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। যাদের মধ্যে সাড়ে ৪৯ শতাংশই ধনী পরিবারের সদস্য। আর বাকি ৪৪ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের। হিসেবে দেখা যাচ্ছে ধনী গরিবের ব্যবধান গরিব দেশগুলোতেই বেশি। যেমন নাইজেরিয়া বর্তমানে এই ব্যবধানে শীর্ষে।

ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। তথ্যটি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের। সংস্থাটি বলছে, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। অথচ দেশে গরিবের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। সুতরাং গরিব হওয়া না হওয়া অনেকটাই মানব সৃষ্ট।

ডায়রিয়া হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ৭৯ শতাংশই খাবার স্যালাইন বা বাসায় বানানো এমন তরল ওষুধ খায়। সেখানে ধনী পরিবারের প্রায় ৮১ শতাংশ শিশু এবং দরিদ্র পরিবারের ৭৭ শতাংশ শিশু এ পথ্য পায়। অন্যদিকে ধনী পরিবারের প্রতি এক হাজারে ২৯ নবজাতকের মৃত্যু হয়। যেখানে দরিদ্র পরিবারে এ সংখ্যা ৫৯। আর পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু হয় ধনী পরিবারে প্রতি হাজারে ৩৫, দরিদ্র পরিবারে ৭৯ জন।

চিকিৎসা নিয়ে বছরে গরিব হচ্ছে ১০ কোটি মানুষ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ অর্থাৎ ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের পরিবারের বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ৫৫ ভাগ মানুষ এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এরা কেউই নিবন্ধিত চিকিৎসকের সেবা পান না। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই এই ৫৫ শতাংশ মানুষের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তা গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। ফলে প্রতি বছর ৫ শতাংশ মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অর্জন নেহায়েত কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭১ দশমিক ৮ বছর। এটা ২০০০ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৫ বছর। শিশুদের টিকাদানের অর্জন ৯৪ শতাংশ। মাতৃমৃত্যুর হার এখন প্রতি লাখে ১৭৬ জন, যা ২০০০ সালে ছিল ৩৯৯ জন। প্রতি ১০০০ জনে নবজাতকের মৃত্যু ২০০০ সালে ছিল ৪২ দশমিক ৬, যা ২০১৫ সালে কমে ২৩ দশমিক ৩-এ দাঁড়িয়েছে।

২০০০ সালে পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৮৮ জন, যা ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৬।

লেখক: স্বাস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement