৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা

-

সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ অনেকদিন আগে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সারা দেশ, যা মরণব্যাধি ক্যান্সারের রূপ নিয়েছে। এ রোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে নিজ উদ্যোগে প্রতিষেধক নিতে হবে। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আধুনিক প্রতিষ্ঠিত দেশ রেখে যাওয়া সম্ভব হবে না।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ জুলাই ২০০৭)

দেশের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ‘সেবা’ শব্দটিই যেন মুছে গেছে, সেখানে যুক্ত হয়েছে সেবার নামে ব্যবসায়।

২০০৭ থেকে ২০২২ কতটুকু মুক্ত হয়েছি আমরা? চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অসহায় মানুষের বেকারত্বকে পুঁজি করেও কেউ কেউ ব্যবসায় করছে। নিজের জীবন থেকে নেয়া দু’টি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ২০০৭ সালের ঘটনা। নিজে চাকরি করে স্বামী-সন্তান নিয়ে আরো একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য গিয়েছিলাম একটি বায়িং হাউজে সুপারভাইজার হিসেবে জয়েন করার জন্য। এই তথ্যটি পেয়েছিলাম একটি পাবলিক বাস থেকে। ঠিকানাটা বেশ যত্ন করে খাতায় তুলে আনলাম। সেই সময়ে এই কাজের জন্য বেতন নির্ধারণ ছিল ১৬ হাজার টাকা। ভাবলাম আমি যদি আলাদা ১৬ হাজার টাকা রোজগার করে স্বামীর হাতে তুলে দিতে পারি তবে সে খুশিই হবে।

বাসায় না বলেই গেলাম সেখানে। বাসা থেকে বেশি দূরে ছিল না। মালিবাগ রেললাইনের পাশেই চারতলা অফিস। নিচে বড় করে কোম্পানির নাম দেয়া ছিল ‘তুরান কোম্পানি’। শুরু থেকেই কিছুটা খটকা লাগছিল এই ভেবে, মানুষ চাকরি পায় না আর এরা চাকরি নিয়ে বসে থাকে?

গিয়ে দেখি বিশাল বড় অফিস, এসি করা রুম। আমার মতো এমন অনেক বেকার পাবলিক অপেক্ষা করছে চাকরির জন্য। নারী-পুরুষসহ প্রায় ২০-২৫ জন। তখন ভয় কিছুটা কমে এলো। হয়তো ঠিক জায়গাতেই এসেছি।

যাই হোক, ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর আমার ডাক পড়ল। ভেতরে গিয়ে দেখি দু’জন মেয়ে একজন ছেলে অফিসার ভাইবা নেয়ার জন্য বসে আছেন। দেখতে বেশ সুন্দর ও পরিপাটি। সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ব্যবহারও তিন জনেরই অমায়িক ছিল।

তাদের প্রশ্ন ছিল, নাম?
আমার নাম নাসরিন সুলতানা।
আপনি এইচএসসি পাস করেছেন ২০০০ সালে, রাইট?
জি ম্যাম।
চাকরি করতে এসেছেন কেন?

ম্যাম ঢাকা শহরে সন্তান নিয়ে চলতে বেশ কষ্ট হয়। একজনের ইনকামে সচ্ছন্দে চলা যায় না, তাই এখানে আসা।
ওকে আপনি ২০৫ নাম্বার রুমে চার হাজার টাকা জমা করে আপনার নিয়োগপত্র নিয়ে যান।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাম আমি তো তেমন কিছু জানি না, পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই, কিসের কাজ করব সেটিও জানি না।

-কোনো সমস্যা নেই, আমাদের এখানে ট্রেনিংয়ের লোক আছে, সব শিখিয়ে দেবে। আপনি আসুন। আগামী সপ্তাহে জয়েন করবেন। কবে জয়েন করবেন কাগজে তারিখ লেখা আছে।

আসসালামু আলাইকুম, দোয়া করবেন ম্যাম।

রুমের বাইরে এসে ভাবলাম, এবার হয়তো কোনো জালে আটকে যাচ্ছি। তেমন কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু নাম ঠিকানা আর কিসে পড়াশোনা করেছি এতেই কি ভাইবা শেষ হয়ে চাকরি হয়ে গেল?

রুমের বাইরে এসে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম কী করব? চার হাজার টাকা জমা করব নাকি চলে আসব? যেখানে অপেক্ষা করছিলাম সেখানেও অফিসের একজন গোয়েন্দা পিছু নিয়েছে যেন এখান থেকে সহজে বের হতে না পারি। অন্য সবাই চার হাজার টাকা জমা করে একটি কাগজ নিয়ে বাসায় ফিরছে মহা খুশিতে।
আমি ভাবছি এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা।

কিন্তু বের হবো কি করে?

হঠাৎ মাথায় এলো আমার দু’বছরের ছোট ছেলের কথা।

সেখানে গোয়েন্দা লোকটাকে বললাম, ভাইয়া আমার দুই বছরের ছেলে বাসায় প্রচুর কান্না করছিল তাই তার বাবা নিচে নিয়ে এসেছে। দুধ খাওয়াতে হবে। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি এখানে। তারপর টাকাটা দিচ্ছি। নিচে থেকে আসতে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। যাব আর আসব।

লোকটি বলল, ঠিক আছে যান তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। ওনারা জানতে পারলে কিন্তু আমার চাকরিটা যাবে।

ঠিক আছে ভাই, কোনো সমস্যা নেই। আপনি এদের দেখেন আমি আসছি এখনই। বলেই তড়িঘড়ি করে চলে আসি নিচে। রিকশা ভাড়া যেখানে ২০ টাকা সেখানে লোকটাকে বললাম রামপুরা যাবো ৩০ টাকা নিয়েন তাড়াতাড়ি চলেন।

মুহূর্তেই বাসার উদ্দেশে রওনা হই এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। হে আল্লাহ; আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছ।

পরের ঘটনাটি সাম্প্রতিক। আমার রেস্টুরেন্ট জালালস কিচেন মোল্লা টাওয়ার রামপুরায়। প্রায়ই সেখানে আমার ডিউটি করতে হয়। বরাবরের মতোই ডিউটিতে থাকা অবস্থায় কাজের ফাঁকে হঠাৎ চোখ পড়ল দারোয়ানের দিকে।

ছেলেটা নীরবে কাঁদছে। কান্না দেখে একটু এগিয়ে গেলাম।
-কিরে রবিন কি হয়েছে তোর?
-কিছু না ম্যাডাম!
-তবে কাঁদছিস কেন?
-ম্যাডাম আজকে তিন মাস হলো এখানে চাকরি নিছি, এখনো বেতন পাই নাই। মা’য় ফোন দিতাছে শোধে ১০ হাজার টাকা নিছি চাকরির জন্য এখনো পাঠাইতে পারি নাই।

ম্যাডাম ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়া চাকরিটা নিছিলাম। যার কাছ থেকে টাকাটা নিছিলাম তাকে বলছি দুই মাসেই পরিশোধ করে দেবো। কিন্তু এখনো বেতনই পাইলাম না। এর মধ্যে ঢাকায় থাকা খাওয়ার জন্য আরো ১০ হাজার টাকা খরচ হইছে। এখন ২০ হাজার টাকা জোগাড় করব কিভাবে?

মালিক এখনো টাকা দেয় নাই। এর মধ্যে কইতাছে তোর কাম বালা না। চাকরি ছাইড়া চইলা যা।
জিজ্ঞেস করলাম, তোর কোম্পানির নাম কি? বলল তুরান।

দারোয়ানের কথা শুনে চমকে উঠলাম। ভাবছিলাম, তবে কি সেই চক্র এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে? হবে হয়তো। এদিকে ১০ হাজার টাকাও নিলো আবার বেতনবিহীন তিন মাস কাজও করিয়ে নিলো।

বর্তমানে ঢাকার আনাচে-কানাচে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা চাকরি দেয়ার নাম করে এসি রুমে বসে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। একেক জনের সাথে একেকভাবে প্রতারণার নতুন নতুন ফাঁদ তৈরি করছে। এর কোনো তদারকি করার মতো লোক নেই। যারা প্রশাসনে আছেন তাদের নজর দেয়ার কথা অথচ তারাই কোম্পানি থেকে কমিশন নিয়ে চুপচাপ ঘুমায়। তাদের নাকের ডগায় এসব কাজে প্রতিনিয়ত হরদম বিজনেস চলছে।

প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ জনের কাছে টাকা নিতে পারলে এক লাখ টাকা রোজগার। মাসে ৩০ লাখ টাকা। অফিস, পিয়নসহ অন্যসব কর্মচারীর বেতন দিয়েও অনেক টাকা আয় হয়। কোনো খাটুনি ছাড়াই তাদের পকেট ভরছে। কি হবে সাধারণ মানুষের?

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ম-মধ্যবিত্তদের এমনিতেই নাজেহাল অবস্থা তার ওপর এমন বাড়তি চাপ, সত্যিই মেনে নেয়া কষ্টকর।

২০২২ সালে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যা সাত কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে। তবে ২০২১ সালের (সাত কোটি ৫০ লাখ) চেয়ে তা কিছুটা কম । তবে ২০১৯ সালে প্রাক-মহামারী সময়ের চেয়ে তরুণ বেকারের সংখ্যা এখনো ৬০ লাখ বেশি।

২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নারী-পুরুষের মোট শিক্ষার হার ৭১.৬৬ শতাংশ। প্রতি বছর এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন কোনো কাজের প্রতিষ্ঠান বাড়ছে না; বরং কমছে। তবে তারা কোথায় যাবে? নিজের একজনের খাবার রোজগার করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে হলে এমন তুরানের মতো নানা জায়গায় ধোঁকা খেতে হয়।

সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ২০০৭ থেকে ২০২২ বাড়ছে বেকার, বাড়ছে বেকারদের নিয়ে চাকরি চাকরি খেলা। বাধ্য হয়ে মানুষ গ্রামমুখী হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে গিয়ে পড়ছে রাজনীতির অনৈতিক বেড়াজালে। মানুষ তার নৈতিকতা ধরে রাখতে পারছে না। সীমা লঙ্ঘনের ওপর ভিত্তি করে চলে যাচ্ছে বিপথে। গ্রামে দিন দিন বাড়ছে নেশা, জুয়ার আড্ডা। বাড়ছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি।

সব কিছু মিলিয়ে বিদ্ঘুটে অবস্থা বিরাজমান। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তরুণদেরকে তরুণ হিসেবে সাব্যস্ত করা কঠিন হয়ে যাবে। ঝরে যাবে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ অবস্থায়। বিফলে যাবে না সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের কথাও।

লেখক: সমাজকর্মী ও সাহিত্য সংগঠক


আরো সংবাদ



premium cement