৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

- ছবি : সংগৃহীত

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খাবারের মতোই অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ওষুধ। প্রায় সবার ঘরে কিছু না কিছু ওষুধ পাওয়া যায়, এমনকি একজন ভিক্ষুকের ঘরেও। ওষুধ কোনো ভোগবিলাসী দ্রব্য নয়; বরং সুস্থ থাকার জন্য জীবনের একটি অনুষঙ্গ। অসুস্থ হলেই কেবল আমরা ওষুধ সেবন করি। শখের বসে কেউ ওষুধ সেবন করি না। কিছু মানুষ টাকার জন্য ওষুধ ক্রয় করতে পারে না;আবার কিছু মানুষ বেশি টাকা পাওয়ার নেশায় ওষুধ বিক্রি করে না। কেউ ওষুধ বিক্রি করে দালান তৈরি করে। আবার কেউ ওষুধ ক্রয় করার ক্ষমতা না থাকায় যন্ত্রণায় মরে। তারপরও দমকা হাওয়ার মতো ওষুধের দাম বাড়ে। চালের দাম, ডালের দাম, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাড়ে, তার সাথে যদি ওষুধের দামও বাড়ে, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে,কী করবে? নিম্নবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম। মধ্যবিত্ত পরিবারের যেখানে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সেখানে ওষুধের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরবে। তবে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনব্যয় পোষাতে না পারায় বাধ্য হয়ে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।

চিকিৎসাসেবা পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বেও সবার ভাগ্যে এই সেবা জুটছে না। তার অনেক কারণ আছে। সেদিকে আমি যাচ্ছি না। ভাববার বিষয় হচ্ছে- আমাদের চিকিৎসাব্যয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। ওষুধের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ছে। সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ফলে বাড়তি খরচের বোঝা জনগণের কাঁধেই পড়ল, এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া! চাল, ডাল, লবণ কিংবা তেল না হলেও দিন পার করা যায়; কিন্তু ওষুধ না হলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়। এ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। ওষুধের দাম বৃদ্ধি করা অন্যায় কিছু নয়। তবে রয়ে সয়ে দাম বাড়ালে মানুষ একটু স্বস্তি পেত। যে প্রোডাক্টগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর উৎপাদনখরচ বিক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক কম থাকায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ওষুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ- ওষুধ কোম্পানিগুলোর উচ্চাভিলাষী বিপণননীতি। অথচ ওষুধ প্রমোশনে খরচ না করলে কোম্পানিগুলো ওষুধ বিক্রি করতে পারে না। এ বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট মহলের ভেবে দেখা প্রয়োজন। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ওষুধ নীতিমালাকে আরো জনবান্ধব করতে পারে।

আমাদের চিকিৎসাসেবা কতটুকু উন্নত তা করোনাকালীন সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখনো করোনা শেষ হয়ে যায়নি। এমতাবস্থায় জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করা মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এক লাফে দ্বিগুণ বাড়ায় জনগণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে, সাধারণ মানুষের পক্ষে ওষুধ ক্রয় করে রোগ সারানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে লাগামহীনভাবে দাম বাড়তে থাকলে মানুষ কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়বে। চিকিৎসার পরিবর্তে অপচিকিৎসার চাষাবাদ শুরু হবে। ওষুধ নিয়ে বাণিজ্যের শেষ নেই। যেমন- ওষুধের গায়ে দাম লেখা থাকে না, ওষুধের মেয়াদ স্পষ্ট করে লেখা থাকে না, নকল ও ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য কমছে না, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। ওষুধের সঙ্কট হলেই দোকানদার ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে চোখ ওঠার ওষুধ সব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও চড়া দাম দিয়ে কিনতে হয়। সব ব্যবসায়ী অসৎ তা আমি বলছি না; কিন্তু অসৎ ব্যবসায়ীর কারণে পুরো ওষুধ বাণিজ্যের ওপর কালিমা লেপন হচ্ছে।

দেশের প্রায় দেড় হাজার জেনেরিকের (শ্রেণীগত বা জাতীয়) ২৭ হাজারের বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি হয়। সরকার ১১৭টি ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করলেও বাকি সব নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল; কিন্তু এবার প্রায় সাত বছর পর আবারো বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম ৫০ থেকে শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম ৭০ টাকা করা হয়েছে। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম বাড়িয়ে ১৮ টাকা করা হয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে প্যারাসিটামল, রক্তচাপ, হৃদরোগ, ব্যথানাশক ও গ্যাসের সমস্যার নিয়মিত ওষুধগুলোর দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ কিছু ওষুধের দাম দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। অথচ দেশে এমন বহু রোগী আছে, যাদের মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ওইসব রোগী কীভাবে ওষুধের ব্যয় মেটাবে? এ ব্যাপারে সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকা অনুসারে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বড় করতে পারে। এমনকি মূল্য নিয়ন্ত্রণে নজরদারি বাড়াতে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশে সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয়; কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের চেয়ে কোম্পানিগুলো বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে। অথচ এ নিয়ম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিপন্থী। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিমালা অনুসারে সরকারই দাম নির্ধারণ করত। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম নিজেরা নির্ধারণ করে এবং বাকি ৮৩ শতাংশ ওষুধের দাম কোম্পানির ওপর ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য হচ্ছে- কাঁচামাল, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, ভ্যাটসহ নানা কারণেই ওষুধ উৎপাদনব্যয় বেড়েছে। কিন্তু ওষুধ তো অন্য দশটি পণ্যের মতো নয়। ওষুধের বাড়তি দাম জনগণের ওপরে আরো চাপ বাড়াবে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বেসরকারি মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। দামের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। সরকার অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেন অতিরিক্ত দামে কেউ ওষুধ বিক্রি করতে না পারে। তা ছাড়া সরকার নিজেই ওষুধ উৎপাদন করে অল্প দামে জনসাধারণের কাছে সরবরাহ করতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন করলে ওষুধের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের মধ্যে রাখা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল