৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস

আজ পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া ও জনগণ প্রচণ্ডভাবে মার্কিনবিরোধী হয়ে পড়েছে। - ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার আকস্মিক আমেরিকা সফর ও অতঃপর দেশে ফিরে এসে এক্সটেনশন না নেয়ার ঘোষণা সেখানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে হঠাৎ বদলে দিয়েছে। জেনারেল বাজওয়া দেশে ফিরে দু’টি গুরত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন- এক. তিনি আর এক্সটেনশন নেবেন না। দুই. পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না। তার এ ধরনের ঘোষণার পর পাকিস্তানে এখন এ ধারণা জন্মেছে যে, সেনাপ্রধান আমেরিকা সফরে গিয়ে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছুই লাভ করতে পারেননি।

কারণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানের অপ্রতিরোধ্য বিশাল জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা তার নীতি পুনর্নির্ধারিত করছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। বিভিন্ন খবর সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আমেরিকা এটি বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটনার ফলে ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জনগণ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মার্কিনবিরোধী হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে আমেরিকার পা রাখার জায়গা থাকবে না। অর্থাৎ একদিকে ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, চীন ও রাশিয়া। অর্থাৎ গোটা এই অঞ্চল আমেরিকার হাতের বাইরে থাকবে যা ভারতের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়।

তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরনো আগ্রাসী চিন্তাভাবনার থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানের ব্যাপারে একটি বাস্তবসম্মত নীতি নিতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ এমন এক নীতি যাতে চীন রাশিয়ার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না। পাকিস্তানের মতো ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে আমেরিকা ঝুঁকি নিতে পারে না। যে ভুল তারা করেছিল গণবিচ্ছিন্ন ইরানের রেজা শাহ পাহলভির সরকারকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে।

তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও কমিউনিস্ট ‘তুদেহ পার্টিকে’ দমন করার লক্ষ্যে আমেরিকা একটি সাজানো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানে প্রথম নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করে শাহকে আরো শক্তিশালী করার পরিণতি আমেরিকার জন্য এতটাই বিপর্যয়কর হয়েছিল যে, সেখানে আজ পর্যন্ত তারা পা রাখতে পারেনি। আমেরিকা আশঙ্কা করেছিল যে, জাতীয়তাবাদী মোসাদ্দেক সরকার কমিউনিস্ট শিবিরের দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং তেল ক্ষেত্রগুলো জাতীয়করণ করবে। যেমনটি ঘটেছে ইমরান খান সরকারের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছিল, ইমরান খান রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে। আর সেটি হলে পাকিস্তানে মার্কিন স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইরানের অভ্যুত্থানের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫৩ সালে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, প্রথম দফা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল ও রেজা শাহ পালিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় দফা অভ্যুত্থান সফল হয় এবং রেজা শাহ দেশে ফিরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল শাহের অনুগত জেনারেল ফয়জুল্লাহ জয়েদিকে। যদিও ওই সময় আমেরিকা ওই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল; কিন্তু পরবর্তীতে এ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ যে ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই ঘটনায় সিআইএ কিভাবে সরাসরি জড়িত ছিল তার বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। ওই অভ্যুত্থানের পর একদিকে তুদেহ পার্টির নেতারা বিদেশে পালিয় যান, অন্য দিকে ইসলামপন্থীরা সংগঠিত হতে শুরু করে। একপর্যায়ে উভয় পক্ষ একজোট হয়ে রেজা শাহ পাহলভির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯৭৯ সালে যা ইসলামী বিপ্লব হিসেবে সফল হয়।

ঠিক একইভাবে ইমরান খানের আমেরিকা ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার আশঙ্কা এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ ওঠে- আমেরিকা এই ‘রেজিম চেঞ্জের’ ঘটনা ঘটিয়েছে। যদিও আমেরিকা তা অস্বীকার করে। যেমনটি করেছিল ইরানের ক্ষেত্রে। যাই হোক, এখন আমেরিকা বুঝতে পারছে, রেজিম চেঞ্জ ঘটানো উল্টো ফল বয়ে আনছে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ইরানে মোসাদ্দেক সরকার খুব জনপ্রিয় সরকার ছিল। আমেরিকা তা বুঝতে চেষ্টা করেনি। তাই আমেরিকার অবৈধ কাজের ফলে পরবর্তীতে সেখানে ইসলামপন্থীরা সহজে গ্রাউন্ড পেয়ে যায়। ইরানের জনগণ ওই জবরদস্তি পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি। আর সে কারণে সেখানে মার্কিন বিরোধিতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যা ছিল আমেরিকার জন্য মহাবিপর্যকর। যা এখনো অব্যাহত আছে। ঠিক আমেরিকা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও ধারণা করতে পারনি। ফলে রেজিম চেঞ্জ ঘটনাকে পাকিস্তানের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তাই আজ পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া ও জনগণ প্রচণ্ডভাবে মার্কিনবিরোধী হয়ে পড়েছে। খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে- ইরানে মোসাদ্দেক বিপুল জনপ্রিয় হলেও পশ্চিমা ঘেঁষা এলিট ক্লাসের একটি অংশ বিরুদ্ধে ছিল। একইভাবে পাকিস্তানে ইমরানের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হলেও পশ্চিমা ঘেঁষা ফিউডাল এলিট এবং তাদের সামরিক ও বেসামরিক আমলা প্রতিনিধি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের সমন্বয়ে এটি ইমরানের বিরুদ্ধে ছিল। আর এটিকে পুঁজি করেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটনা হলো।

ইমরান খানের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার কারণে আমেরিকাকে তার প্রথাগত চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার নিরিখে সব কিছু ভাবতে হচ্ছে। ক্ষমতা বদলের পর পিডিএম সরকার একদিকে যেমন ইমরানের জনপ্রিয়তা রুখতে পারনি; তেমনি পারেনি ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে; বরং এমন ধারণা জন্মেছে যে, ক্ষমতা বদল হয়েছে যেন শরিফ ও জারদারি পরিবারের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। আর এ ধারণা পাকিস্তানি জনগণকে আরো মার্কিনবিরোধী করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। এই যে সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে তা কার্যত ভবিষ্যতে মার্কিন শিখণ্ডী হিসেবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পালন অনেকটা হ্রাস করে দিয়েছে। সেনা নেতৃত্বও সেটি বুঝতে পারছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।

তাই পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিডিএম সরকারের সামনে এই জটিল অবস্থা মোকাবেলায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ছাড়া উত্তম আর কোনো পথ খোলা নেই। আর ইমরানের সামনে দু’টি পথ খোলা আছে- এক. সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা ও চাপটা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাতে সেনা নেতৃত্ব সরকারকে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য করে। সে পরিস্থিতি এখন সেখানে বিরাজ করছে।

দুই. পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করে সরকারকে হটিয়ে দেয়া। এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ পার্লামেন্টে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাত্র দুই ভোটের। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমরান খান প্রথম অপশন অনুসরণ করবেন। কারণ দ্বিতীয় অপশনে গেলে ইমরান খান টাকা-পয়সার খেলায় শরিফ ও জারদারি পরিবারের সাথে পেরে উঠবেন না।

পরিশেষে বলা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতি বর্তমানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আমেরিকা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করায় পিডিএম সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। কারণ আমেরিকার পক্ষে ইমরানের জনপ্রিয়তাকে যেমন উপেক্ষা করা সম্ভব নয়; তেমনি সম্ভব নয় পাকিস্তানের জগণের ক্রমাগত মার্কিনবিরোধী হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় না রাখার। ফলে পাকিস্তানে এখন অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খানের সাথে একটি বোঝাপড়ায় গেলে অবাক হওয়ায় কিছু থাকবে না।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল