১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

নোয়াখালীতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য

নোয়াখালীতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য - ছবি : সংগৃহীত

দেশজুড়ে কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, মাদক ব্যবসায়সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এমনকি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য গ্যাংয়ের সাথে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনখারাবিতে জড়াতেও পিছপা হচ্ছে না কিশোর অপরাধীরা। উদ্বেগের বিষয় হলো, মাদক নেশার টাকা জোগাড় করতে ছোটখাটো অপরাধে জড়ানো কিশোর অপরাধীরা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। আরো উদ্বেগের বিষয়, ভাড়াটে হিসেবে তারা মানুষ হত্যা কিংবা নির্যাতনের মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না জন্মদাতা মা-বাবা ও ভাইবোন। নোয়াখালী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জেলা শহরটি আজ অপরাধের রাজ্য। রাজ্যের সম্রাট যেন কিশোর গ্যাং।

নোয়াখালী সোনাইমুড়ি এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়েছে। এক স্কুলছাত্রকে তুলে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছে তার ওপর। দুই দফা বেধড়ক মারধর ছাড়াও তার শরীরে দেয়া হয়েছে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা। নির্যাতিত কিশোর এখন নোয়াখালীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এলাকাবাসী অভিযোগ করছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এবং এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় নোয়াখালীতে কিশোর গ্যাংগুলো সম্প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব কিশোর গ্যাং এলাকায় হেরোইনসহ মাদক দ্রব্য পাচারেও লিপ্ত। ছিনতাই ও চাঁদাবাজিও করছে তারা। নোয়াখালীতে বর্তমানে অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। নানান অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছে বলে অবিযোগ আছে। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।

আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমে বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। নোয়াখালীতে রাজনৈতিক খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের তৎপরতা রোধে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয় নোয়াখালীর সেনবাগ ও বেগমগঞ্জ এলাকায়। নোয়াখালী চাটখিল পৌরসভায়ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ। এ তিন এলাকায় প্রায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নেশার টাকার জন্য খুনোখুনি, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করলেও রাজনৈতিক নেতাদের কারণে আবার বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে চাটখিল পৌরসভা এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।

চাটখিল উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মধ্যে সাপুর, পরকোট, বদল কোট ইউনিয়ন কিশোর গ্যাংয়ে অতিষ্ঠ। তার মধ্যে অন্যতম ৫ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের একজন স্কুল মাস্টারের সাথে আলাপকালে জানান, রাজনৈতিক নেতারা পদ-পদবির জন্য কিশোর গ্যাংদের হাতে অস্ত্র ও মাদক তুলে দিয়ে এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু নেতা দীর্ঘ প্রবাসে থেকে বৈধ-অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের পদ বাগিয়েছেন। তারাই এখন চাটখিলের রাজনীতিকে বিতর্কিত করেছেন। ওই রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাং।

পুলিশ প্রশাসনের প্রতি এলাকাবাসীর দাবি, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত সব সদস্যকে যেন দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনা হয়। শুধু তাই নয়, এই মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সক্রিয় সব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এলাকাবাসীকে কিশোর গ্যাংয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। সাথে যে সব নেতার কারণে পিতা-মাতার সন্তান নষ্ট ও পথভ্রষ্ট হয় সেই সব রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিশোর গ্যাং কালচারের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাকেও দায়ী করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, অবস্থা এখন এমন জায়গায় চলে গেছে যে, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে।

তারা আরো বলছেন, আগামী প্রজন্মকে অপরাধমুক্ত রাখতে হলে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। তা না হলে দিন দিন পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। বস্তুত আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, সমাজ ও পরিবারের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কিশোর গ্যাং কালচার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিশোর গ্যাংয়ের যেসব সদস্যকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে- সেখানে তারা সংশোধিত হওয়ার পরিবর্তে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে বেরিয়ে আসছে। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলো কেন কিশোর অপরাধীদের অপরাধপ্রবণ চরিত্র পাল্টাতে পারছে না, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement