২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হিজাবের বিপক্ষে রায়

- ছবি : সংগৃহীত

হিজাবের বিপক্ষে কর্র্নাটক হাইকোর্টের রায় মুসলমানদের মাঝে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেমনটি হয়েছিল কয়েক বছর আগে শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘ইসলামী শরিয়ায় হস্তক্ষেপ’ অভিহিত করা হয়েছিল, অনুরূপভাবে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়কে ‘ইসলামী শরিয়ায় হস্তক্ষেপ’ ও ‘ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা’ অভিহিত করা হচ্ছে। উচ্চ আদালত দীর্ঘ যুক্তিতর্কের পর তার চূড়ান্ত রায়ে হিজাবকে ইসলামের আবশ্যিক অংশ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন।

এ রায়ের সাথে সাথেই কর্নাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে বহাল রেখে আদালত বলেন, ‘স্কুলের ইউনিফর্মের বিধি একটি যৌক্তিক নিয়ম, যা আইনসম্মত। ছাত্রীরা এতে আপত্তি করতে পারে না।’ চিফ জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থি, বিচারপতি কৃষ্ণা দীক্ষিত ও বিচারপতি জি এম কাজির বেঞ্চ এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে দায়েরকৃত সব আর্জিও খারিজ করে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ১ জানুয়ারি কর্নাটকের উদুপি শহরের এক প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছয় ছাত্রী হিজাব পরিধান করে ক্লাসে প্রবেশে বাধাদানে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এরপর বিষয়টি দীর্ঘ আকার ধারণ করার পর কর্নাটক সরকার এমন কাপড় পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার দ্বারা স্কুল-কলেজে অভিন্নতা ও ঐক্যের ওপর প্রভাব পড়ে বা সাধারণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। মুসলিম ছাত্রীরা উচ্চ আদালতে জারিকৃত এ নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে যে ব্যাপারে তাদের বিপক্ষে রায় এসেছে। উচ্চ আদালত এ ইস্যুকে দীর্ঘ হতে দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেভাবে হিজাব বিতর্ক সামনে এসেছে, তাতে এ বিতর্ক শক্তি পেয়েছে যে, কিছু অদৃশ্য হাত সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বিনষ্ট করতে তৎপর।’ উল্লেখ্য, উচ্চ আদালত হিজাবের বিপক্ষে রায় শোনানোর সময় ওই গোষ্ঠীর কথা উল্লে­খ করেননি, যারা এ ইস্যুতে ‘দেবতার সৈনিক’ হয়ে সামনে এসেছে এবং যারা কলেজের ছাত্রী ও প্রশাসনের মাঝে একটি মামলাকে হিন্দু-মুসলিম বিতর্ক বানিয়ে সা¤প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এ ছাড়া বিধানসভা নির্বাচনের সময় এর দ্বারা রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানোরও চেষ্টা করেছে।

এ বিষয়টি এখন ব্যাপক হয়ে গেছে যে, মুসলমান যখনই বা ইসলাম সম্পর্কে কোনো বিষয় সামনে আসে, তখনই দেশে তৎপর ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শুরু করে দেয়। এ দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এ সব মুহূর্তে সরকারি সংস্থা ও সব ধরনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী দফতরও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ ইস্যুতেও একেবারে সেটাই হয়েছে। মুসলিম ছাত্রীরা যখন হিজাব পরিধান করতে নিজেদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর জোর দিচ্ছিল, তখন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো গেরুয়া শাল ও ওড়না পরিধান করে কলেজে প্রবেশ করে এবং মুসলিম ছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর চেষ্টা করে। এমনই একটি মুহূর্তে অন্যতম ছাত্রী মুসকান যখন গেরুয়াধারী ছাত্রদের জয়শ্রীরাম ¯স্লোগানের মাঝে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে ওঠে, তখন দেশে এক বিস্ময়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ ছাত্রী মুসলিম ছাত্রীদের জন্য এক রোল মডেল হয়ে যায়। কয়েকটি জাতীয় সংগঠন তাকে কয়েক লাখ রুপির পুরস্কারে ভ‚ষিত করে এবং মাথায় তুলে নেয়। এভাবে হিজাব ইস্যু এতটাই দীর্ঘ হয় যে, দেশের অন্য অংশগুলোতেও হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের স্কুলে প্রবেশ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাদের হিজাবমুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এতে সেই শক্তিগুলো অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছে, যারা এ দেশে ইসলাম ও মুসলমানের আল্লাহর বিধান পালনে বাধা। তারা সেই সব চিহ্নকে মুছে ফেলতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে, যার দ্বারা ইসলামী সংস্কৃতি ও সামাজিকতার প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পায়। কর্নাটক হাইকোর্টের সদ্য রায়ের পর হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কেননা, এই রায়কে দেশজুড়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে।

কর্নাটক হাইকোর্টের রায়ে সব মুসলিম সংগঠন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এ ধারাবাহিকতায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের পক্ষ থেকে জারিকৃত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উচ্চ আদালতের রায় ইসলামী শিক্ষা ও শরয়ি বিধানাবলি বিরোধী। এ রায় সংবিধানের ১৫ নং ধারারও পরিপন্থী যা ধর্ম, বংশ, গোত্র ও ভাষার ভিত্তিতে সব ধরনের বৈষম্যের পরিপন্থী।’ পারসোনাল ল’ বোর্ড আরো বলেছে, ‘যে বিধান ফরজ বা ওয়াজিব হয়, তা বাধ্যতামূলক। এর বিরোধিতা করা পাপ। এ হিসেবে হিজাব একটি আবশ্যিক বিধান। যদি কেউ এর আমল না করে, তাহলে সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হবে না, তবে সে পাপী হবে। এ কারণে এটা বলা উচিত নয় যে, হিজাব ইসলামের আবশ্যিক অংশ নয়।’ মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের বিবৃতির চুম্বক অংশ সেটি, যেখানে বলা হয়েছে বহু মুসলমান তার নিজের ত্র“টি ও অসচেতনতার কারণে রোজা, নামাজ থেকে দূরে থাকে। এর অর্থ কখনোই এটি নয় যে, নামাজ রোজা আবশ্যিক নয়।’ মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের এ বিবৃতি থেকে স্পষ্ট, এ দেশে মুসলমানদের অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে। এ কারণেই আদালতে হিজাবের ওপর দীর্ঘ যুক্তিতর্কের সময় মুসলমানদের আমলহীনতা ও ধর্ম থেকে দূরে থাকার নানা উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়। যদি বাস্তবেই এ দেশে মুসলমানরা ধর্মীয় নিদর্শন, চিহ্ন ও প্রতীকের অধীনে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করত, তাহলে কর্নাটক হাইকোর্টের রায়ে এর বিপরীত চিত্র স্পষ্ট দেখা যেত। কিন্তু যেমনটি পারসোনাল ল’ বোর্ড বলেছে, মুসলমানদের আমলহীনতা বা ধর্মহীনতাকে শরয়ি বিধানাবলিতে উদাহরণ বানানো যায় না। এ জন্য ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়টির আরো একটি দিক হচ্ছে, ইউনিফর্ম নির্দিষ্ট করার অধিকার স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে মামলাটি হাইকোর্টে গেছে, সেটি স্কুলের নয়, বরং কলেজের। এ জন্য বিধি মোতাবেক প্রশাসনের নিজের পক্ষ থেকে ইউনিফর্ম চাপিয়ে দেয়ার অধিকার নেই।

কর্নাটক হাইকোর্টের উল্লি­খিত রায়কে সুপ্রিম কোর্টে এক ছাত্রীর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়। সচেতন মানুষদের বক্তব্য হচ্ছে, উদুপি কলেজের ছাত্রী ও প্রশাসনের মাঝে হিজাব নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, কিছু জ্ঞানী মানুষের স্থানীয়ভাবেই এটিকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত ছিল। এ মামলায় ক্যাম্পাস ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সম্পৃক্ততাও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যদি এ মামলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যেত, তাহলে নিঃসন্দেহে ঘটনা এতদূর গড়াত না। হাইকোর্টের রায়ের পর মুসলমানদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ দেখে অনুমান হয়, এখন তাদের শক্তি সেভাবে পথেই শেষ হয়ে যাবে, যেভাবে শাহবানু মামলায় হয়েছিল। অথচ ওই প্রতিবাদের ফল পার্লামেন্ট থেকে মুসলিম তালাক আইনের রূপে প্রকাশ পেয়েছিল, যাকে মুসলমানরা নিজেদের ‘অনেক বড় সফলতা’ অভিহিত করেছিল। কিন্তু বড় বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছেÑ আদালত আজো ওই আইনের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষ এ কথা ভালো করেই জানে, সা¤প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো এ দেশে মুসলমানদের এভাবেই লড়াইয়ে আটকে রাখতে চায়। তাদের তীব্র খায়েশ হচ্ছে, মুসলমানদের শক্তি এভাবে প্রতিবাদ করতে করতে শেষ হয়ে যাক যাতে তারা কোনো ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজ করে সফল হতে না পারে। মোট কথা, এটি যাচাই করা খুবই জরুরি যে, ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর এ অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে আমাদের কে কে জড়িত আছে? তাদের ইন্ধন কোথা থেকে আসছে? আমাদের মতে, হিজাব ইস্যুটি আদালতে নিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আর এমনটা করে মুসলমানরা নিজেদের জন্য এক বড় অস্থিরতা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২০ মার্চ, ২০২২ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement