২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হিজাবের প্রাসঙ্গিকতা

-

আজকের পৃথিবীতে হিজাব কোনো বিশেষ পোশাক বোঝায় না। পর্দাপ্রথা নানা ধরন, নানা সীমানায় আবদ্ধ। কুরআনে এর মূলনীতি বর্ণিত। আল্লাহ নারীদের নির্দেশ করছেন মাথার কাপড় দিয়ে ঘাড় ও বুক আবৃত করতে। বাংলাদেশে এ ধরনের চর্চা শুধু বয়স্কদের মধ্যে দেখা যেত। তারা বোরকা পরতেন, আর অল্প বয়স্করা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরত, কাউকে মাথায় স্কার্ফ অথবা হিজাব পরতে দেখা যেত না। গত দুই দশকে মেয়েদের হিজাব পরিধানের প্রবণতা অধিকহারে লক্ষ করা যায়। বেশির ভাগ ইসলামী চিন্তাবিদ পর্দাপ্রথাকে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করেন। তবে পোশাকের সীমা ভিন্ন আঙ্গিকে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। আবার এ-ও সত্য যে, হিজাব বা পর্দা ইসলামের কোনো বুনিয়াদি স্তম্ভ নয়।

তারজমানুল কুরআনে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ধর্মের প্রকৃতি বর্ণনা করেন। ইসলামের আধ্যাত্মিকতার দু’টি রূপ - একটি অন্তরের, আরেকটি বাইরের। প্রথমটি মুখ্য আর একেই আরবিতে বলা হয় ‘দ্বীন’। দ্বিতীয়টি গৌণ, আরবি রূপ ‘শারা’ বা ‘মিনহাজ’ ও ‘নাস্ক’। শারা ও মিনহাজ অর্থ - পথ, ‘নাস্ক হলো পথপরিক্রমা। সহজ কথায়, দ্বীন মানুষকে যে পথে পরিচালিত করে, যে দিকনির্দেশনা দেয়, তাই আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই। যুগে যুগে যত পথপ্রদর্শক এ পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন, তারা সবাই একই দ্বীনের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন, তবে শারা ও মিনহাজ ভিন্ন থাকতে পারে।’ আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য ইবাদতের একটি নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দিয়েছি, যা তারা পালন করে। অতএব তারা যেন এ ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক না করে। তুমি তাদের পালনকর্তার দিকে আহ্বান করো। নিশ্চয় তুমি সরল পথেই আছো। (২২ : ৬৭)

সুতরাং দ্বীন বহিঃপ্রকাশ দাবি করে। দ্বীনের পূর্ণতা আসে কর্মে। ধর্মীয় আচার অনুশীলনের দ্বারা দ্বীন পরিস্ফুটিত হয়। রন্ধনশিল্পী রান্নার উপকরণ জেনেই ক্ষান্ত হন না, সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খাবার রান্না আর পরিবেশনেই পরিতৃপ্তি অর্জন করেন। তেমনিভাবে দ্বীন কেবল জ্ঞানার্জনে অথবা বিশ্বাসকরণে সীমাবদ্ধ থাকলে, দ্বীন বা ধর্মের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন সম্ভব নয়। শুধু নিয়মিত চর্চা আর অনুশীলনের দ্বারাই সঙ্গীতসাধক তার অপূর্ব সুর মূর্ছনায় নিজে যেমন আপ্লুত হন, তেমনি পারিপার্শ্বিক আবহ তৈরি করেন, অন্যজনকে বিমোহিত করেন। ধার্মিক ব্যক্তি তেমনি নিয়মিত জ্ঞান অনুশীলন আর ব্যবহারিক চর্চায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন, পাশাপাশি অন্যকে আকৃষ্ট করেন। মুসলিম নারীর পোশাক দ্বীনের এমন এক বহিঃপ্রকাশ, যা অন্যকে ভাবায়, মুহূর্তকালের জন্য হলেও।

হিজাব কেবল ধর্মীয় অনুশীলন নয়, হিজাব নারীকে এক নতুনরূপে সত্যায়িত করে, এক ভিন্ন আমেজে উপস্থাপিত করে। প্রতিবিম্ব প্রতিস্থাপনে এই সম্ভার অবমাননা করা হয়; অর্থাৎ এ চর্চা নিয়মিত হওয়া জরুরি। আল্লাহ নিয়মিত ইবাদত পছন্দ করেন। অন্য দিকে হিজাব নিয়মিত না হলে তা অন্যকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে, সেক্ষেত্রে নারী ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

হিজাব নারীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনে। গবেষণায় দেখা গেছে, হিজাব পরিহিতা নারী নিজেকে নিরাপদ ভাবেন। যুক্তরাজ্যের গবেষক ক্যাথারিন বুল্লক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারী সাতটি কারণে হিজাব পরেন। (সূত্র : রিথিংকিং মুসলিম উইমেন অ্যান্ড দ্য ভেইল)

আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়, আর ইরান বিপ্লবে, সেই দেশের নারীরা মাথায় হিজাব টেনেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ আর পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট শাসকের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক প্রতিবাদস্বরূপ। পাশ্চাত্যকরণের ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ভাবধারায় প্রভাবিত নারী হিজাবের প্রচলন ঘটান।

ধর্মপ্রাণা নারী ইসলামী পোশাকবিধি অনুসরণের নিমিত্তে হিজাব পরেন। তারা মনে করেন, উন্নত সমাজ গঠনে শালীন পোশাক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। নারীসমাজ একসময় মনে করে হিজাব ও শালীন পোশাক সামাজিক অবক্ষয় রোধে সক্ষম। মিসর, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়।

কিছু নারী মনে করেন, ঢিলেঢালা শালীন পোশাক ও হিজাব ঘরের বাইরে তাদের চলাফেরাকে সহজতর করে। যেমন - বাংলাদেশে গার্মেন্টে নারী পোশাককর্মীদের মাঝে হিজাব-বোরখা পরার প্রবণতা দেখা যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, তারা হিজাব-বোরখা পরে নিজেদের অধিকতর নিরাপদ বোধ করে।

হিজাব নারীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। এ ধরনের মানসিকতা ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় অভিবাসীদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের (second/third generation) মাঝে পরিলক্ষিত হয়। পারিবারিক নিয়ম ও রীতিনীতি রক্ষার্থে কিছু নারী হিজাব-বোরখা পরিধানে অনেক সময় বাধ্য হন। মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দেশগুলোতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক সময় নারীকে কোনো কোনো রাষ্ট্র বাধ্যতামূলক আইনের বলে হিজাব পরতে বাধ্য করে। ইরান, আফগানিস্তান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

হিজাব যুগে যুগে, দেশে দেশে বিভিন্নভাবে বিরাজমান থেকেছে। আমাদের বাঙালি নারীরা শ্রেণী ধর্ম নির্বিশেষে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে নিতেন। বেগম রোকেয়ার এ ছবিই আমাদের স্মরণে প্রোথিত। ঊনবিংশ শতকের পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান নারী একধরনের ক্লোক পরতেন, যাকে ‘বোরখা’ বললে অত্যুক্তি হয় না। তারা মাথায় পরতেন বনেট, যা বিশেষ ধরনের টুপি, আজকের হেড স্কার্ফের সমার্থক।

আমেরিকার Stony Brook University-এর এক গবেষণায় Nicholas R Eaton দেখিয়েছেন, ঢিলেঢালা পোশাক পরিধানকারী নারীরা বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতায় কম ভোগে। ধর্মপ্রাণ নারীদের মধ্যেও এই মানসিক সমস্যা তুলনামূলক কম। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ঢিলে পোশাক যেহেতু নারীর আকর্ষণীয় অবয়ব ঢেকে রাখে; সেহেতু মুসলিম নারী তা পরিধানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি আরো বলেন, হিজাব নারীর মুসলিম পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসে। মুসলিম সংখ্যালঘু সেই সমাজে হিজাব নারীর প্রতি ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে ইংল্যান্ডের গবেষণায় ভিন্ন রকম তথ্য উঠে এসেছে। ব্রিটিশ পুরুষরা হিজাবি নারীকে কম আকর্ষণীয় অথচ মেধাবী ও দক্ষ মনে করে (Swami, 2012).

হিজাব নারীকে এক অভিনব সত্তায় ভ‚ষিত করে। নারীর যৌন আবেদনকে গৌণ করে, তাকে সৌন্দর্যের অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা থেকে মুক্তি দেয়। ঘরে ও বাইরে নারী আপন সত্তায় বিকশিত হয়। মেধা, মনন ও পরিশ্রমের অর্জন তাকে স্বমহিমায় মহিমান্বিত করে। নারী উদ্ধত তরবারি হাতে নিতে পিছপা হয় না, অবরোধ তাকে অন্তঃপুরে নির্বাসিত করে না। শালীন পোশাক তাকে নারীসুলভ দুর্বলতা থেকে মুক্তি দেয়, সর্বত্র তার অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে। বিদ্যার্জনে অথবা কর্ম ব্যাপদেশে নারীর বিচরণ ঘটে পৃথিবীজোড়া।

পুরুষের কুদৃষ্টিতে মুসলিম নারী পিছপা হয় না। দৃষ্টি যার অপরাধ তার। কেননা আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে দৃষ্টি সংযত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। নারীকেও দৃষ্টি অবনত রাখতে তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল সা: অন্ধ সাহাবি উম্মে মাকতুমের সামনে হিজাব পরিধানের নির্দেশপূর্বক বলেছিলেন, ‘তুমি তো অন্ধ নও’।
কুরআন ঘোষণা করে, ধর্মে কোনো জবরদস্তি চলে না। সুতরাং পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে হিজাব পরতে বাধ্য করলে তার পরিণতি ভালো হয় না। এর প্রতিফলন ঘটেছে ইরানে ২০১৭ সালে, যখন প্রায় অর্ধশত নারী একযোগে মাথার কাপড় টেনে ফেলে এ ধরনের জোরজুলুমের প্রতিবাদ করেছিল।

যুগে যুগে নারী ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। ১৯২৪ সালে তুরস্কে হিজাব নিষিদ্ধ করেন কামাল আতার্তুক। ইরানে ১৯৩৬ সালে রেজা শাহ পাহলভি সর্বস্তরে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইউরোপের প্রায় ১২টি দেশে কোনো না কোনো আঙ্গিকে হিজাব নিষিদ্ধ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডে হিজাবে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাদের যুক্তি হলো - হিজাব সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে, ধর্মীয় সহিংসতা বাড়ায়। এ ধরনের চরমপন্থা পরবর্তীকালে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। ফ্রান্সের ধর্মীয় সহিংসতা নির্মূল করা অসম্ভব, এর প্রমাণ বিশ্ববাসীর সামনে বিরাজমান।

পোশাক মনকে প্রভাবিত করে, এ কারণেই মহানবী সা: নারীকে পুরুষের পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন। পোশাকের ইসলামী বিধান মনকে কালিমামুক্ত করে, যেমন করে অজু দেহকে পরিচ্ছন্ন করে। সেই পবিত্র মন নিয়ে স্রষ্টার সামনে দাঁড়াতে, নারীকে হিজাব পরতে হয়। সেই পবিত্রতম সত্তা যে বিধান দিয়েছেন, তাই সরল পথ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সরল পথে পরিচালিত করুন, আমিন।

লেখক : কনসালট্যান্ট, নিউরোলজিস্ট ইউকে


আরো সংবাদ



premium cement
রাজধানীতে সংঘর্ষে ২ যুবক নিহত জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু তোফাজ্জল হত্যা : ঢাবির ৬ শিক্ষার্থীর দায় স্বীকার কুমিল্লা-১০ বিনির্মাণে আমাদেরকে কাজ করতে হবে : ইয়াছিন আরাফাত উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতেছিল আ’লীগ : হামিদ আজাদ ভাইকে হত্যা করাতে ১৪ মাসের ষড়যন্ত্র ভান্ডালজুড়ি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে খুলনায় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাংবাদিক রনো ও তার পরিবার চট্টগ্রাম পানগাঁও নৌরুট জনপ্রিয় করার উদ্যোগ

সকল