২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

খাসলত হচ্ছে কয়লার ময়লা

-

সাধারণ মানুষ বলে থাকেন, খাসলত নাকি ধুয়ে ফেললেও যায় না। তাদের এই অভিজ্ঞতা আমরা দেখতে পাবো আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বভাবে, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও সামরিক স্বভাবে। কেউ কেউ বলবেন, ও তো খাসলত না, দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সামরিক নীতি-আদর্শ। ওই সব খাসলতই তো তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নীতি-আদর্শ তৈরি করে তা কি আমরা ভুলে যাবো? না, ভুলে যাবো না। খাসলতের হাত ধরেই যে ওই সব নীতি-আদর্শ ও স্বার্থরক্ষার বিধিবিধান রচিত ও বাস্তবায়িত হয় সেটি আমরা জানি।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্স বা তুরস্ক বা ধরুন এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের স্বভাব বা খাসলত কি পাল্টাতে দেখেছি আমরা? না, দেখিনি। যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তার রাজনৈতিক স্বভাব অনুযায়ী অ্যাক্ট করে। এটিই হচ্ছে খাসলত। এই খাসলত নেগেটিভ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেটি আমরা জানি এবং সেই সত্যই গোটা বিশ্বের প্রধান উপাদান ও রাজনৈতিক উপকরণ।

আসলে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রের খাসলতের ভেতর মহলের নকশার আভাস পাই কিন্তু তার রোডম্যাপ আঁচ করতে পারি না। আবার পারলেও তা বলতে পারি না; কারণ এখন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সরকারই টাইরান্ট বা কর্তৃত্ববাদী, হোক সেই দেশ গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর অধীন এবং জনগণের মত নিয়েই ক্ষমতার ‘সিংহাসনে’ বসেছে। ক্ষমতা এমন এক শব্দতরঙ্গ, যা মানুষের মনে এক অভাবনীয় চেতনার জন্ম দেয় আর তার অভিঘাত ক্ষমতাবানদের কাউকে কাউকে অন্ধ করে দেয়।

২.
নিজের দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত বহুকাল ধরেই, তার পরও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আচরণ করেছিলেন নিকৃষ্ট কর্তৃত্ববাদীর। এমনকি ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র মতো নগ্ন বর্ণবাদ উসকে দিয়ে গোটা আমেরিকান সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন। এখনো সাদা চামড়ার অনেক লোকই ভাবেন যে, তারা কালো, পীতাভ, বাদামি লোকদের চেয়ে উন্নতজাতের মানুষ; যা আমরা আগে শুনেছিলাম জার্মানির হিটলারের মুখে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। সেই একই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল ট্রাম্পের কণ্ঠে। এর চেয়ে বড় অসততা, মিথ্যা আর কী হতে পারে? যে রঙেরই হোক না কেন, কেবল মানুষ, সবাই একই সারির বা একই সমতার সেখানে সুপ্রিম বলে কিছু নেই। কিন্তু এই বোধ, ক্ষমতার এই বোধ মানুষের ভেতরে সক্রিয় সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই। যখন থেকে ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল, সেই সময় থেকেই তা ধীরে ধীরে সমাজে, রাষ্ট্রের চেতনায় সুদৃঢ় শেকড় গাড়ে। এ কারণেই ব্রিটিশরা পৃথিবীজুড়ে উপনিবেশ সৃষ্টি করে, নিজেদের সংস্কৃতিকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত করে, উপনিবেশের মানুষদের সংস্কৃতিহীন ও শিক্ষাহীন তকমা লাগিয়ে তাদের সম্পদ লুটে নিয়ে ধনবানে পরিণত হয়েছে। সম্পদ লুটের এই স্বভাব তারা ছাড়তে পারেনি। আমেরিকান হোয়াইট পিপলরাও তাদেরই বংশধর। তারাও নিজেদের এককাঠি সরেস গলায় দাবি করে তারা সুপ্রিম, উন্নত। আজ পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত ও চিত্রিত যুক্তরাষ্ট্র সেই রোগে ভোগে শক্তি দেখায় বিশ্বের সর্বত্র।

চীন তার চার পাশের প্রতিবেশীর সাথে একই আচরণ করছে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা বা অংশীদারিত্ব নিয়ে সে বঞ্চিত করছে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই দারুস সালামকে। চীনা রাজনৈতিক স্বভাব এখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতোই সর্বগ্রাসী। দক্ষিণ চীন সাগরে তার সামরিক অবস্থান এবং মালাক্কা প্রণালীর ওপর নজরদারি তাকে সেই খাসলতের মধ্যে ফেলেছে, যা করেছে তারা তাইওয়ানের ওপর মালিকানার দাবি অব্যাহত রেখে। তারা মনে করে, তাইওয়ান চীনের অংশ। তাই স্বীকৃতি নেই দেশটির। স্বীকৃতিহীন তাইওয়ানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভালোবাসা বেশ পোক্ত। গত মাসেও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে। আবার দক্ষিণ, উত্তর ও পূর্ব চীন সাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে, সেখানে টহল জারি রেখে সুদূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদি ও অকৃত্রিম দখল করার খাসলত জাগিয়ে রেখেছে। ঠিক একই রকম কাজ করে চলেছে ‘পতিত বলে চিহ্নিত ও চিত্রিত’ বর্তমান রাশিয়া। সে ইউক্রেনের দ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে বছর কয়েক আগে। আবার কৃষ্ণসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ টহল দিচ্ছে নিয়মিত। মাঝে মধ্যে সেসব জাহাজ ইউক্রেনের নৌসীমা লঙ্ঘন করছে, কিন্তু তা স্বীকার করে না রাশিয়া। আসলে প্রচ্ছন্ন হুমকি জারি রেখে ভ্রাদিমির পুতিন তার রাজনৈতিক ও সামরিক খাসলতের নমুনা দেখাচ্ছে।

পরভূমি দখলের খাসলত ভারতেরও কম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে নিজামের হায়দরাবাদ দখল করে আছে। এখন ওই রাজ্যের নতুন নাম করেছে তেলেঙ্গানা। জম্মু-কাশ্মির দখল করে নিয়েছে সেখানকার হিন্দু রাজার সহযোগিতায়। দখল করেছে ল্যান্ডলকড স্বাধীন দেশ সিকিম, লেন্দুপ দর্জির সাহায্যে, ১৯৭৫ সালে। তার দখলের তালিকায় আরো অনেক প্রতিবেশী আছে। আছে অপ্রকাশ কিছু ঘটনাও। ভেতর থেকে ও বাইরে থেকে নানান কৌশলে দখল কৃষ্টি চালু আছে। তবে সাংস্কৃতিকভাবে দখলদারিত্ব সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভারত সেই পথেই, ব্রিটিশদের অনুকারী। আজো আমরা ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক দখলের অধীন-মননে, মানসে, চিন্তাভাবনার আকরণে এবং আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে; অর্থাৎ ভ‚-রাজনৈতিকভাবে না হলেও মননগতভাবে আমরা আজো পরাধীন, ব্রিটিশদের হাতে।

দখলদারিত্বের মাধ্যমে দেশ দখলের আরো উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। মানুষের এবং অবশ্যই মানুষবাহিত রাজনৈতিক ও সামরিক খাসলত পরিবাহী হয়ে চলেছে। আর ক্ষমতার চর্বি থেকে রস নিংড়ে নেয়ার নানান কৌশলও ওই খাসলতেরই অধীন। যুক্তরাষ্ট্র সেই চর্বিযুক্ত দখল করা বিভিন্ন দেশ থেকে যা নেয়ার তার বেশির ভাগই নিয়েছে। এখন বাকি আছে কেবল ইরান। এ দেশটির নেতারা একটু ত্যাড়া টাইপের। এদের কাবু করা সহজ হয়ে উঠছে না। আমরা যদি ১৪০০ বছর আগে ইসলামের অগ্রযাত্রার ইতিহাস পড়ি, দেখব সেই সময় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ইসলামের আদর্শে আসার আহ্বান ইরানের রাজা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার পর সাংস্কৃতিকভাবে ইসলাম বিজয় অর্জন করে ইরানের প্রাচীন ও উন্নত সংস্কৃতির ওপর। তারা কেবল ইসলাম ধর্মই গ্রহণ করেনি, ইরানের লেখার হরফও পাল্টে গেছে। সেই ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র শায়েস্তা করতে চায় সামরিকভাবে; কারণ তার গ্রাসের প্রধান অন্তরায় এখন ইরান। সরাসরি শায়েস্তা করতে পারেনি সে ইরানকে। তাই ইসরাইলকে নিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরমাণু শক্তির অধিকারী ইসরাইল কেবল আগ্রাসীই নয়, তারা যেকোনো মূল্যে মুসলমানদের ধ্বংস করতে চায়। ইসরাইলের শক্তির উৎস আমেরিকা আর তাদের জুইশ পিপলস, যারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে এবং তারা আর্থিকভাবে ধনবান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জুইশ মানুষরাই গড়ে তোলে ইসরাইল নামক শিখণ্ডি রাষ্ট্রটি। আসলে ফিলিস্তিনিদের ভ‚মি দখল করে নিয়ে সেখানেই ইসরাইলের শেকড় ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদী রাজশক্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী পার্টনার হিসেবে। এখন সেই ইসরাইল মার্কিনিদের রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগী।

ইসরাইল মুখিয়ে আছে ইরানে হামলা চালাতে। সে হামলা চালালেই যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে যুদ্ধে নেমে পড়বে। ইরানি মানুষ ও সম্পদ ধ্বংস করতে পারলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ধ্বংস করা শেষ হবে। ইরাক, সিরিয়াকে ধ্বংস করার পর একমাত্র ইরানই অক্ষত আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইরান খুব রহস্যজনকভাবে পরমাণু শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি বাতিল করে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পর পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলা হয়ে যায়। ইরান এর প্রতিশোধ তুলতে কী কী পদক্ষেপ নেয়, তাই তারা দেখতে চাইছিল। এ ব্যাপারে ইরান খুব ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের কৌশলে ফেরে। সে কোনো প্রতিহিংসামূলক কাজে নামেনি বলে আমেরিকান চেতনায় আরো ভয় ঢোকে। ফলে জো বাইডেন ওই চুক্তিতে শিগগিরই ফিরে যেতে চাইলেও তাতে সফল হতে পারছেন না।

বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাবান দেশগুলোর এমন খাসলতের মূলে আছে দুনিয়ার সব রকম সম্পদ দখল করে নেয়ার অদম্য খায়েশ। চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তিক্ত এ কারণেই। পৃথিবীর দুই বা তিনটি পয়েন্ট আছে যেখান থেকে যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। তার একটি চীন সাগর কেন্দ্র করে ইঙ্গ-মার্কিন বনাম চীন; অন্যটি হরমুজ প্রণালী নিয়ে ইরান-মার্কিন সঙ্ঘাত; আর তৃতীয়টি হতে পারে ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার মধ্যে। ইউক্রেনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে, সেই উসকে দিতে পারে ইউক্রেনকে।

এসবই হতে পারে যদি বিশ্বের সামরিক ক্ষমতাবানরা লোভের অন্ধকার থেকে উঠে আসতে না পারে। দেশের মানুষের সার্বিক উন্নতির বিষয়টি পাশে সরিয়ে রেখে, নিজেদের মানবিকতাকে হত্যা করে যারা যুদ্ধের মতো নৃশংসতায় লিপ্ত হতে পারে, তারা অবশ্যই হত্যাযজ্ঞের সুপারম্যান। আমরা তাদের প্রশস্তি গাইতে পারি না।


আরো সংবাদ



premium cement