২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সেই তালেবান এই তালেবান

- ফাইল ছবি

সময় কত দ্রুত চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। তালেবান কাবুল থেকে পিছু হটছিল, এই তো কালকের কথা। আজ আমেরিকা কাবুল থেকে পালাচ্ছে। আজ ও কালের মাঝে বিশ বছরের পার্থক্য। বিশ বছরে একটি শিশু যুবক হয়ে যায়, আর যুবক হয়ে যায় বৃদ্ধ। কিন্তু আফগানিস্তান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, বিশ বছর আগে যেখানে ছিল। আমার মনে আছে, ২০০১ সালের নভেম্বরে কাবুলের উজির আকবর খান এলাকায় উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি তোরখাম সীমান্তের দিকে ফিরে আসছিলাম। কাবুল শহরের বাইরে জাতিসঙ্ঘের কম্পাউন্ডের কাছে একটি চেকপোস্টে তালেবানরা আমাকে আটকে দিলো। তারা আমার কাছে ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলো। আমি পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলাম।

আমার ভ্রমণসংক্রান্ত সব কাগজপত্র ঠিকঠাক ছিল। তালেবানরা আমাকে চিনতেও পেরেছিল। কিন্তু তাদের কমান্ডার মোল্লা খাকসার আমার মোবাইল ফোন নিয়ে নিলো। মোবাইল ফোনটি বন্ধ ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আফগানিস্তানে কেন এসেছে? আমি বারবার একই জবাব দিচ্ছিলাম- এখানে যুদ্ধ হচ্ছে। আমি যুদ্ধের রিপোর্ট করতে এসেছি। তিনি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, তুমি তো পত্রিকার সম্পাদক। রিপোর্টিংয়ের জন্য নিজে কেন চলে এসেছ? আমি উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারের টেপ ও ক্যামেরার ফিল্ম গাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। অবশ্য ফিরে আসার সময় কাবুলে একটি বিধ্বস্ত মার্কিন হেলিকপ্টারের ছবি তুলেছিলাম। আমি মোল্লা খাকসারকে বললাম, ক্যামেরায় বিধ্বস্ত মার্কিন হেলিকপ্টারের ছবি আছে।

ওই সময় তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা উবায়দুল্লাহ আখুন্দ আমার ব্যাপারে খবর পেয়ে যান। তিনি গাড়ি প্রেরণ করে আমাকে ডেকে পাঠান। আফগান কফির টেবিলে ক্ষমা চেয়ে বলেন, আপনি দ্রুত আফগানিস্তান থেকে ফিরে যান। আমরা আপনার নিরাপত্তা দিতে পারব না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা তো কাবুল থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না, তাই না? তিনি মুচকি হেসে বললেন, যুদ্ধে এ সব কিছুই হয়। আমরা কার্যকৌশল হিসেবে শহরকে রক্ষার জন্য পাহাড়গুলোতে চলে যাবো।

কয়েক বছর পর মোল্লা উবায়দুল্লাহ আখুন্দকে পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয়। ২০১০ সালে পাকিস্তানের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ওই বছরই অপর এক তালেবান নেতা উস্তাদ ইয়াসিরও পাকিস্তানে বন্দী থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আর ওই সময়ই মোল্লা আবদুল গনি বারাদারকেও পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ আগস্ট, ২০২১ সালে তালেবান বিশ বছরের পর কাবুলে প্রবেশ করলে আমার মোল্লা আবদুর রাজ্জাক আখুন্দের সেই কথা মনে পড়ল- ‘আমরা অবশ্যই ফিরে আসব।’ বিশ বছর আগে তালেবান ফিরে আসার প্রত্যয় নিয়ে কাবুল থেকে সরে গেছিল। কিন্তু আমেরিকা পুনরায় ফিরে আসার প্রত্যয় নিয়ে কাবুল ত্যাগ করছে না। কাবুল পতনের পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটোর চলে যাওয়ার পরও এই দেশ নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় ভরা পরিস্থিতির শিকার।
এবার তালেবানের মোকাবেলা তাদের পুরাতন কোনো প্রতিপক্ষের সাথে নয়, বরং এক নতুন শত্র“পক্ষের সাথে। যার নাম আইএস। যাকে ইসলামিক স্টেটও বলা হয়। কাবুল বিমানবন্দরে আইএসের হামলায় মার্কিন সৈন্যের পাশাপাশি তালেবান ও সাধারণ আফগান নাগরিকদেরও প্রাণহানি ঘটেছে। প্রথমবারের মতো তালেবান ও মার্কিন বাহিনী একসাথে কোনো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো। আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছে এবং পরদিনই হামলার পরিকল্পনাকারীদের নঙ্গরহারে এক ড্রোন হামলায় শেষ করে দেয়া হয়। তালেবান এই ড্রোন হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এর পরের দিন আইএসের ওপর আরো একটি বিমান হামলা করা হয়। তালেবানের কাছে নিন্দা জানানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তাদের স্থলবাহিনী রয়েছে, কিন্তু বিমানবাহিনী নেই। প্রচুরসংখ্যক যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার তাদের দখলে চলে এসেছে, কিন্তু এগুলো চালানোর পাইলট তাদের নেই।

যে আমেরিকা ও তার মিত্রজোটের বিরুদ্ধে তালেবান বিশ বছর লড়াই করল, আজ তালেবান সেই আমেরিকাকে বলছে, কাবুলে তোমাদের দূতাবাস বন্ধ করো না। যে তালেবান একসময় ছবি তোলা নিষিদ্ধ মনে করত, আজ সেই তালেবান আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে প্রেস কনফারেন্স করছে। মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেয়ার কারণে যে তালেবানের দুর্নাম ছিল, আজ সেই তালেবানকে আফগান মিডিয়ার নারী সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে এই প্রশ্ন উঠছে যে, আজকের তালেবান কি বিশ বছর আগের তালেবানের চেয়ে ভিন্ন? আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আজকের তালেবানের ক্ষেত্রে ‘নিউ তালেবান’ পরিভাষা ব্যবহার হচ্ছে।

বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, পশ্চিমা মিডিয়ার আফগান তালেবান ও আইএসের পার্থক্য জানা আছে; কিন্তু ভারতের মিডিয়াকে এই পার্থক্য সম্বন্ধে অজ্ঞ দেখা যাচ্ছে। কাবুল বিমানবন্দরে হামলার পর থেকে ভারতের মিডিয়া পাকিস্তানের সাথে আইএসের সম্পর্ক যুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের এটা জানা নেই যে, তালেবান আফগানিস্তানে জন্ম নিয়েছে, আর আইএসের জন্ম হয়েছে ইরাকে। তালেবান যখন আমেরিকার সাথে আলোচনা শুরু করে এবং কাতারে নিজেদের দফতর খোলে, তখন আফগানিস্তানে আইএসকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। তালেবানের কিছু যোদ্ধা আইএসে যোগ দিয়েছে। তালেবান ও আইএসের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। আর এভাবে ইরানের মতো দেশ তালেবানের সাহায্য শুরু করে দিয়েছে। ইরানিদের ধারণামতে, তালেবান অনেক বিষয়ে কট্টর, কিন্তু আইএসের মতো সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা লালন করে না। আইএসের সাথে লড়াইয়ের পর তালেবান রাশিয়ারও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং এখন এই লড়াইয়ের পর তালেবান ও আমেরিকার মাঝে সহযোগিতার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আজকের তালেবান নেতৃবৃন্দ মোল্লা ওমরের চিন্তাদর্শনের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু তারা কার্যকৌশলে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এই নতুন কার্যকৌশলের অধীনে তারা মিডিয়া ও ক‚টনৈতিক অঙ্গনেও তৎপর হয়েছে। তবে আজকের তালেবান অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করা না হলে তালেবানের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি হতে পারে।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তো আইএস। আইএস মোকাবেলার জন্য তালেবানকে এই অঞ্চলের সব রাষ্ট্রকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলো শুধু সেই পরিস্থিতিতেই তালেবানের সাথে চলবে, যদি আফগানিস্তানের ভ‚খণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধ ব্যবহার করা না হয়। তালেবানের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ ১৫ আগস্টের পর কয়েকটি দাবি ও ওয়াদা করেছেন। ওই দাবিগুলোকে বাস্তব বানানোও একটি চ্যালেঞ্জ। তালেবানের মুখপাত্র বলেন, আফগানিস্তানে মিডিয়া স্বাধীন হবে। প্রকৃত বাস্তবতা বলছে, আফগান মিডিয়া রীতিমতো কঠোর চাপে রয়েছে। কিছু নারী সাংবাদিককে আফগানিস্তানে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। তবে কিছু এমনও আছে, যাদের কাজে বাধা দেয়া হয়েছে। কিছু সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছে। আবার তাদের মুক্তিও দেয়া হয়েছে। কিছু সাংবাদিকদের ঘরে অভিযান চালানো হয়েছে।

তালেবানের বক্তব্য, নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত হলে সাংবাদিকদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আফগানিস্তানে কর্মরত আফগান সাংবাদিকদের পাশাপাশি পাকিস্তানি সাংবাদিকদেরও ওই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে, বিশ বছর আগে আমাকে কাবুলে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পাকিস্তানি সাংবাদিকদের জায়গায় জায়গায় আটকানো হতো এবং ফিরে যাওয়ার জন্য বলা হতো। তালেবানের উচিত, নিজেদের ডালপালাকে উন্নত ও উত্তম বানাতে মিডিয়াকে স্বাধীন করে দেয়া। আগামী দিনগুলোতে গুজব আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। গুজবের বিরুদ্ধে উত্তম ভ্যাকসিন হচ্ছে স্বাধীন মিডিয়া। আজকের তালেবান আফগানিস্তানের অনেক সমস্যার সমাধানের জন্য এই ভ্যাকসিনের সাহায্য নিতে পারে। এই ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া বা সাময়িক অস্বস্তিতে তাদের ঘাবড়ানো ঠিক হবে না।

ডয়চে ভেলে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা নবনির্মিত ওয়ামি কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যুদ্ধবিরতির মার্কিন চেষ্টার মধ্যে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসাকর্মী নিহত অস্বস্তিতে ক্রেতারা : কমিয়ে দিতে হচ্ছে কেনাকাটা গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪৪ হাজার ছাড়াল আমরা মানুষের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে সম্মান করি

সকল