২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কারাগারের রোজনামচা

কারাগারের রোজনামচা - ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেলখানার ডায়েরি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রথম দিকে তিনি জেলখানার কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। এরপর বলেছেন ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন ‘৬ দফা দিবস’ পালনের প্রেক্ষাপট এবং তারপরে সে দিনের ঘটনা। আমরা প্রাসঙ্গিক হিসেবে ’৬৬ সালের ২ থেকে ৬ জুনের কিছু ঘটনা বঙ্গবন্ধুর এ ডায়েরি থেকে হুবহু তুলে ধরছি।

08 (1)

২রা জুন ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য। অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন! পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?

এদিকে কয়েদি ডিআইজি যথা জেল সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব আজ সেল এরিয়ায় আসবে। সিপাই জমাদার সকলেই ব্যস্ত। আমাকে সেল এরিয়ায়ই রাখা হয়েছে। এখানে আমার ঘরটা ছাড়া সবই সেল। এখানে অনেক একরারী এবং সাংঘাতিক প্রকৃতির কয়েদি আছে। যারা একবার জেল থেকে পালিয়েছিল অথবা পালাবার চেষ্টা করেছিল, তাদের এই এরিয়ায় রাখা হয়। ডিআইজি সাহেব এক এক সপ্তাহে এক এক দিক পরিদর্শন করেন। কারো কোনো অসুবিধা হলে, কাকেও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করলে, তার কাছে অভিযোগ করা যেতে পারে। কারো কোনো দুঃখ থাকলে তাও বলা যায়। যদি কোনো জেল কর্মচারী কোনো কয়েদির উপর অত্যাচার করে তাহলে তারাও নালিশ করতে পারে। তা ছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে কিনা তাও দেখেন তিনি। আজ সেল এরিয়ায় তিনি আসবেন। আমি জেলে আসার পর জেল আইজি সাহেব যখন এসেছিলেন তাঁর সাথে এসেছিলেন। আর একদিন রাত্রে যেদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তিনি নিজেই সিভিল সার্জন সাহেবের সাথে দেখতে এসেছিলেন আমাকে, তখন রাত ১০টা।

আজ জেল সুপার পরিদর্শন করতে আসবেন, তাই হৈ চৈ পড়ে গেছে। চুনা লাগাতে লাগল। পায়খানা পরিষ্কার করতে শুরু করল কয়েদিরা। সাজ সাজ রব। আমার মেট ও কয়েদিরা ঘরটাকে পরিষ্কার করল। রোজই কিছু কিছু করে। তবে আজ আলাদাভাবে। যদি কোনো আবর্জনা থাকে তবে মেট ও কয়েদিদের দণ্ড দেওয়া হয়। জেলের মধ্যে কয়েদির দণ্ড সবচেয়ে দুঃখের। এতে যে দিনগুলোতে কাজ করে মার্কা পায় সেগুলো কেটে দেওয়ার ক্ষমতা জেল কর্তৃপক্ষের আছে।

শুনলাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। নাম কেউ বলতে পারে না বা বলতে পারলেও বলবে না। খবরের কাগজে কারো কারো নাম উঠবে। একই জেলে থেকেও কারো সাথে কারো দেখা হওয়া তো দূরের কথা, খবরও পাওয়ার সাধ্য নাই নতুন লোকের পক্ষে। তবে আমি পুরানা লোক-বহুবার এই জেলে অতিথি হয়েছি। এই জেলের সকলেই আমাকে জানে। নিশ্চয়ই বের করে নেব।

ডিআইজি সাহেব জেলের ডেপুটি জেলারসহ সকলকে নিয়ে আসলেন। আমার ঘরেও এলেন, একটু বসলেনও। জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন আছেন? বললাম শরীর অনেকটা ভালো, কোনো অসুবিধা নাই। কারণ, বলে কোনো লাভ নাই যে, আমাকে কেন আলাদা করে একাকী রেখেছেন? গোয়েন্দা বিভাগ নাকি আদেশ করেছে।

ভবিষ্যতে দরকার হলে কেউই স্বীকার করবে না, সে আমি জানি। যা হোক, তারপর তিনি উঠে গেলেন। আমি আমার জায়গায় বসে রইলাম। চিন্তা একই, কে কে এল!

আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহসম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন। দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে। এত খারাপ সেল ঢাকা জেলে আর নাই। এখানে আমাদের প্রথম রাখা হয়েছিল। আমরা প্রতিবাদ করে ওখান থেকে চলে আসি। বাতাস ঐ সেলে ভুল করেও ঢোকে না। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বললাম। শুনলাম মোমিন সাহেব ডিআইজি সাহেবকে বলেছেন।

মোস্তফা সরোয়ারের ব্যবসার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। পাটের ব্যবসা, একদিন না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। খুব আঘাত পেলাম। এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধরতে পারলে কাউকে ছাড়বে না। মীজান ফিরে এসেছে এই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতে ঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুছা সাহেব বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়তো, পূর্বে কোনো দিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।

কোনোমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে! কাগজ এল। বহুদিনের গোলমালের পরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আপোষ হয়ে গেছে। বন্ধুভাবে বসবাস করার কথা যুক্তভাবে ঘোষণাও করেছে।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ই জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি!

এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মিঃ মশিয়ুর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমন কি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে। জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজদেরকে চীনপন্থী বলেও থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।

মওলানা সাহেবকে আমি জানি, কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমনকি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাকে নিষেধও করেছিলেন। মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন।

আমার চেয়ে কেউ তাকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।

বিকাল হয়ে গেল। কাগজ রেখে উঠে পড়লাম। একটু পরে দরজা বন্ধ করতে এল। ঘরে ঢুকে বই পড়তে শুরু করলাম। কাজ তো একটাই। খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়া।

ভোর দুইটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এক পাগল ক্ষেপে গিয়েছে। খুব জোরে চিৎকার করছে আর গালাগালি করছে। সন্ধ্যার সময় এক পাগল চিৎকার করছিল, তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে অনুরোধ করায় তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। জেল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ কি? কখন কোন পাগল ক্ষেপে উঠে বুঝবে কেমন করে? আর কি ঘুম হয়! বৃষ্টি হয়েছে, বেশ ঠাণ্ডাও পড়েছে।

৩রা জুন ১৯৬৬ ॥
শুক্রবার ঘুমে যখন আর পড়তে পারি নাই তখন তালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়লাম। দেখি জমাদার সাহেব লুঙ্গি পরা দুইজন লোক নিয়ে পুরানা বিশ সেলের দিকে যাচ্ছেন। বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতা মাথায়, বুঝলাম আরো কিছু আমদানি হয়েছে। জেলে নতুন কয়েদি এলে ‘আমদানি’ বলে, আর চলে গেলে ‘খরচ’ বলে। আমার বারান্দা থেকে দেখা যায় পুরানা বিশ সেলে দুইজনকে রেখে জমাদার সাহেব ফিরে চলেছেন। বললাম, বোধ হয় রাতে ঘুমাতে পারেন নাই? সোজাভাবে জিজ্ঞাসা করলে বলবে না। বলল, আপনার জন্য কি আর শান্তিতে জেলের চাকরি করতে পারব! রাত দুইটা থেকে এই একই অবস্থা। একে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। জেলের কয়েদিরা দুনিয়ার খবর রাখে। বৃষ্টি থেমে গেলে খবর পেলাম দুইজন এসেছে ১০ সেলে। ‘এই দুইজনও শেখ সাহেবের দলের’-কয়েদিরা বলাবলি করতে থাকে। নাম কি করে জানবো? পরে খবর পাওয়া গেল, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হক সাহেব, আর একজন আওয়ামী লীগের সদস্য নন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন জীবন ভরে, নাম আবদুল মাজেদ সরদার। পুরান ঢাকার নাম করা সরদার। বেলা ১২টার সময় তাকে আবার মুক্তি দেওয়া হলো। কারণ বুঝতে কারো বাকি থাকে না!

আজ আর লেখাপড়ায় মন দিতে পারছি না। কি হবে বাইরে, কর্মীদের কি অবস্থা, অত্যাচার ও গ্রেপ্তার সমানে চলছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর। দিন ভরই ছটফট করতে লাগলাম, কাগজ পাব কখন? একটা বেজে গেল, দুইটাও বেজে গেল, মনে মনে ভীষণ রাগ হলাম। জমাদার সাহেবকে খবর দিলাম। বললাম, কাগজ এখনো আসে নাই কেন? ভীষণ অন্যায় কথা। সকালে কাগজ আসে, আর এখন আড়াইটা প্রায় বাজে। তিনি জেল অফিসে চলে গেলেন। খবর নিয়ে এসে বললেন, ডিপুটি সাহেবের সই হয় নাই। দস্তখত না হওয়া পর্যন্ত কাগজ জেলের ভিতর আসে না, এখানেও সেন্সর হয়। তিনটার সময় কাগজ এল। অর্ধেক কাগজ কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পড়ার উপায় নাই। যারা যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের নামও ঢেকে দিয়েছে। শুধু ইত্তেফাক নয়, আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার কাগজেও। কালি দিয়ে দিয়েছে, অথচ জেল কর্তৃপক্ষের সেন্সর করার কোনো অধিকার নাই। জেলের মধ্যে কোনো ঘটনা বা কোনো আসামি পালাইয়া গেলে, কেউ অনশন করলে কালি দিয়ে বন্ধ করে থাকেন, কিন্তু অন্য কিছু করা তাদের উচিত না। আমি জেলার সাহেব ও ডিপুটি সাহেবকে খবর দিলাম এর প্রতিবাদ করার জন্য। কাগজ দিতে যদি না চান, মানা করে দেন, কিন্তু কাগজ নষ্ট করবেন কেন!

শুনলাম জেলার সাহেব অসুস্থ, অফিসে আসেন নাই। ডিপুটি সাহেব পরে আসবেন। বিকাল বেলা যে একটু হাঁটাহাঁটি করতাম তাও আজ করতে পারলাম না। কারণ আমার সহকর্মীদের যে অবস্থায় রেখেছে-তাদের ডিভিশনও দেওয়া হয় নাই। আমার বুঝতে বাকি রইল না। আমার যখন তিন দিন পরে ডিভিশন আসে, তখন এদের কথা তো ঢাকার নতুন ডিসি সাহেবের মনেই না থাকবার কথা। কারণ তাকে মোনায়েম খাঁ সাহেব ময়মনসিংহ থেকে বদলি করে এনেছেন। তার ‘কীর্তি’ অনেকেরই জানা আছে। আর আশা করি মনেও থাকবে। পাপ কোনো দিন চাপা থাকে না।

হায়রে দেশ! হায়রে রাজনীতি! লুমুম্বার হত্যার পিছনে যারা ছিল তারাই আজ ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিল। কঙ্গোর একজন প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন সাবেক মন্ত্রীর প্রকাশ্য জায়গায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। কঙ্গোতে সাম্রাজ্যবাদের দাবা খেলা এখনো চলছে।

জেনারেল মোবুতু যে পথ বেছে নিয়েছে সে পথ বড় কণ্টকাকীর্ণ। রক্তের পরিবর্তে রক্তই দিতে হয়। একথা ভুললে ভুল হবে। মতের বা পথের মিল না হতে পারে, তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধ দলের বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ বড় ভয়াবহ রাস্তা। এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে।

শরীরটা ভাল লাগছে না। সেল এরিয়ার সবই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন আমাকে বন্ধ করা হবে। দরজা বন্ধ হলো, কিছু সময় বসে রইলাম চুপ করে। মেটের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যাই খেতে গেলে, “স্যার আর একটু নেন, একটু মাছ, একটু তরকারী।” বেচারা আমাকে খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। “এতবড় শরীর আধা পোয়া চালের ভাত খাবেন না, তাহলে বাঁচবেন কেমন করে?” শুধু ভাবি, তোমাদের এই স্নেহের প্রতিদান কি করে দিতে পারব?

আমার বাবুর্চি একটু চালাক চতুর ছেলে, কেরামত নাম। বলে, “স্যার আপনি তো জানেন না- যেখানে দুইশত তিনশত কয়েদি থাকে তারা নামাজ পড়ে আপনাকে দোয়া করে। তারা বলে, আপনি ক্ষমতায় থাকলে তাদের আর চিন্তা থাকতো না।” দুঃখ হয়, এদের কোনো কাজেই বোধ হয় আমি লাগব না। অনেক গল্প শুনলাম- কয়েদিরা কি বলে সে সম্পর্কে। তবে একথা সত্য, যখন আমি জেল অফিসে যাই তখন কয়েদিদের সাথে দেখা হলে, জেল অফিসারদের সামনেই আমাকে সালাম দিতে থাকে। যারা দূরে থাকে তারাও এগিয়ে আসে। বুড়া বুড়া দু’একজন বলেই ফেলে, বাবা, আপনাকে আমরা দোয়া করি।

খেতে যে পারি না, তার বিশেষ কারণ জেলের পাক। কয়েদিরা পাকায়- ভালই লাগে না। তবুও খেতে হবে, তবুও বাঁচতে হবে। যারা এই দুই দিনে জেলে এসেছে, তাদের ডিভিশন দেয় নাই, কিভাবে কোথায় রেখেছে- জানার উপায় নাই।

ঠাণ্ডা ছিল, বৃষ্টি হয়েছে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যদি জেলের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটাতে পারতাম তা হলে কত ভালই না হতো!

৪ঠা জুন ১৯৬৬ ॥
শনিবার সকালে বাইরে বসে আছি। একজন লোক, ঝাড়দফায় কাজ করত, অসুস্থ হয়ে জেল হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে এসেই আমার কাছে এল। এসে বললো, “আমাকে আপনি ছেড়ে দেন, আপনি বললেই জেল থেকে বের করে দিবে।” আমি বললাম, “আমি তো তোমার মতো একজন কয়েদি, আমার ক্ষমতা থাকলে আমিই বা জেলে আসব কেন?” সে বলে : “আপনি কলম মাইরা দিলেই কাজ হয়ে যায়।” বললাম, “কলম আছে, কিন্তু মাইরা দিবার ক্ষমতা নাই।” সে কি শোনে, তাকে ছাড়াতেই হবে? সে। আমাকে বলে, “আমি ১৪/১৫ বৎসর জেল খাটলাম, আমাকে ছাড়ছে না।”

জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ৫/৬ বৎসর খেটেছে। মাথা একটু খারাপ আছে। প্রথমে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, পরে বিশ বৎসর সাজা দেওয়া হয়েছে। বাবা ছোটকালে মারা গেছে। মা জেলে আসবার পরে মারা গেছে। দিনভর নামাজ পড়ে, আর সকলকে দোয়া করে। সকলেই ওকে ক্ষেপায়, কিন্তু ও ক্ষেপে না, আস্তে আস্তে কথাগুলি বলে। সাজা কত খেটেছে সেটা ঠিকমতো উঠায় নাই। সময় পেলেই আমার কাছে আসে, আর ঐ এক কথা। পরে বুঝলাম অন্যান্য কয়েদিরা ওকে ফুসলায়, সাহেবকে ধর, ভাল করে ধর, খালাস হয়ে যাবি। শুধু কি কয়েদিরা, সিপাই, জমাদারও ওকে বলে, যাও শীঘ্র ঐ সাহেবের (আমার) কাছে, কাজ হয়ে যাবে। আর যায় কোথায়! এসে হাজির! ওকে আর বুঝাইয়া লাভ নাই কারণ ও বুঝবে না।

আজ বাবুর্চিকে বললাম, “আমিই পাকাব, তুমি সব ব্যবস্থা করে আমাকে ডাক দিও।” পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হতেছে। ঘরেই থাকতে হবে। বাইরে যাওয়ার উপায়ও নাই। রোজই কিছু কিছু লোক ধরে আনছে। ঢাকা শহরের বাসিন্দাই বেশি-হরতাল বানচাল করার জন্য।

৯টার সময় বাবুর্চি এল আমাকে ডাকতে। গেলাম পাকের ঘরে, বসলাম চেয়ার নিয়ে। যদিও বাইরে কোনো দিন পাক করার সময় আমি পাই না। আর প্রয়োজনও কোনো দিন হয় নাই। তবু জেলে এসে যখন একা থাকতাম তখন পাক করতাম। সময় তো কাটানো যায়। ডাল আগেই পাকাইয়াছে। পটল ভাজি করলাম। ইলিশ মাছ পাক করলাম। নিজেই পাক করেছি, সে জন্য মন্দ লাগল না।

খবরের কাগজ এসে গেল- দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম, এদেশ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য এরা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে! জাতীয় পরিষদে, সরকারী গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল আনা হয়েছে। কেউ সমালোচনামূলক যে কোনো কথা বলুন না- কেন মামলা দায়ের হবে। ডিপিআর তো আছেই, সিকিউরিটি অব পাকিস্তান আইন তো আছেই। এ ছাড়া ১২৪ ধারাও আছে।

বক্তৃতা করার জন্য, ১২৪ ধারা ৭(৩) (ইস্ট পাকিস্তান স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স) এবং ডি পি আর রুল দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মোটমাট পাঁচটি মামলা আর অন্যান্য আরো তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

প্রফেসর ইউসুফ আলী ভাল বক্তৃতাই করেছেন। বক্তৃতা করলে কি হবে, কে কার কথা শোনে! সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় ডিপিআর দিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। তাসখন্দে শান্তি চুক্তি করে এসে আরো অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। নিশ্চয়ই এই আইনও তারা ব্যবহার করবে বিরুদ্ধ দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ দেশকে তারা কোথায় নিতে চায় বুঝতে আর বাকি নাই। যে কোনো বক্তৃতা বা বিবৃতিকে সরকার অপব্যাখ্যা করে মামলা দায়ের করতে পারে।

ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোনো সংবাদ ছাপাতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছু দিন পূর্বে আরো হুকুম দিয়েছিল, ‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করেছে এটা লিখতে পারবা না।

ছাত্রদের কোনো নিউজ ছাপাতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারবা না।’ ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! আমরা তো লজ্জায় মরে যাই। দুনিয়া বোধ হয় হাসে আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেখে! যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে? যারা আজও বুঝছে না, জীবনেও বুঝবে না।

আমার ভয় হচ্ছে এরা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির দিকে নিয়ে যেতেছে। আমরা এ পথে বিশ্বাস করি না। আর এ পথে দেশে মুক্তিও আসতে পারে না। কিন্তু সরকারের এই নির্যাতনমূলক পন্থার জন্য এ দেশের রাজনীতি ‘মাটির তলে’ চলে যাবে। আমরা যারা গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চাই, আমাদের পথ বন্ধ হতে চলেছে। এর ফল যে দেশের পক্ষে কি অশুভ হবে তা ভাবলেও শিহরিয়া উঠতে হয়! কথায় আছে, অন্যের জন্য গর্ত করলে, নিজেই সেই গর্তে পড়ে মরতে হয়।

বড় সুখের খবর, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রুশরা সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। রুশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব কায়েম হউক এটাই আজ সাধারণ মানুষের কামনা।

ইন্দোনেশিয়া দুনিয়াকে বেশ খেলা দেখাল। সে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে রেজিস্ট্রি করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। প্রায়ই পাকিস্তানের আপন মার পেটের ভাই।

বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই, বাইরে পড়তে সময় পাই নাই। যা হোক আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র তরুণ কর্মীরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেপ্তারের পরও ভেঙে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে। রাজনৈতিক কর্মীদের জেল খাটতে কষ্ট হয় না যদি বাইরে আন্দোলন থাকে।

আজাদ কাগজ দেখে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। প্রথম লিখেছে, উজিরসভা হইতে জনাব ভুট্টোর পদত্যাগ আসন্ন। মোটেই আশ্চর্য হলাম না-যখন চিন্তা করলাম। এটাই তো স্বাভাবিক। ডিকটেটররা যখন দরকার হয় খুব ব্যবহার করে, আর যখন দরকার ফুরিয়ে যায়, ছেঁড়া কাপড়ের মতো ফেলে দেয়। ছেঁড়া কাপড় তো অনেক সময় দরকারে লাগে, স্বৈরশাসকদের সে দরকারও হয় না। একদম বিদায়। টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা নাই।

প্রায় তিনটার সময় বিজলি পাখা খারাপ হয়ে গেছে। মাঝে বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু গরম যায় না। অনেক খবর দিলাম, জেল অফিসে। সন্ধ্যার সময় এসে ঠিক করে দিয়ে গেল। বিকাল বেলা পাকের ঘরে যেয়ে মুরগি পাক করে নিয়ে এলাম। বেশি ভাল হয় নাই, কারণ মশলা ঠিক করে দিতে পারি নাই।

সন্ধ্যা হয়ে এল। একটু পরে ভিতরে যেতে হবে। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। রুমে বসে লেখাপড়া করা ছাড়া উপায় কি! তাই পড়লাম বইটা নিয়ে। পরে আপন মনে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলাম। মনে পড়ল আমার বৃদ্ধ বাবা-মার কথা। বেরিয়ে কি তাদের দেখতে পাব? তাঁদের শরীরও ভাল না। বাবা বুড়া হয়ে গেছেন। তাঁদের পক্ষে আমাকে দেখতে আসা খুবই কষ্টকর। খোদার কাছে শুধু বললাম, “খোদা তুমি তাদের বাঁচিয়ে রেখ, সুস্থ রেখ।”

৫ই জুন ১৯৬৬ ॥ রবিবার
ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেয়ে বসলাম। জমাদার এসেছেন। শুনলাম পাগলদের গোসল করান হচ্ছে, একটু এগিয়ে যেয়ে দেখি সব উলঙ্গ। এক একজনকে ধরে এনে এনে চৌবাচ্চার ভিতরে ঠেসে ধরছে। ভাল করে গোসল করায় ওদের। কতকাল যে ওরা এভাবে পড়ে আছে আর কতকাল থাকবে কে জানে! মাঝে মাঝে ভাল হয়, আবার মাঝে মধ্যে খারাপ হয় এবং পাগলামি করে। এদের কেহ আপনজনকে খুন করে এসেছে, কেহ বা পাগল হয়ে খুন করেছে। কেহ বা বাইরে পাগল হয়ে গেছে, পরিবারের লোকেরা সামলাতে না পেরে জেলখানায় দিয়ে গেছে। একবার জেলে এলে খুব কম লোকই ভাল হয়েছে। দুই একজন ভাল হলেও তাদের ছাড়তে এত দেরি করে ফেলে যে আবারও পাগল হয়ে যায়। এ খবরও আমি পেয়েছি। দুই একজন ভাল হয়ে বাইরেও চলে গিয়াছে, তবে বেশির ভাগ আজিমপুর কবরস্থানেই যেয়ে থাকে। একবার জেলের গল্প করতে করতে আমার একমাত্র সহধর্মিণীকে বলেছিলাম, “যদি কোনো দিন পাগল হয়ে যাই তবে পাগলা গারদে বা জেলের পাগলখানায় আমাকে দিও না।”

ফণীকে ডেকে আনলাম। ফণীও কিছুদিন পাগল ছিল এখন ভাল হয়েছে। গান মন্দ গাইতে পারে না। বললাম, ফণী বাবু গান গাও। সে দেহতত্ত্ব, মারফতী, কীর্তন মন্দ গায় না। দেশে দেশে গান গেয়ে বেড়াত। যখন সে গান গায় মনে হয় কোথায় যেন চলে গিয়াছে আর এ দুনিয়ায় নাই। একটার পর একটা গান গেয়ে চলে। কত গান যে সে জানে তার কোনো ঠিক নাই। অফুরন্ত ভাণ্ডার। আজকাল রোজই তার গান শুনি। কারণ আমি যেখানে থাকি। সেখানে সে ঝাড় দফায় কাজ করে।

জমাদার ও সিপাহি সাহেবরাও তার গান শোনে। সকলেই ওকে স্নেহ করে, কারণ সরল লোক। মনে আর মুখে একই কথা। এ সমস্ত গান আমি যখন ছোট ছিলাম অনেক শুনেছি। জেলের মধ্যে এমন গান খুব ভালই লাগে। ওর তো কাজ আছে আমার তো কাজ নাই। ওকে ছেড়ে দিতে হলো। ঘরে এসে আবার সংশপ্তক বইয়ের মধ্যে নিজকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম।

আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে গরমও পড়ে। পাখা খারাপ হয়ে গেছে খবর দিয়েছি মিস্ত্রি পাঠাতে। দিনভর বৃষ্টি। আজ আবার ন্যাপের জনসভা। সভাটি হওয়া প্রয়োজন। বহুদিন পরে এরা মিটিং করছে। মওলানা ভাসানী সাহেবের ভুল নীতির জন্য এই দলটি জনসমর্থন যা কিছু ছিল তাও হারাইয়া ফেলেছে দিন দিন।

আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে। আরো আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবি দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে, গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে, তাদের দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলান হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।

আমার মনে হয় মোনায়েম খান সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে কোনো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে। তিনি অনেক বড় বড় কথা বলেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বকেই চলেছেন। মানুষের স্মৃতিশক্তি কিছুটা আছে, এত তাড়াতাড়ি তারা ভুলে যায় না। তিনি যখন খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ও নূরুল আমীন সাহেবের সমর্থক ছিলেন তখন ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের কর্মকর্তাও ছিলেন। মুসলিম লীগের নমিনী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য হয়ে করাচীতে গিয়ে প্রত্যেক কাজে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে দাবাইবার জন্য। ময়মনসিংহে গুণ্ডা ভাড়া করে আমাদের কর্মীদের উপর অত্যাচার করেছেন। পূর্ব-বাংলার যে-কোনো আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতেন, সে কথা ভোলেন কি করে? ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াকে আড়াই বৎসর পর্যন্ত জেলে রাখার জন্য তিনিই দায়ী ছিলেন। নূরুল আমীন সাহেব তার কথা মতোই ময়মনসিংহে কাজ করতেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ১১ বৎসরের মধ্যে ৯ বৎসর মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিল। তখন তিনি মুসলিম লীগের সভ্য হয়েও একদিনও পূর্ব বাংলার শোষণের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন নাই। শুধু সমর্থন করেন নাই, ভাতা নিয়ে সমর্থন করেছেন। তিনি যখন ইসলামের নাম করে সত্য কথা না বলে, এমন কি মাথায় কিস্তি টুপি দিয়ে রাজনীতিবিদদের গালাগালি করেন তখন হাসি পায়। বাইরে থাকতেও কোনো দিন এদের কথার উত্তর দিবার প্রবৃত্তি আমার হয় নাই। কারণ আমি জানি এদের চাকরি আইয়ুব খান সাহেবের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাকে খুশি রাখলে সব ঠিক, জনমতের এরা কি ধার ধারে?

খবরের কাগজ এল। পাকিস্তান অবজারভার দেখে ভাবলাম বোধ হয় খবর একটু এরা ছাপে আজকাল। আমি নিজে অবজারভার সকল সময়ই পড়ি। একবার কয়েক দিনের জন্য রাগ হয়ে বন্ধ করেছিলাম বাইরে থাকতে। আবার নিলাম, কারণ যাহাই হউক না কেন পূর্ব বাংলার কাগজ। মর্নিং নিউজের মতো পশ্চিমা শিল্পপতিদের মুখপাত্র নয় এবং সরকারের অন্ধ সমর্থকও নয়। আজাদ কাগজ সকল সময়ই কিছু কিছু সংবাদ বহন করে। মতের মিল না থাকতে পারে, সংবাদপত্র কেন সংবাদ দিবে না। বিকাল পর্যন্ত কাগজই পড়লাম। এখন একমাত্র চিন্তা কর্মীরা নেতা ছাড়া আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা! আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা, তাদের সাথে আছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা, যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে তারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্রেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই।

বিকাল বেলা বাইরে বসেই চা খেয়ে নিলাম। তারপর স্বাস্থ্যরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। একটু পরেই আবার বৃষ্টি এল। সন্ধ্যার পূর্বে বৃষ্টি বন্ধ হলো। একটু বাইরে যেয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় দেখলাম, হাসপাতাল থেকে কে যেন আমাকে সালাম দিতেছে। অনেক দূরে চেনা যায় না। চোখে চশমা ছিল না। তবে ভাবলাম নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কেহ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসেছে। চশমা আনতে বললাম। চশমা পরে দেখলাম, আরে এ তো আমাদের শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমাকে ইশারা দিয়ে দেখাল, পেটে হাত দিল। বুঝলাম পেটের কোনো যন্ত্রণা এবং জ্বর হয়েছে। বেচারা আর কোনো দিন জেলে আসে নাই। এই প্রথম জেল তার মধ্যে আবার অসুখ হলে ভেঙে পড়বে। পরের দিন খবর নিলাম অনেকটা ভাল আছে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ঘরে এলাম, তালা বন্ধ হলো। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঘরেই থাকতে হবে। মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কি হবে! তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে।

৬ই জুন ১৯৬৬ ॥ সোমবার
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয় দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাঁধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন, এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও, বোঝেন না।

ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়, আবার বাইরে। যাই-কেবল একই চিন্তা! এইভাবে সারা সকালটা কেটে গেল। খাওয়া-দাওয়া কোনো দিকেই আমার নজর নাই। ভালও লাগছে না কিছুই। যা হোক দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজগুলি এল।

ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। যশোর আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভূতপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নূরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, শত্রুবিনাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে। ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকেসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করিয়াছে, আর ৬ দফার দাবিকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছে।

৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তি দাবি করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথ সভা করে চলেছে। মশাল শোভাযাত্রাও বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও তারা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।

গভর্ণর নারায়ণগঞ্জ জনসভায় আবার হুমকি ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করবেন। আইন শৃঙ্খলা আওয়ামী লীগ কোনো দিন ভাঙতে চায় নাই। তারা বিশ্বাসও করে না ঐ রাজনীতিতে। কিন্তু যিনি আইন শৃঙ্খলার মালিক হয়ে আইন শৃঙ্খলা ভাঙতে উস্কানি দিতেছেন তার বিচার কে করবে? যার সরকার বেআইনি এবং অন্যায়ভাবে কর্মীদের হয়রানি করছেন, গ্রেপ্তার করছেন তার বিচার কবে হবে? মোনায়েম খান সাহেবের জানা উচিত ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকবার জেলে গেছেন, মিথ্যা মামলার আসামিও হয়েছেন। পূর্বের সরকার এবং মুখপাত্ররা এ রকম হুমকি অনেকবার দিয়েছেন।

সরকার কর্মীদের বন্দি করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এমপিএ, হাফেজ মুছা সাহেব, আবদুল মোমিন এডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতৃবৃন্দকে ‘সি’ ক্লাস করে রাখা হয়েছে। কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে আমি ভেবেও পাই না!

আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাতে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক এক জনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনো দিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।

বিকালে বাগানে কাজ করতে শুরু করলাম। সময় তো আমার কাটে না। আলাপ করার লোক তো নাই। লাউয়ের দানা লাগাইয়াছিলাম, গাছ হয়েছে। ঝিংগার গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি। বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। আজকাল সকলেই প্রশংসা করে। নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের গাছগুলি।


আরো সংবাদ



premium cement
গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় নয়া সঙ্কট নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর দাবি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট শিডিউল ঘোষণা করুন : মুজিবুর রহমান পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীসহ নিহত ১১ শতকোটি টাকা নয় শুধু ছেলেকে ফেরত চান শহীদ আমিনের মা কামরুল, মহিববুর, হেনরী ও এস কে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের ৮ মামলা অনুপ্রবেশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের তুমুল বিতর্ক সরকার প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করতে পারছে না : রিজভী ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের রেলওয়ের দরপত্রে অংশগ্রহণের প্রতিবাদ বিদ্যুৎ বিল বাবদ বাংলাদেশের কাছে ২০০ কোটি টাকা চায় ত্রিপুরা শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে হাসান আরিফের দাফন

সকল