২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দুর্ভিক্ষ আসন্ন!

দুর্ভিক্ষ আসন্ন! - ফাইল ছবি

বিগত ৯ ও ১০ এপ্রিল বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার খবরে জানা গেল, বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় মানুষ বাবুই পাখির ওপর চড়াও হয়েছে, বিশেষ করে শিশু বাবুইয়ের ওপর। তারা বাবুই পাখির বাসাগুলো বাঁশের আগায় মশাল জ্বালিয়ে তালগাছের পাতার সাথে যেখানে ঝুলে আছে সেখানটা পুড়িয়ে নামিয়ে এনে পানিতে ফেলে ফেলে পাখিগুলোকে মেরেছে; মেরেছে পুড়িয়ে পুড়িয়ে। এভাবে শত শত বাবুই শিশু হত্যা করেছে। কী অপরাধ বাবুই শিশুর! ওরা নাকি তাদের ক্ষেতের ধান খেয়েছে, কী প্রমাণ আছে বাবুই শিশুরা ধান ক্ষেতের ধান খেয়েছে? কিংবা তাদের মা ধান এনে খাইয়েছে? একটি ধানও কি পাওয়া গেছে ওই সব শিশুর পাকস্থলীতে? কেউ কোনো দিন তা প্রমাণ করতে পারবে?

বাবুই পাখির জীবনবৃত্তান্তের ওপর গবেষণা করে আমরা জেনেছি, বাবুই বর্ষার আগমনে প্রজনন করে, যখন হঠাৎ এক-দুই পশলা বৃষ্টির সাথে সাথে প্রকৃতিতে নানা রকম পোকার আধিক্য দেখা দেয়, আধিক্য দেখা দেয় পোকার শুককীট-মুককীটের। বাবুই শিশুর মা এসব শুককীট-মুককীট ধরে এনে তার শিশুদের খাওয়ায় এবং নিজেও খায়। এভাবে ওরা কৃষকের ক্ষেতের ফসল রক্ষায় অপরিমেয় অবদান রাখে। এ সময়টায় এসব পাখি যদি পোকা দমনে ব্যাপৃত থেকে ক্ষেতের ফসল রক্ষায় তৎপর না থাকত তা হলে কৃষকের ফসল আর ঘরে তোলা সম্ভব হতো না। হ্যাঁ, বাবুই পাখি কিছু ধান খায় বটে। তবে তা এ সময় নয়। ফসল কাটার সময়ের আগেও তেমন নয়, কাটার পরে। বাবুই শিশুর মা তার ছানাদের সব দায়িত্ব পালন করে এবং শিশুর জন্মের পর উড়তে শেখা পর্যন্ত আমিষ খাদ্য অর্থাৎ দলাদলা পোকার শুককীট -মুককীট খাওয়ায় তার শিশুর যথাযথ বৃদ্ধির জন্য। অন্যদিকে মা বাবুই পাখি ধান খেতে হলে ধানের খোসা ছাড়াতে হয় (husking)। তার সে সময় কোথায়? তাছাড়া মায়েরও এ কঠিন পরিশ্রমের সময় আমিষ খাদ্যের প্রয়োজন অনেক, আর পোকারও প্রাচুর্য অনেক। বাবুইদের মা একাই শিশুর লালন পালনের দায়িত্ব পালন করে থাকে। বাবারা এ দায়িত্ব পালন করে না। বাবা বাবুই একজন ‘স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার’। স্থাপত্যশিল্পে পটু। তার শিল্পে সে এতটাই পাণ্ডিত্যপূর্ণ যে,

পুরুষ বাবুই পাখির কাজ হলো- বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বা শ্রেষ্ঠতম কারিগরি ক্ষমতা ব্যবহার করে অপূর্ব কীর্তিস্বরূপ বাসাটি নিখুঁত করে তৈরি করা; পৃথিবীর অন্য কোনো পাখি, প্রাণী, এমনকি মানুষের পক্ষে কখনো যা সম্ভব নয়। বাসাটি যখন তৈরি হয়ে যায় অর্থাৎ egg chamber তৈরি হয়ে গেল, বাকি শুধু entrance tube, তখন সে মনের আনন্দে নাচতে থাকে তার অপূর্ব হলুদ রঙের আকর্ষণীয় চেহারা নিয়ে স্ত্রী পাখির আগমনের জন্য। স্ত্রী বাবুইদের আছে এক উচ্চমানের ব্যক্তিত্ব, personality। বাসাটির বুনন কতটা সুন্দর ও পোক্ত তা ঠোঁট দিয়ে টেনে টেনে পরখ করে দেখে তারা।

পছন্দ হলে ওই বাসায় থেকে যায়, নইলে উড়ে যায় অন্য বাসার খোঁজে। পছন্দ না হলে পুরুষ পাখিটি বাধ্য হয় আরেকটি বাসা তৈরি করতে। অতএব পুরুষ পাখিদের সময় নেই ধান খাওয়ার। প্রচুর পোকা খেতে হয় কঠিন পরিশ্রমের রসদ হিসেবে, আমিষ খাবার। কেননা পুরুষ পাখি বার্ষিক প্রজননকালে তিন থেকে চারটি বাসা তৈরি করে থাকে এবং তিন থেকে চারটি স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়। আসি স্ত্রী পাখিটির কথায়। স্ত্রী পাখিটির বাসা পছন্দ হলে সে পুরুষটিকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে এবং বাসার ভেতরটা পরিপাটি করে প্রস্তুত করে নরম বস্তু তথা পালক, নরম ঘাস, তুলা প্রভৃতি দিয়ে যা পুরুষ পাখিটি এনে দেয়। স্ত্রী পাখিটি Interior designer হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং করে চূড়ান্ত আরামদায়ক করে তোলে বাসার ভেতরটা যার ফলে ডিম ও ছানারা আরাম পায়। বাসার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পুরুষ পাখিটি কিছু কাদামাটিও এনে দেয় যেন বাসাটি বাতাসে খুব বেশি না দোলে। এরপর পুরুষ পাখি বাসাটির entrance tube তৈরি করে দিয়ে বিদায় নেয়। পুরুষ পাখিটি একই মওসুমে একটার পর একটা, তিন থেকে চারটি বাসা বানিয়ে থাকে। এভাবে তিন থেকে চারটি বাসা বানায় এবং তিন-চার স্ত্রীর তিন থেকে চারটি করে ছানা, অর্থাৎ ৯ থেকে ১২টি বাচ্চার বাবার দায়িত্ব পালন করে মজবুত সুন্দর মনোরম বাসাগুলো বানিয়ে দিয়ে। অতএব ধান ছিলে খাবে কখন? বেশির ভাগই পোকা খায়। এ সময়ের শেষ দিকে কৃষকের যখন ধান কাটার সময় প্রায় শেষ তখন বাবুই ধান ক্ষেতে আসার সুযোগ পায় এবং বেশির ভাগ সময়ে ক্ষেতে পড়ে থাকা ধান খায়, পাকা ধানের ছড়াগুলো থেকে শুধুই পোকা ও পোকার শুককীট-মুককীট ধরে খায় এবং শিশুদের খাওয়ায়। বাহ্যিকভাবে দেখে মনে হয়, যেন ধান খায়।

এসব পাখির প্রতি অমানবিক অনাচারের জন্য, বাবুই ছানা পোড়ানোর জন্য, যারা দায়ী তারা হত্যাকারী, খুনি। তাদের অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়। এসব দুষ্কৃতকারী দেশে তথা প্রকৃতিতে দুর্ভিক্ষ নিয়ে আসছে। এর একটি উদাহরণ এখানে রইল-

১৯৫৮ সাল। ঘটনাটি চীনের। চড়ুই পাখি ফসলের ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি করে ভেবে চীনের নেতা মাও সে তুং নির্দেশ দিলেন দেশের সব চড়ুই নিধন করতে। তারা হিসাব করে দেখেছেন, একটি চড়ুই বছরে চার-পাঁচ কেজি শস্য খায়। প্রতি ১০ লাখ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের খাদ্যের জোগান হবে। তাই শুরু হলো চড়ুই নিধনযজ্ঞ। শুরু হলো চড়ুই নিধনের পক্ষে প্রচারণা। তৈরি হলো লাখো রঙিন পতাকা। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে উঠল গোটা দেশের মানুষ। আকর্ষণীয় পুরস্কার ঘোষণা করা হলো চড়ুই মারার জন্য। নানা পদ্ধতিতে চড়ুই নিধন হতে লাগল; যেমন খুব জোরে জোরে ড্রাম বাজাতেই চড়ুই উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। অসংখ্য ডিম নষ্ট করা হলো। রাতারাতি তছনছ করা হলো বাসা। জাল দিয়ে ধরা হলো লাখ লাখ চড়ুই। বন্দুক দিয়ে মারা হলো অসংখ্য চড়ুই। এমনকি এসব কাজের জন্য তৈরি করা হলো ‘স্প্যারো আর্মি’। এভাবে ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ নামে প্রচারণার মাধ্যমে চড়ুইশূন্য হলো গোটা চীন। চীনদেশ থেকে চড়ুই হলো বিলুপ্ত।

১৯৬১-৬২ সাল। চীনে দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ। না খেয়ে মারা গেল প্রায় তিন কোটি মানুষ। ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর বিভিন্ন পোকার আক্রমণ এতই বেড়ে গেল যে, ক্ষেত থেকে ফসল আর ঘরেই তোলা গেল না। দুর্ভিক্ষে মৃতের মিছিল। টনক নড়ল দেশটির সরকারের। নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিতে চড়ুই পাখি ফিরিয়ে দিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হলো চড়ুই আমদানি।

নিষ্পাপ বাবুই শিশুদের যারা জ্বলন্ত আগুনে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তাদের ক্ষমা নয়। ক্ষমা করা হলে খুনের দায় ক্ষমাকারীর কাঁধেই বর্তাবে। এ অপরাধগুলো ভবিষ্যতেও ঘটবে। বাবুইকে বলা হয় স্থপতি পাখি। স্ত্রী পাখি ইনটেরিয়র ডিজাইনার। প্রকৃতির ইঞ্জিনিয়ারদের হত্যাকারী প্রকৃতি কখনো ক্ষমা করবে না। চড়ুই ও বাবুই একই গোত্রের পাখি। এদের খাদ্যাভ্যাসও এক। উপরন্তু বাবুই পাখির অবস্থান কবি রজনী কান্ত সেনের কাছে আমরা জেনেছি-
‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি’ নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা’।
নিজের একটি বাসা! Home, my sweet home!

লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা নবনির্মিত ওয়ামি কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যুদ্ধবিরতির মার্কিন চেষ্টার মধ্যে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসাকর্মী নিহত অস্বস্তিতে ক্রেতারা : কমিয়ে দিতে হচ্ছে কেনাকাটা গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪৪ হাজার ছাড়াল আমরা মানুষের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে সম্মান করি

সকল