২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পক্ষ-বিপক্ষ এবং চেতনা প্রসঙ্গে

পক্ষ-বিপক্ষ এবং চেতনা প্রসঙ্গে - ফাইল ছবি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে সব শহীদের মাগফিরাতের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে জানাচ্ছি প্রার্থনা। সেই সাথে জাতির এই গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্তে দেশবাসীকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। স্বাধীনতা আমাদের সবার কাছে একটি অত্যন্ত প্রিয় শব্দ। এতে রয়েছে এক অমৃত স্বাদ। এর মূল্য অপরিসীম।

আমরা অনেকেই তাই এটাকে প্রাণের চেয়ে বেশি মূল্যবান বলে থাকি। স্বাধীনতা আমাদের আত্মার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই অমূল্য সম্পদ প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য। এই সম্পদ কখনো হস্তান্তর, স্থানান্তর, বিনিময় বা বিক্রয়যোগ্য নয়। এ কারণে কোনো কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, খর্ব করা বা কেড়ে নেয়ার জন্য সৃষ্টি করে বিদ্বেষ শত্রুতা, কলহ এবং যুদ্ধবিদ্রোহ। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে স্বাধিকার, স্বরাজ, স্বায়ত্তশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বশাসন, সমঅধিকার ইত্যাদি। স্বাধীনতাকামী মানুষ তাই শুধু একখণ্ড মাটি, একটি পতাকা আর একটি জাতীয়সঙ্গীত নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট থাকে না। সে চায় বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার; অন্য দিকে সে চায় দরিদ্রতা, ক্ষুধা, অনাহার, শিক্ষাহীনতা এবং অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি। সে চায় ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। মানবসভ্যতার প্রারম্ভ থেকেই মুক্তিকামী মানুষ বর্ণিত উপাদানগুলো সংবলিত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে সে অকাতরে প্রাণবিসর্জন দিতেও হয়নি পিছপা, কেননা স্বাধীনতার বিকল্প হলো পরাধীনতা, বেড়িবন্ধন, শৃঙ্খলিত দাসত্ব জীবন, যা গৃহপালিত পশু অথবা খাঁচায় আবদ্ধ পশুর জীবনের চেয়েও নিকৃষ্ট। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্গত বর্তমান ভূখণ্ডটি শত শত বছর ধরে ভিনদেশী শাসকদের হাতে হয়েছে শাসিত, পদদলিত এবং লুণ্ঠিত। সোনার বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে হয়েছে অত্যাচারিত, নিপীড়িত। তাই অবশেষে, ২০০ বছর ইংরেজ শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ মাটির মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে বর্ণবাদী, শ্রেণিবাদী ও ভিনদেশীয় সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ করে দেয়। আর তাই ভাষা আন্দোলনে রক্তঝরা দিয়ে শুরু হয় সর্বব্যাপী স্বাধিকার আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। অর্জিত হয় ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা। এই কথা নিশ্চিতভাবে এবং নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অতি নগণ্য এবং ক্ষুদ্র এক অংশ ছাড়া এ দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, দেশের অভ্যন্তরে সব শ্রেণীর, সব বয়সের, সব ধর্মের নারী-পুরুষ যারা মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত হয়েছেন, যুদ্ধে জোগান দিয়েছেন, আতঙ্কিত হয়ে দিনাতিপাত করেছেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য বিরামহীনভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে চোখের পানি ফেলে প্রার্থনা করেছেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আমরা যারা সৌভাগ্যবশত সম্মুখ সমরে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, আমরা তো কেবল শত্রুর বুলেটের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু শত শত অস্ত্রহীন মানুষ যারা আমাদের যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনার জন্য নিদ্রাহীন থেকেও সাহায্য যুগিয়েছেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, গ্রামে গ্রামান্তরে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন, তাদেরকে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ বলে আখ্যায়িত করা এক অমার্জনীয় অন্যায়। এ কলঙ্ক থেকে মুক্তি না পেলে এ জাতি থেকে যাবে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত। প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগোষ্ঠীর একাংশ অতি ক্ষুদ্র হলেও, তাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনা, বিশ্বাস এবং অনেকাংশে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভের বশবর্তী হয়ে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনন্যোপায় হয়েও প্রাণের ভয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে থাকে। এরা সবাই সমান অপরাধী নয়। তবে প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা, হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা প্রযোজ্য। এরই মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত একাধিক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এসব বিচার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার ব্যত্যয় ঘটলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যতে পুনর্বিচারের দ্বার উন্মোচনের সম্ভাবনা রেখে দেবে।

গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আজ যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লগ্নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন নিয়ে গর্বিত, তখন একটি একতাবদ্ধ জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী ও চেতনাবিরোধী বলে বিভক্তিকরণের প্রচেষ্টা দুঃখজনক। অন্য দিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অসংখ্য কালো আইনের মাধ্যমে বিনাবিচারে আটক এবং আটককালীন অবস্থায় মৃত্যু, খুন, লুণ্ঠন, গুম ও দুর্নীতি, সর্বস্তরের সব অপরাধীর জন্য আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে ব্যর্থতা, সরকারি চাকরি, সব ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ কেবল শাসক দলের অনুকম্পায় লালিত গোষ্ঠী ও মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হওয়া, শিক্ষার ক্রমাগত নিম্নমান এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণে আমাদের সব অর্জন ও অগ্রগতি ম্লান হয়ে পড়েছে। এসব অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তিই হচ্ছে স্বাধীনতার বিপক্ষে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি। তাই সমাজের সর্বস্তরে সব শ্রেণীর এবং সব পদে আসীন মানুষের জন্য আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ অপরিহার্য। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা এবং সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফলতা ধরে রাখা এবং এর স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণে এর কোনো বিকল্প নেই। এ দায়িত্ব পালনই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের কাজ এবং সঠিক পথ। আর এর ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরাই হচ্ছে এই চেতনার বিরোধী শক্তি। এ মাটির মানুষ শত শত বছর ধরে পরাধীন হয়ে থাকলেও, তারা বরাবরই ছিল স্বাধীনচেতা ও মুক্তিপাগল।

জাতিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধুয়া তুলে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা বেদনাদায়ক ও আত্মঘাতী। ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী বলে ভুয়া স্লোগান হাস্যকর। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে অন্য যেকোনো দেশের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা দূষণীয় নয়, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহিতার শামিল। জাতিকে বিভক্তিকরণের এ প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে হবে। কেননা এ দেশের সব মানুষই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ বা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বিভক্ত করে রাখা এক অমার্জনীয় অপরাধ। এ মাটির মানুষ কখনো অন্যায় অত্যাচারের কাছে মাথা নত করেনি।

তাদের ধৈর্য অপরিসীম। কিন্তু এই ধৈর্যকে দুর্বলতা বলে বিবেচনা করা হলে সমগ্র জাতিকে, বিশেষ করে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। তাই দেশ পরিচালনায় সম্পৃক্ত সর্বস্তরের সব নেতাকে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং প্রশ্নাতীতভাবে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত। আমাদের মনে রাখা উচিত, সব মানুষই মরণশীল। পূর্বনির্ধারিত এবং সুনির্দিষ্ট মুহূর্তেই সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আর আমাদের ফেলে যাওয়া সব কীর্তি ও কর্ম শুধু ওপারে আমাদের বিচারের এবং ফয়সালার ভিত্তিই হবে না, এপারে আমাদের সবাই মানুষের মনে স্থান পাওয়া হবে মূল চাবিকাঠি। তবু কেন মিথ্যাচার, বল প্রয়োগ, ইতিহাস বিকৃতি, অর্থের প্রতি লালসা, দমন-পীড়ন? শান্তির পথে ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়াই হওয়া উচিত আমাদের কাম্য। বংশধরদের জন্য এটিই হবে আমাদের সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ।

তাই আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লগ্নে সমগ্র জাতির কাছে বিশেষ করে সব ক্ষমতাধর এবং বিত্তবান মানুষের কাছে জানাচ্ছি আকুল আবেদন, এই দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্টার্জিত অর্থ, সম্পদ, উন্নয়নের ফসল আমরা সবাই অনেকখানি ভোগ করেছি। এখন তাদের কাছে ন্যায্য পাওনাটুকু বাস্তবিক অর্থেই ফিরিয়ে দিলেই আমাদের ঋণের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে। জাতির এই শুভলগ্নে খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি হবে আমাদের সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালনকারী ও বিরোধী বলে আজ জাতিকে বিভক্তি করা নয়, জাতিকে একত্র করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের সবার কাম্য ও প্রত্যাশা।

এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অতীতের সব রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় নেতাদের তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি দেয়া একান্ত অপরিহার্য। বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথ বিলুপ্ত হওয়ার আগেই সঠিক কাজটি হবে নিজেকে, পরিবার, সমাজ, সব দল এবং জাতিকে রক্ষা করাই সব নেতার পবিত্র কর্তব্য। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন লগ্নে জাতির কাছে এই প্রতিজ্ঞা করাই হবে অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement