ওয়াক্ফ : কী ও কেন
- মো: রায়হানুল আমীন
- ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ২০:৪৫
ইসলামের আগমনের বহুকাল আগে ওয়াক্ফের প্রচলন শুরু হলেও মূলত ইসলামের হাত ধরেই এর ব্যাপক প্রচলন ও সম্প্রসারণ ঘটে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ওয়াক্ফের কার্যক্রম চালু রেখেছেন। ফলে আর্ত-মানবতার সেবায় এ দেশে ওয়াক্ফভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম ব্যাপক অবদান রাখার পাশাপাশি দিন দিন ওয়াক্ফভিত্তিক কার্যক্রম বাড়ছে।
ইসলাম পূর্বকাল থেকেই আরবসহ বিভিন্ন জাতির মধ্যে ওয়াক্ফবিষয়ক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীনকালে মিসরীয়দের ওয়াক্ফ ছিল উপাসনালয় ও গোরস্থানের নামে জমি বরাদ্দকরণকেন্দ্রিক। এসব জমির মুনাফা থেকে উপাসনালয় ও গোরস্থানের মেরামত, গণকদের খরচ এবং বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের ব্যয়-ভার বহন করা হতো। তৎকালীন মিসরীয়দের মাঝে ‘পারিবারিক ওয়াক্ফ’-এর প্রচলন ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তির মূল অংশ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার অর্থ পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে ব্যয় করা। গ্রিক জাতির মাঝেও ওয়াক্ফের প্রচলন ছিল। হজরত ঈসা আ:-এর জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে ‘সাইমুন’ নামক এক ইহুদি ব্যক্তি গ্রিক দার্শনিক প্লেটোকে তার একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশাল আয়তনের জায়গা ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন। একইভাবে রোমান জাতি এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ প্রাচীন পশ্চিমা জাতিগুলোর মধ্যেও ফ্যামিলি ওয়াক্ফ ও কল্যাণমুখী ওয়াক্ফের প্রচলন ছিল। প্রথম প্রকার ওয়াক্ফের লক্ষ্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অশিক্ষিতদের সাহায্যে ব্যয় করা। দ্বিতীয় প্রকার ওয়াক্ফের লক্ষ্য ছিল ফকির, মিসকিন ও এতিমদের কল্যাণের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যয় করা। এর মধ্যে কিছু ওয়াক্ফ ছিল দীর্ঘ আর কিছু ছিল স্বল্পমেয়াদি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াক্ফ সম্পত্তি বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক, যার পরিমাণ ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার।
আল কুরআনের অনেক আয়াত ওয়াক্ফের বৈধতার প্রমাণ বহন করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘তোমরা যে ধনসম্পদ দান করো, তা তোমাদের নিজেদের জন্য কল্যাণকর। মূলত তোমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই অর্থ ব্যয় করে থাকো। সুতরাং দান-খয়রাত হিসেবে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে এবং এ ক্ষেত্রে তোমাদের ওপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না’ (সূরা বাকারা-২৭২)। ‘যারা দিনে-রাতে গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের ধনসম্পদ (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান এবং তাদের কোনো দুঃখ-ভয় বা দুশ্চিন্তা-পেরেশানি থাকবে না’ (সূরা বাকারা-২৭৪)। ‘আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই তা থেকে দান করো, কেননা (মৃত্যুর সময় এসে পড়লে) সে হয়তো বলবে, ‘হে আমার রব, আমাকে যদি আরেকটু সময় (সুযোগ) দিতেন, তাহলে অবশ্যই আমি দান করতাম এবং নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’ (সূরা মুনাফিকুন-১০)।
মুসলিম সমাজে পাঁচ প্রকারের ওয়াক্ফের প্রচলন দেখা যায় । ১. ওয়াক্ফে আহলি বা পারিবারিক ওয়াক্ফ। এ ধরনের ওয়াক্ফের মুনাফা ওয়াক্ফকারীর পারিবারিক বা বংশীয় কোনো সদস্য কিংবা আত্মীয়স্বজনের নামে ওয়াক্ফ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণত ওয়াক্ফকারী নিজেই ওয়াক্ফের শর্ত নির্ধারণ করে থাকে। একে ওয়াক্ফ আল-আওলাদও বলা হয়।
২. ওয়াক্ফে খাইরি বা কল্যাণমূলক ওয়াক্ফ। এটা এমন ওয়াক্ফ যার মুনাফা বিভিন্ন কল্যাণমুখী প্রকল্প যেমন- মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল, এতিমখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজে ব্যয় করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ যেমন- ফকির, মিসকিন, পঙ্গু, বিধবাসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব অসহায় ও দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণকে সহায়তা প্রদান ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যেও ব্যয় করা হয়। এ ধরনের ওয়াক্ফকে ‘ওয়াক্ফ ফি ছাবিলিল্লাহ’ নামেও অভিহিত করা হয়।
৩. ওয়াক্ফে মুশ্তারাক বা সমন্বিত ওয়াক্ফ। এটি মূলত উল্লিখিত দুই প্রকার ওয়াক্ফের সমন্বিত রূপ। এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। এক. শুরুর পর্যায়ে ওয়াক্ফের মুনাফা নিজ সন্তান-সন্ততি অথবা আত্মীয়স্বজনের কল্যাণে ব্যয় হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ওই মুনাফা কোনো দাতব্য প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হবে। দুই. ওয়াক্ফকৃত সম্পদের একটি অংশ ওয়াক্ফকারীর সন্তান-সন্ততি অথবা আত্মীয়স্বজনের কল্যাণে এবং বাকি অংশ দাতব্য প্রকল্পের কল্যাণে ওয়াক্ফ করা হবে।
৪. ওয়াক্ফ আলাল ওয়াকিফ বা ওয়াকিফ কর্তৃক নিজ নামে ওয়াক্ফ করা । এটি মূলত ওয়াকিফ নিজ নামেই ওয়াক্ফ করে থাকে যা তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং মৃত্যুর পর তার নির্দেশিত খাতেই ব্যবহার করা হয়।
৫. ওয়াক্ফুন নুকুদ বা ক্যাশ ওয়াক্ফ। এটি মূলত নগদ অর্থ বা টাকা-পয়সা ওয়াক্ফ করাকে বলা হয়। ওয়াকিফ কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রেখে তা থেকে অর্জিত মুনাফা বা লভ্যাংশ দিয়ে নিজেই বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে অথবা ওই প্রতিষ্ঠানকে মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত করে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে মুনাফা বা লভ্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে।
ওয়াক্ফ আন্দোলন প্রয়োজন : বাংলাদেশসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটি ওয়াক্ফ আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে ওয়াক্ফ আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। কেননা, ওয়াক্ফ কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমেই মূলত দারিদ্র্যকে ‘জাদুঘরে পাঠানো’ সম্ভব। ইতিহাস এর জাজ্বল্যমান সাক্ষী। সুতরাং বিত্তশালী মুসলমানরা যদি এ আন্দোলনে শরিক হয়ে নিজেদের সম্পদের একটি অংশ সদকায়ে জারিয়াহ হিসেবে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে এবং এর যাবতীয় কার্যক্রমকে সুপরিকল্পিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করে একটি সফল ওয়াক্ফ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব অসহায় ও কপর্দকশূন্য মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর পরকালীন নাজাতের দ্বারও উন্মুক্ত ও অবারিত হয়ে যাবে।
কয়েকটি প্রস্তাব : ১. ‘বাংলাদেশ ওয়াক্ফ আইন-১৯৬২’কে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরো যুগোপযোগী ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ২. একটি আওকাফ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ৩. ওয়াক্ফ বিষয়ে অধিকতর গবেষণার উদ্দেশ্যে দেশের বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ আলেম ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। ৪. ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছোট ছোট ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। ৫. জনসাধারণকে ওয়াক্ফ বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ৬. সরকারিভাবে একটি ওয়াক্ফ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ৭. অধিক জনসচেতনতার লক্ষ্যে পাঠ্যসূচিতে ওয়াক্ফবিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ৮. এতিম ও পথশিশুদের জন্য খাদ্য ও বিনোদনের বিনিময়ে শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ওয়াক্ফভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ৯. ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন জোরদার করা প্রয়োজন, যাতে এর মাধ্যমে কল্যাণধর্মী ব্যাংকিংয়ের সুফল সব অভাবী ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়। ১০. সর্বোপরি, ওয়াকফ বিষয়ে শক্তিশালী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা