শিক্ষায় সঙ্কট, একমাত্র সমাধান জাতীয়করণ
- মো: আবদুর রহমান
- ২১ অক্টোবর ২০২০, ২০:৩৫
শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিকে সুন্দর সামাজিক জীবনে উপযোগী করে তৈরি করা। আর এ জন্য চাই জীবনঘনিষ্ঠ কর্মমুখী ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। সমাজ তথা দেশের জন্য কাক্সিক্ষত জনশক্তি তৈরি করতে হলে শিক্ষাকে হতে হবে কর্মমুখী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ; কিন্তু বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, শিক্ষাব্যবস্থাকে অক্ষম করে রাখা হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। এটি করতে হলে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ৯৭ শতাংশ বেসরকারি আর ৩ শতাংশ সরকারি। ৯৭ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ ৩ শতাংশ কার্যক্রম চালনাকারী সরকার। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ একজন শিক্ষক নেতার মন্তব্য, ৯৭ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাকে ৩ শতাংশের সরকারিরা গলা চিপে ধরছে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হতে চলেছে। এই ৪৯ বছরে মোট সাতটি শিক্ষা কমিশন আমরা পেয়েছি। সব শিক্ষা কমিশন শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু আজো এ দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারি।
আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর শিক্ষকদের থেকে অনেক দুরে। আমাদের দেশের শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে রাজপথে থাকেন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। অথচ ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করে সব মানুষের জন্য শিক্ষার সমান সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষানীতি পেয়েছি আজ থেকে ১০ বছর আগে।
এই ১০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আরো প্রকট হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যখন একজন ছাত্র ২০ টাকা বেতন দেয় তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশি। এখানে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সন্তান বেশি, অন্য দিকে সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধিক বেতন দিয়ে শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। আবার শিক্ষকদের শিক্ষাভাতা, টিফিনভাতা, পাহাড়ি ভাতা, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, উচ্চতর বেতন স্কেল, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল, উৎসবভাতা ও বাড়িভাড়া, অবসর সুবিধা, বদলি- এসব কোনো সুবিধাই বেসরকারি শিক্ষকরা পান না। বেসরকারি শিক্ষায় অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী শিক্ষকদের এমপিও নেই। পূর্ণাঙ্গ ঈদ বোনাস নেই, পূর্র্ণাঙ্গ চিকিৎসাভাতা নেই, জীবনে কারো কারো একটিও প্রমোশন নেই, বিনোদন ভাতা নেই, পূর্ণাঙ্গ পেনশন নেই, পূর্ণাঙ্গ ভবিষ্যৎ ভাতা নেই, শিক্ষা সহায়ক ভাতা নেই, পাহাড়ি ভাতা নেই, শুধু নেই আর নেই। এর একমাত্র সমাধান সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য কমিয়ে আনা।
আবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ নেই। বিদ্যমান অনুপাত প্রথার কারণে একজন কলেজশিক্ষককে ৩০-৩৫ বছর চাকরি করে প্রভাষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করতে হয়। দেখা যায় তার ছাত্র অন্য প্রতিষ্ঠানে ৮-১০ বছর চাকরি করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হয়ে যায়।
বেসরকারি কলেজ ও মাদরাসায় সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃজন করা জরুরি। স্কেল পরিবর্তনে রয়েছে এক মহা হয়রানি। সব কাগজপত্র যোগদান অথবা প্রথম এমপিওর সময় জমা দেয়া থাকলেও বারবার সব কাগজপত্র জমা দিতে হয়। যা মহা হয়রানি। আর তার জন্য গুণতে হয় ধাপে ধাপে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। শিক্ষা অধিদফতরগুলোকে আগের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সময় হলে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে অটো প্রমোশন দিলে এ মহা হয়রানিতে পড়তে হয় না।
বছরে দু’টি ঈদ বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য রয়েছে ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাভবন ও ৩ শতাংশ সরকারি শিক্ষকরা ঠিকই শতভাগ বোনাস নিচ্ছেন আর বেসরকারিদের দিচ্ছেন ২৫ শতাংশ বোনাস। বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। বেসরকারি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ব্যাংক নেই। অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ব্যাংক চালু করা প্রয়োজন। মাদরাসায় আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স নেই। অবিলম্বে আরবি ভাষা কোর্স চালু করা জরুরি। জেলা সদরে কামিল মাদারাসাগুলোতে আরবি ভাষা কোর্স চালু করা যেতে পারে। প্রত্যেক উপজেলা সদরে একটি স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, একটি মাদারাসাও জাতীয়করণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুনজর কামনা করছি। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া শিক্ষক পদ আছে; কিন্তু স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে না হলেও ৫-১০টি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে একজন স্বাস্থ্যসেবা/ডাক্তার পদ সৃষ্টি করে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২০১৫ সালে পে-স্কেল ঘোষণার পর এই পর্যন্ত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকরা ০২ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত। এর ফলে বেসরকারি শিক্ষকরা এক অর্থে জাতীয় স্কেলের বাইরে চলে গেছেন।
অন্য দিকে ২০১৩ সালে আইসিটি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের শিক্ষকরা সরকারি নির্দেশে নিয়োগ পেয়েও বেতনবিহীন বহু বছর মানবেতন জীবন যাপন করছেন। সরকারি শিক্ষকদের বেলায় এমনটা কি সম্ভব?
বর্তমান সরকার শিক্ষক ও শিক্ষাবান্ধব সরকার। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে শিক্ষার উপকরণসহ অনেক দিকেরই উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষকদেরও হয়েছে, কিন্তু তা বাস্তব চাহিদার চেয়ে অনেক কম। সরকার শিক্ষার উন্নয়নে যেভাবে পরিশ্রম করে চলেছে, তেমনিভাবে বেসরকারি শিক্ষকরাও জাতি গঠনে তথা মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অর্জন অতীতের কোনো সরকারের সাথে তুলনায় কম নয়।
বর্তমানে আমাদের সামনে ডিজিটাল বাংলাদেশ, মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ, গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা মজবুত করার বিষয়গুলো বড় চ্যালেঞ্জ। বেসরকারি শিক্ষকরা বিশ্বাস করে- রাষ্ট্রকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের বাইরে রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সঙ্কট দূরীকরণে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণই একমাত্র সমাধান।
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা মনে করেন, দেশ ও জাতির বৃহত্তম স্বার্থে ‘শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ’ এখন সময়ের দাবি, যৌক্তিক দাবি। তাই বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর জাতীয়করণ নয়, একটি মাত্র ঘোষণায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে তৈরি হোক ইতিহাস।
লেখক : কলেজ শিক্ষক
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা