২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বন্ধু, এভাবে তো চলবে না

-

সে মনকাড়া হাসি দিয়ে আমাকে বলল, বন্ধু, আমাকে চিনতে পারছেন? গভীরভাবে তার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কণ্ঠস্বর খুব পরিচিত মনে হলো। তার ‘বন্ধু’ ডাকটাও মনের দরোজায় কড়া নেড়ে বলল, সে নিশ্চয় কোনো পুরনো পরিচিতজন। কিন্তু চোখ তার চেহারা চিনতে পারছিল না। আমি এ পরীক্ষায় ব্যর্থতা স্বীকার করে বললাম, ‘ভাইজান, আপনার কণ্ঠস্বর তো অপরিচিত নয়। কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার পরিচয়টা একটু দিন।’ শুনে তার মুচকি হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হলো। তিনি বললেন, ‘আরে আমি ইবরাহীম। সতেরো বছর আগে কাবুলে আপনার সাথে আমার প্রথমবারের মতো দেখা হয়েছিল। বেশ কয়েকবার দোভাষী ও গাইড হিসেবে আপনার সাথে আফগানিস্তানের দূর-দূরান্তের এলাকাগুলো ঘুরেছি। ওই সময় যুবক ছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে সময়ের আগেই বৃদ্ধ করে দিয়েছে। এ জন্য আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।’ তার কথা শেষ না হতেই আমি তাকে গলায় জড়িয়ে ধরলাম।

অনেক বছর পর নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাথে তার দেখা হলো। তার চেহারা বাস্তবেই অনেক বদলে গেছে। তবে তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত ‘বন্ধু’ আজো এতটাই তরতাজা ও সুমিষ্ট হয়ে আছে, যতটা ছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় আফগানিস্তানে গমনকারী বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য কাবুলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একজন পরীক্ষিত দোভাষীর ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। আর জায়গায় জায়গায় বসানো চেকপোস্টে এ দোভাষী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি করা অনুমতিপত্র দেখিয়ে সাংবাদিকদের মুশকিল আসান করে দিতেন। পেশোয়ারের কাছাকাছি এক আফগান মুহাজির ক্যাম্পে ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেছে। এ জন্য সে উর্দুও জানে। সুতরাং আমরা যখনই আফগানিস্তান যেতাম, তাকে খুঁজে বের করে সফরসঙ্গী বানাতাম। আর সে ‘ইয়ারাজি, ইয়ারাজি-বন্ধু, বন্ধু’ বলে আমাদের বিপজ্জনক অঞ্চলগুলোতে যেতে বাধা দিত। আমরা যখন চাপাচাপি করতাম, তখন সে আমাদের সাথে যেত। আর হাসতে হাসতে বলত, আপনাদের সাথে মারা গেলে কিছু খ্যাতি অবশ্যই পাবো। তার মুচকি হাসি হুবহু সে রকমই আছে। তবে চুল সাদা হয়ে গেছে। চোখে চশমা লেগেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, বন্ধু, তুমি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করছ?

ইবরাহীম বলল, ‘কাল কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টসের হেডকোয়ার্টারে আপনার আলোচনা ছিল। আমাকে এক মিসরীয় সাংবাদিক আপনার কথা বলতেই আমি ওখানে পৌঁছে যাই। ওখানে সিপিজির দফতরে কিন্তু প্রবেশের অনুমতি পাইনি। ওই সময় বৃষ্টি শুরু হলো। আমি ফিরে চলে গেলাম। এরপর জানলাম, আপনি ৭ মার্চ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আসবেন। তাই এখানে চলে এলাম। যখন কনফারেন্স হলে প্রবেশ করলাম, তখন বক্তৃতার জন্য আপনার নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল। আপনার সব কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। এরপর প্রশ্নোত্তরও শুনলাম। লাঞ্চের বিরতি হওয়ামাত্র জটলা আপনাকে ঘিরে ফেলে। অনেক কষ্টে আপনার কাছে এসে পৌঁছেছি।’ জিজ্ঞাসা করলাম, আমেরিকা কবে এলে? ইবরাহীম বলল, ‘আপনার মনে থাকার কথা, আপনার কাছে সানডে টাইমস-এর সাংবাদিক মেরি কোলভিনের ব্যাপারে আলোচনা করতাম। আমি তার সাথেও কাজ করেছি। তিনি আমাকে বলতেন, ‘আফগানিস্তানে দীর্ঘ দিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। তুমি আরো পড়ালেখা করো। আর দোভাষীর পরিবর্তে পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে যাও।’ কোলভিন ইবরাহীমকে বেশ সহযোগিতা করেছেন। তাকে নিউ ইয়র্কে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি নিজেও নিউ ইয়র্কের অধিবাসী ছিলেন। ২০১২ সালে মেরি কোলভিন সিরিয়ার হিমস শহরে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একদিন তিনি সিএনএন-এর অ্যান্ডারসন কুপারের নিউজশোতে ফোনে জানান, সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সেনাবাহিনী হিমসে নারী-শিশুদের গণহত্যা করছে। ওই টেলিফোন সাক্ষাৎকারের কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই আসাদের বাহিনী মেরি কোলভিনকে হিমসে খুঁজে বের করে এবং বোমা হামলার মাধ্যমে এই বীর নারী সাংবাদিককে হত্যা করে। আমি ইবরাহীমকে বলি, মেরি কোলভিনের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে চেচনিয়ার গ্রোজনিতে। তার একটি চোখ শ্রীলঙ্কার জাফনাতে বোমা হামলার কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সাংবাদিকতা ত্যাগ করেননি। ইবরাহীম জানতে চাইল, ‘আপনি এখানে যা বলেছেন, আমি গভীরভাবে শুনলাম। কিন্তু আপনি আফগানিস্তানে নিজের গ্রেফতারির কথাটা বলেননি।’ তাকে বললাম, আফগানিস্তানে আমি তিনবার গ্রেফতার হয়েছি। একবার তুমিও আমার সাথে ছিলে। একবার চেচনিয়াতে রুশ বাহিনী গ্রেফতার করেছিল। লেবাননে হিজবুল্লাহও আমাকে গ্রেফতার করেছিল। সোয়াতে পাকিস্তানি তালেবান ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কাহিনী দীর্ঘ হয়ে যাবে। এখানকার সিম্পোজিয়াম ছিল পাকিস্তানবিষয়ক। সুতরাং আমি আমাকে পাকিস্তান পর্যন্ত সীমিত রেখেছি। ইবরাহীম বলল, ছাত্রছাত্রীরা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেছে। তবে কেউ আফগানিস্তান নিয়ে প্রশ্ন করেনি। যদি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে পাকিস্তানেও শান্তি আসবে না। তার কথার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। আমাদের কথা চলছিল। ইতোমধ্যে কনফারেন্সের পরের সেশন শুরু হতে চলল, সেখানে জিবরান নাসেরের বক্তব্য দেয়ার কথা। ইবরাহীম বলল, আপনি আজ অথবা কাল আমাকে সময় দিন। আমার কিছু মার্কিন বন্ধু আপনার সাক্ষাৎ পেতে চায়। বললাম, কনফারেন্স শেষ হতেই সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবো। আজ সন্ধ্যায়ই পাকিস্তান ফিরে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো, জিবরান নাসেরের বক্তব্য শেষ হলে পরের সেশনে আকবর জায়দির বক্তব্যের আগে আমরা আবার কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলব।

জায়দি পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর বক্তব্য শুরু করলে ইবরাহীম হাত ধরে আমাকে হলের বাইরে নিয়ে গেল। ক্ষমাপ্রার্থনাসুলভ ভঙ্গিতে বলল, বন্ধু, ক্ষমা করবেন। জোর করে আপনার মেহমান হচ্ছি। এবার বলুন তো, আফগানিস্তানের এবারের নির্বাচনে আপনি কোনো অনুষ্ঠান কেন করলেন না? আমি বললাম, বেশির ভাগ পাকিস্তানি নিজেদের সমস্যায় জর্জরিত। আমরা বারবার আশরাফ গনির মতো মানুষকে পাকিস্তানে ডেকে গার্ড অব অনার দিয়ে থাকি। আর তিনি ফিরে গিয়ে বারবার পাকিস্তানকে গালি দিতে থাকেন। ২০১৪ সালে পাকিস্তান তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। ২০১৯ সালে তিনি অভিযোগ করেন, পাকিস্তান ড. আবদুল্লাহ আবভুল্লাহকে সাহায্য করছে। পাকিস্তান তালেবান ও আমেরিকাকে কাছাকাছি আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তান ‘কয়লার দালালি’ করেছে। এ জন্য এখন আফগানিস্তানে যেতে মন চায় না। আল্লাহ করুন, আফগান জাতি নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিক। ইবরাহীম বলল, বন্ধু, পাকিস্তানে কিছু মানুষ আশরাফ গনিকে বেশ সমর্থন করে, অথচ ইমরান খানের বিরোধিতা করে থাকে। বলে, ইমরান খান সিলেক্টেড, আর আশরাফ গনি ইলেক্টেড। আমরা যখন আমেরিকায় বসে গনির পাকিস্তানি সমর্থকদের কথা শুনি, তখন বেশ অবাক লাগে। সারা বিশ্ব দেখছে, অর্ধেক আফগানিস্তান আশরাফ গনিকে প্রেসিডেন্ট মানে। অর্ধেক আফগানিস্তান আবদুল্লাহর সাথে রয়েছে। আর তালেবানদের প্রেসিডেন্ট মোল্লা হায়বাতুল্লাহ। অথচ কিছু পাকিস্তানি আশরাফ গনিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাব্যস্ত করে আমাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের নিজেদের বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই। ইবরাহীম দু-তিনজন পাকিস্তানি বন্ধুর নাম উল্লেখ করে বলল, তাদের বলবেন, বন্ধু, যদি শতভাগ সিলেক্টেড ব্যক্তি আশরাফ গনি আপনাদের হিরো হয়ে থাকে, তাহলে আপনারা ইমরান খানকে ‘সিলেক্টেড’ বলা বন্ধ করুন। বন্ধু, এটা কপটতা, এভাবে তো চলবে না।

দৈনিক জং ১২ মার্চ, সংখ্যা থেকে ভাষান্তর, ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট, জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement