২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আর কত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন

-

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নানা অনিয়মের মধ্যে শেষ হলো। এহেন নির্বাচনের দায় নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সবচেয়ে শক্তিশালী বলা চলে। সংবিধানের ১১৮ থেকে ১২৬ ধারায় নির্বাচন কমিশনকে নানা ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। সিটি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময় থেকেই এ নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ ও অস্বস্তি ছিল। তা দূর করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরো প্রকট হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই, সেটা নির্বাচন দেখে মনে হয়েছে। একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে আর ভোটারদের উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভাটা পড়ছে। দিবালোকের মত সত্য, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

নাগরিকদের মনে অস্বস্তির একটি বড় উৎস হলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল ও প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং এগুলো নিরসনে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা। ফুটপাথ বা রাস্তা দখল করে নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপন, প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারের সময়ে যান চলাচলে বাধা, লাগাতার উচ্চ আওয়াজের শব্দযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দদূষণ, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটানো ইত্যাদি নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। এতেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রধান বিরোধী দল প্রচারণার সুযোগ তো দূরের কথা, তাদের পোস্টারও লাগাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ঢাকা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচন ছিল একেবারে ভিন্ন। প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার-ব্যানার বিরোধী দলেরও ছিল এবং তা চোখে পড়ার মতো। প্রচারকালে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, যা মিডিয়ার মাধ্যমে জাতি জানতে পারে।

এর অন্যতম হলো ২১ জানুয়ারি গাবতলী এলাকায় বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারণার সময়ে হামলা এবং ২৬ জানুয়ারি গোপীবাগে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষ। এসব দ্বন্দ্ব-হানাহানির প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল দায়সারা গোছের। কমিশন যদি গাবতলীর ঘটনার পর দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিত, তাহলে গোপীবাগের ঘটনা এড়ানো যেত।

সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক হলো, একজন নির্বাচন কমিশনারের মতে, আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে কমিশনের সভায় ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় না। অর্থাৎ নির্বাচনী আচরণবিধি রোধে তারা শুধু নির্বিকারই নয়, পুরো নির্বাচন সম্পর্কেই তারা যেন উদাসীন। অবস্থা দেখে মনে হয়, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। ক্ষমতাসীনদের মনে কষ্ট যাবে এমন কাজ থেকে তারা যেন বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। কোনোভাবেই সম্ভবত তারা সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না। এ ধরনের মানসিকতার পরিণতি জাতির জন্য অশুভ হতে বাধ্য। এর ফলে নির্বাচনের দিন সহিংসতা এড়ানো কঠিন।

যা ধারণা তাই সত্য হলো- কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ পাহাড় পরিমাণ অভিযোগের মাধ্যমে শেষ হলো ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন- যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন ভালো হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, গত ১০০ বছরেও এত সুন্দর নির্বাচন হয়নি। তাদের কী অদ্ভূত মিল। একটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে- ‘ভোট কেন্দ্র পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ, বুথ কেন্দ্রে, মাঠে ও আশপাশের সড়কে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক ও নৌকার ব্যাজধারীদের সরব উপস্থিতিই ভোটের পরিবেশ ঠিক করে দেবে। বিএনপির কর্মী সমর্থকরা যাতে কেন্দ্রের আশপাশে জড়ো হতে না পারে এবং ভোট দিতে কেন্দ্রে না আসতে পারে, এটাই এর প্রধান টার্গেট।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে অতীতে যারা কাউন্সিলর হয়েছেন, তাদের অনেকেই বিরাট অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছেন এবং আছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। তাই প্রার্থীদের অনেকেই কাউন্সিলর হতে মরিয়া। বিশেষত রকিবউদ্দীন কমিশন থেকে শুরু করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আরেকটি মানসিকতা দৃশ্যমান। তারা কমিশনকে অনেকটা ‘পোস্ট অফিস’ হিসেবে দেখেন, অর্থাৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো অঘটনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয়া তাদের দায়িত্ব মনে করেন না। তাদের মতে, কোনো বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হলে আগে কমিশনের কাছে অভিযোগ করতে হবে। সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীন সাংবিধানিক পদ অলঙ্কৃত করে আছেন, সেটি যেন তারা উপলব্ধি করতেই পারছেন না!

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, কমিশন সচিবের ভূমিকা নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনের ভেতর মতভেদ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো তথ্য যদি একজন কমিশনার চান, তাহলে এমন কোনো আইন নেই যে তিনি দিতে পারবেন না, ইসি সচিব এতে সরাসরি না করার সুযোগ নেই। যদি তিনি সহযোগিতা না করেন তা আইন অমান্য করার শামিল। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে ইতিহাসে এই প্রথম দেখা গেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে একজন সচিব অবজ্ঞা করছেন। নির্বাচন কমিশনের ভেতরে লেভেল প্লেয়িং নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন, এমনকি নির্বাচন কমিশনারদের একজন মাহবুব তালুকদারও তা বলেছেন। নির্বাচন নিয়ে মারামারি হলো, অভিযোগের পর কিন্তু কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি নির্বাচন কমিশন।

ভোট কারচুপি এবং জালিয়াতির প্রতিকারের দাবিতে নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন পুনরায় নির্বাচনের দাবি করে এবং ঢাকা সিটিতে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দিয়েছে।

নগর নির্বাচন সম্পর্কে অস্বস্তির অন্য একটি কারণও রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকরা রাষ্ট্রের মালিক। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন, যে প্রতিনিধিরা মালিকদের স্বার্থে ও কল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য নাগরিকদের অবশ্যই সম্ভাব্য প্রতিনিধিদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার আজ আইনগতভাবে স্বীকৃত।

ইভিএম নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। তবু নির্বাচন কমিশন কারো কোনো মতের তোয়াক্কা না করে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ৩৫ হাজার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করেছে। এটা কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। নির্বাচনকালে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনের আঙুলের ছাপ মিলেনি। ইভএম এর বিরোধিতা শুধু বিএনপি করেনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞরাও এর বিরোধিতা করে আসছেন। কে কার কথা শুনে? ‘দল কানা’ বলে কথা।

সিটি নির্বাচন নিয়ে একটি বড় অস্বস্তির উৎস হলো ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএমের ব্যবহার। এর মূল কারণ আস্থার সংকট। যন্ত্রটি নিয়ে আস্থার সঙ্কট এবং সর্বোপরি যন্ত্রটি ব্যবহারকারী নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থার অভাব। যন্ত্রটি নিয়ে আস্থার সংকটের কারণ হলো, কোনো যন্ত্রই শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়। এগুলোকে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দেয়া যায়। এ ছাড়া এতে ‘ভোটার-ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যা থাকলে ভোটার জানতে পারতেন, তার প্রদত্ত ভোট কার পক্ষে পড়েছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অভিযোগ উঠলে ভোট পুনর্গণনা করা যেত।

অতীতে নির্বাচনী জালিয়াতিতে যুক্ত হওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সঙ্কট থাকাই স্বাভাবিক। ভোটার শনাক্ত করার ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা, যাতে ভোটারের অনুপস্থিতিতেই তার হয়ে কর্মকর্তার পক্ষে ভোট দেয়া সম্ভব এবং ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকা ভোট পুনর্গণনাকে অর্থহীন করে তুলবে। অর্থাৎ কমিশন যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা-ই মেনে নিতে হবে। কারণ ভোট পুনর্গণনার মাধ্যমে তা সঠিক কি না দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, ইভিএমের ফলাফল আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। এটা আসলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপকৌশল। ১৩ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও গত জাতীয় নির্বাচনের পর দায়ের করা নির্বাচনী বিরোধের একটিরও শুনানি হয়নি, যদিও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী এগুলো ছয় মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। নির্বাচন নিয়ে আরেক কারণেও আমরা অস্বস্তিতে আছি। কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রার্থীদের পক্ষে লাখ লাখ পোস্টার টানানো ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এর অনেকগুলোই ল্যামিনেট করা, যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে বাধ্য। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের পর সাথে সাথে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এসব অপসারণ করা না হলে এর অধিকাংশই নালা ও নর্দমায় যায়, যা বর্ষাকালে মহানগরে ভয়ানক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। আশার কথা, আমাদের আদালত নির্বাচনের পরে প্রার্থীদের নিজ উদ্যোগে এগুলো অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা করবে, এমন আশা করা দুরূহ।

কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এই কমিশনের অধীনে জাতি আশা করতে পারে না। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সবার ভূমিকা প্রয়োজন, বিশেষ করে স্বাধীনতার পর জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে রকিব এবং হুদা কমিশন যে নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে এতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম খাটো করা হয়েছে।

tafazzalh59@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement