০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

জিন কি আপনার ওপর ভর করতে পারে?

- ফাইল ছবি

বিষয়টির নামকরণ থেকে মনে হবে বর্তমান সময়ে জিনের আলোচনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা অতীতে ছিল। এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের পক্ষে তেমন কিছু করা সম্ভব হয় না। যেমন আমাদের দেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সমগ্র পৃথিবীর মানবদরদী মানুষ তাদের পক্ষে আছে। তার পরও তার সমাধান হচ্ছে না। জীনের বিষয়টি তেমন নয়। এর গুরুত্বও কম নয়। এর সাথে মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস, চিন্তাচেতনা ও তার প্রয়োগ ইত্যাদি অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।
জিনে ভর করার বিষয়টি এমন- এ ব্যাপারে অনেক বড় বড় আলেম, শিক্ষিত লোক দৃঢ়তার সাথে জবাব দিতে পারেন না। গ্রামের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের মাঝে জিনে ভর করার ধারণা এত প্রবল যে, এর বাইরে তারা চিন্তাও করতে পারে না। জিনের বিস্ময়কর জীবন, রুকাইয়া ইত্যাদি বিষয়ে এখনো বই বের হয়, যা পড়ে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমি প্রায় সাড়ে নয় বছর পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ ও চাকরি বাবদ দেশের বাইরে কাটিয়েছি। এ সময় ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের রোগী দেখার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে অনেক শারীরিক ও মানসিক রোগীদের চিন্তা-চেতনার পার্থক্যগুলো কাছে থেকে দেখেছি।

মুসলিম বিশ্বে দুই ধরনের প্রান্তিক লোক রয়েছে। এক ধরনের লোক পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না বা জিনকে পোকামাকড় ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির সাথে তুলনা করেন। আরেক ধরনের লোক আছেন, যারা কুরআন-হাদিসের ভালো জ্ঞান রাখেন, কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের রোগ নির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতি, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাপদ্ধতির সাথে পরিচিত নন। জিনের আছরের আলোচনার জন্য এ দুই ধরনের চিন্তার মধ্যে সমন্বয় হওয়া দরকার, যা আমি আমার আলোচনায় চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিনের আছরের ধারণা থেকে কী সমস্যা হতে পারে তাও আমার পরবর্তী আলোচনা থেকে জানা যাবে।

জিন আরবি শব্দ যার মূল জান্নাহ। অর্থ গোপন করা, ঢেকে রাখা। কেউ কেউ এ শব্দের অনুবাদ করেছেন, জিন এমন এক সৃষ্টি যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের নাগালের বাইরে অর্থাৎ যাকে দেখা, শোনা বা ধরা যায় না। জান্নাহ শব্দ থেকেই অন্যান্য আরবি শব্দের উৎপত্তি যেমন জান্নাত। অর্থাৎ এমন একটি বাগান, যা দেয়াল দিয়ে ঢাকা থাকে। জানিন অর্থাৎ ভ্রƒণ, যা মাতৃগর্ভে ঢাকা থাকে। (মাজনুন) পাগল বা জিনে আক্রান্ত। আরবরা যেকোনো মানসিক রোগী বোঝানোর জন্য মাজনুন শব্দ ব্যবহার করত। ঢাল (আরবি শব্দ মিযান), যা শত্রুর আক্রমণ থেকে ঢেকে রাখে।

যে সৃষ্টি মানুষ দেখতে পায় না, তার সম্বন্ধে মানুষের নানা রকম ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিতে জিন, দৈত্য, দেও, দানব ইত্যাদি সম্পর্কে নানা রকম লোককথা প্রচলিত আছে। যেমন গ্রিক রূপকথাতে বিভিন্ন দৈত্যের কাহিনী। মধ্যযুগের আলিফ লায়লা বা হাজার এক রজনী কাহিনীতে দুই জিনের বর্ণনা রয়েছে। কোনো কোনো কাহিনীতে জিনের সাহায্যে দ্রুত ভ্রমণের বিবরণ আছে। যেমন চীন থেকে মরক্কো অথবা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জিনের সাহায্যে বাগদাদ থেকে কায়রো ভ্রমণ। প্রাক-ইসলামিক যুগে অনেক আরব জিনের পূজা বা উপাসনা করত। জিনকে তারা ভয় পেত। বিভিন্ন রোগের বিশেষ করে মানসিক রোগের জন্য জিনকে দায়ী করা হতো।

বর্তমান সময়ে নানা রকম Horror Movies যেমন- Dracula, Jurassik Park, Harry Potter, Lords of The Rings ইত্যাদি Movie তৈরি করা হয়। এ Movieগুলো যখন শিশুরা দেখে তখন শিশুদের অবচেতন মনে নানা রকম আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ জন্য গড়ারবগুলো পাশ্চাত্যে মধ্যরাতে দেখানো হয়, যেন শিশুদের অবচেতন মনে কোনো প্রভাব না পড়ে। এই লোককথা, রূপকথা এবং বর্তমানের গড়ারবগুলো বয়স্কদের মনোজগতে কোনো আলোড়ন তুলতে পারে কি? আমাদের এই আলচনায় এই প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে। এই লোককথা, রূপকথা না হয় বাদ দিলাম। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কী আছে?

জিন বা দৈত্য আছে কি নেই? যদি থাকে তাহলে মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক কী? মানুষ তাদের চেয়ে ক্ষমতাবান, নাকি তারা মানুষের চেয়ে? প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী তার নিজ ধর্মগ্রন্থের বাণীকে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার বাণী হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকে। কাজেই এই ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রভাব যেকোনো রূপকথার চেয়ে মানুষের ওপর অনেক বেশি হতে বাধ্য। আসুন এ সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক আলোচনা করি :

বাইবেল : ‘একটি প্রেতাত্মা আমার মুখমণ্ডলের পাশ দিয়ে চলে গেল আর আমার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল।’ (আইয়ুব ৪:১৫)।
“দৈত্যরা যিশুকে অনুরোধ করল, তুমি যদি আমাদের তাড়িয়ে দিতে চাও, তাহলে শূকরের দলের ভেতর পাঠিয়ে দাও।” (মথি ১২:৪৫)।
যিশু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? লিজিওন উত্তর দিলো- কারণ অনেক দৈত্য তার ভেতর প্রবেশ করেছে। (লুক ৮:৩০)। এবং শয়তান যে তাদের প্রতারিত করেছিল নিক্ষিপ্ত হলো জ্বলন্ত সালফার লেকে যেখানে পশু ও মিথ্যা নবী নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। (রিভিলেশন ২০:১০)।

‘কিছু ইহুদি প্রভু যিশুর নাম নিয়ে জিন তাড়াতে এসেছিল। কিন্তু জিনে আক্রান্ত লোকটি তাদের পরাজিত করল এবং তারা রক্তাক্ত এবং উলঙ্গ অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।’ (Acts 19:13-16)|।
‘দৈত্যরা এখনও শয়তানকে তাদের নেতা মনে করে এবং তারা ফেরেশতাদের সাথে যুদ্ধ করে মহাপ্রভুর বান্দাহদের বাঁধা দেয়।’(Damiel: 10-13)|
“জিনে/দৈত্যে ভর করা এমন অনেক মানুষকে যিশুর কাছে আনা হলো, তিনি একটি কথার মাধ্যমে তাদের তাড়িয়ে দিলেন। (Methew: 8-16)|
এভাবে বাইবেলে প্রচুর উদাহরণ আছে যা থেকে মনে হবে, জিন মানুষের ওপর ভর করে এবং যিশুর জিন তাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না।

হিন্দুধর্ম : হিন্দুধর্মে কালীকে দৈত্য হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় এবং খারাপ সব কিছুর মূল ধরা হয়। মহাভারতে উল্লেখ আছে যে কালী ‘নালার’ ওপর ভর করে এবং তার ভাইয়ের সাথে পাশা খেলে তাকে রাজত্ব হারাতে বাধ্য করে।
হিন্দুধর্মে দৈত্যদের প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয় :

১। বিমূর্ত দৈত্য (Abstract) ২। স্বর্গীয় দৈত্য (Celestia).
৩। বায়বীয় (Atmosphere) ৪। রাক্ষস (Terrestrial)

‘দৈত্যরা ক্ষতিকারক শক্তি যা বাতাসে ঘুরে বেড়ায়, রোগ ছড়ায় আর বাচ্চা হওয়ার সময় নানা সমস্যা সৃষ্টি করে ইত্যাদি। জাদুর সাহায্যে প্রধানত এই দৈত্যগুলোকে পরাজিত করা হয় (ভট্টাচার্য ৩৫)। ঋকবেদে উল্লেখিত আরেকটি ক্ষতিকারক প্রেতাত্মার দল হচ্ছে Druhs (ভট্টাচার্য-৩৬ )। অথর্ব বেদে জরকে দৈত্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (ভট্টাচার্য-৪০)। অশরীরী প্রেতাত্মা যেমনÑ ভূত, প্রেত এবং পিশাচকে ক্ষতিকারক শক্তি হিসেবে ধরা হয়। বায়বীয় (অঃসড়ংঢ়যবৎব) দৈত্যের উদাহরণ হচ্ছে বিজলি, বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি। ‘রাক্ষস হচ্ছে ভূমিতে বিচরণকারী দৈত্য যা মানুষের শত্রু এবং শকুন, কুকুর, প্যাঁচা ইত্যাদির রূপে বিরাজ করে (গঈ উড়হবষষ ২৩৬)।

ঋকবেদের বর্ণনা মতে, ‘তারা মানুষের আকৃতি ধারণ করতে পারে, মহিলাদের উত্ত্যক্ত ও শিশুদের ক্ষতি করতে পারে (ভট্টাচার্য ৪১) তারা গর্ভকালীন সময়ে, শিশু হওয়ার সময় এবং বিয়েতে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মানুষের মুখ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, নানা রকম মানসিক রোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং কথা বলার ক্ষমতা নষ্ট করতে পারে।’ (গঈ উড়হবষষ ২:৩৬) রাক্ষসরা বাড়ির আশপাশে শব্দ করে নাচে, মাথার খুলিতে নানান কিছু পান করে। তারা উপাসনাকে ঘৃণা করে এবং দেবতার জন্য উৎসর্গ করা বস্তুকে প্রায়ই ছিনিয়ে নিতে চায়। (ভট্টাচার্য ৪১)।

ইহুদি ধর্ম : ইহুদি ধর্মে জীনের সমার্থক শব্দ হচ্ছে Shedim। তাদের পা আছে আর হাত হচ্ছে মোরগের পায়ের মতো। তাদের পাখা আছে, ভবিষ্যৎ বলতে পারে। তারা মানুষের মতো খায়, জন্ম নেয়, মৃত্যুবরণ করে। তারা রোগ ও দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। তারা মৃত ব্যক্তির সাথে কবরে যায় এবং কবরস্থানে উড়তে থাকে। কোনো মানুষ শিস দিলে বা তার নাম উচ্চারণ করলে ঝযবফরস রাগান্বিত হতে পারে। একজন বিখ্যাত ইহুদি ধর্মীয় নেতা বলেন, যেকোনো বাড়ির জানালা যেন পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা না হয়, এতে তাদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে।

বৌদ্ধ ধর্ম : বৌদ্ধ ধর্মে ‘Maria’ হচ্ছে একটি দৈত্য যে রাজকুমার সিদ্ধার্থকে (গৌতমবুদ্ধ) স্বপ্নে সুন্দরী নারীদের লোভ দেখায়। বিভিন্ন গ্রন্থে বলা হয় যে, সুন্দরী নারীরা ছিল ‘গধৎরধ’ কন্যা। মৃত্যু, পুনর্জন্ম এবং খারাপ আকাক্সক্ষা ইত্যাদির সাথে ‘Maria’ জড়িত।
(চলবে)

অধ্যাপক কর্নেল ডা: জেহাদ খান (অব:), এমডি, এমসিপিএস, এফসিপিএস, এফআরসিপি, এফএসিসি


আরো সংবাদ



premium cement