মর্যাদা চাই, নাকি লাঞ্ছনা?
- হামিদ মীর
- ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:২৭
এটা ভাগ্যের বিষয়; কেউ শত্র“র যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে সম্মান লাভ করেন, আবার কেউ নিজেদের লোকদের ওপর ট্যাংক চালিয়ে দিয়ে পুরস্কার লাভ করেন। সব পুরস্কার সম্মানজনক হয় না, কখনো কখনো লাঞ্ছনার কারণও হয়। আজ ভুলে যাওয়া দু’টি কাহিনী শোনাই। একটি সম্মানের কাহিনী, অপরটি লাঞ্ছনার। প্রথম কাহিনীটি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজমের। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এ ‘বাহাদুর শাহীন’ এ সম্মান লাভ করেছেন যে, তিনি তার দক্ষতা ও বীরত্ব দিয়ে শুধু ভারত নয়, বরং ইসরাইলের যুদ্ধবিমানও ভূপাতিত করেছেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পিএএফ বেস সারগোদাতে নিযুক্ত ছিলেন। ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় ভারতীয় এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করায় তিনি ‘সিতারা-ই-জুরআত’ পদক লাভ করেছিলেন। পরের বছর তাকে জর্দান প্রেরণ করা হয়।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইলি বিমান জর্দানের ওপর হামলা চালালে সাইফুল আজম দু’টি ইসরাইলি বিমান ধ্বংস করে দেন। কিছু দিন পর তাকে ইরাকে পাঠানো হয়। তিনি সেখানেও দু’টি ইসরাইলি বিমান ধ্বংস করেন। জর্দানের শাসক বাদশাহ হোসাইন সাইফুল আজমকে সামরিক সম্মাননা তো প্রদান করেছেনই, এ ছাড়াও তাকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে আম্মানের রাজপথে ঘুরতে গর্ববোধ করতেন। সাইফুল আজম ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে গেলে তিনি বাংলাদেশ এয়ারফোর্সে যোগ দেন এবং ১৯৭৯ সালে গ্র“প ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসরে যান।
দ্বিতীয় কাহিনীটা ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হকের। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জর্দানে পাঠানো হয় তাকে। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে বাদশাহ হোসাইন ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে (পিএলও) জর্দান থেকে বের করে দিতে সেনা অভিযান চালিয়েছিলেন। এতে ট্যাংকও ব্যবহার করা হয়। ওই অভিযানের নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক। অভিযানের সময় পিএলও এবং জর্দান সেনাবাহিনীর মধ্যে মারাত্মক লড়াই হয়। তাতে অনেক নিরপরাধ ফিলিস্তিনি শরণার্থীও নিহত হন।
ওই অভিযানে সফলতা অর্জনের জন্য বাদশাহ হোসাইন জিয়াউল হককেও পুরস্কার দেন। কিন্তু এ পুরস্কার জিয়ার জন্য কখনো সম্মানের কারণ হতে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তার অভিযানকে কেন্দ্র করে আহমদ নাদিম কাসেমি তার ‘উর্দুন’ (জর্দান) নামের কবিতা এই বলে শেষ করেছেন- জো হাথ হাম পে উঠে/হামারে হি হাথ থে/মাগার উন মেঁ কিস কে খঞ্জর থে?/কিস কে খঞ্জর থে?/কিস কে খঞ্জর থে?/কিস সে পুছেঁ?/চলো, চলেঁ আইনূঁ সে পূছেঁ/ আইনূঁ সে কিয়া পুছতে?- মানে, আমাদের ওপর যে হাত উঠল/আমাদেরই হাত ছিল/কিন্তু তাতে কার খঞ্জর ছিল?/কার খঞ্জর ছিল?/কার খঞ্জর ছিল?/ কাকে জিজ্ঞেস করবে?/চলো যাই, আইনকে গিয়ে প্রশ্ন করি/আইনের কাছে গিয়েই বা কী প্রশ্ন করবে?
ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে ভুট্টো সরকারের মসনদ উল্টিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় এলে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, আফসোস, জর্দানে ফিলিস্তিনিদের ওপর ট্যাংক চাপিয়ে দেয়া ব্যক্তি পাকিস্তানের শাসক হয়েছেন। জিয়া ফিলিস্তিনিদের সাথে যা করেছেন, পাকিস্তানিরা তা ভুলে গেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কখনো তা ভুলবে না। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পিএএফের আরেক ‘বাহাদুর শাহীন’ আবদুস সাত্তার সিরিয়া এয়ারফোর্সের মিগ ২১-এর মাধ্যমে ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তানের জন্য সম্মান এনে দেন।
লেবানন-ইসরাইল যুদ্ধের সময় আমার লেবানন ও সিরিয়ায় বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। এরপর মিসর হয়ে গাজা যাওয়ারও সুযোগ পাই। আমি নিজের চোখে অবুঝ ফিলিস্তিনি পাথর নিক্ষেপকারী বালকদের ইসরাইলি ট্যাংকের গোলায় রক্তে রঞ্জিত হতে দেখেছি। বৈরুত থেকে গাজা এবং দামেশক থেকে কায়রো- যেখানেই গেছি, দেখেছি আরবরা পাকিস্তানের সে পাইলটের কথা মনে রেখেছে। তারা পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলটদের প্রশংসা করত, তবে জেনারেল জিয়াউল হকের নিন্দা করতে ভুলত না। এটার দিকে লক্ষ করবেন না যে, আরব দেশগুলোর শাসকেরা পাকিস্তানের ব্যাপারে কী ভাবে এবং কী বলে। বরং লক্ষ করুন, আরব দেশগুলোর জনগণ পাকিস্তানের ব্যাপারে কী ভাবে। আজ পাকিস্তানকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, যদি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তাহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও ভারতের জোট শেষ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ কে দিচ্ছে? এ পরামর্শের পেছনে পাকিস্তানের স্বার্থ আছে, নাকি অন্য কারো স্বার্থ লুকিয়ে আছে? ২০১৮ সালে মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের নতুন বই ঋবধৎ অর্থাৎ ‘ভয়’ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেকোনো মূল্যে ইরানকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন থেকে বের করতে চাচ্ছেন। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য আমেরিকা সৌদি আরব ও কিছু উপসাগরীয় রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের জোট বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছু দিন আগে সৌদি সাংবাদিক দাহাম আল আনাজি আরবি ‘আল খালিজ’ পত্রিকায় ‘রিয়াদে ইসরাইলি দূতাবাসের জন্য সম্মতি’ শিরোনামে তার কলামে লিখেছেন, সৌদি আরবকে পশ্চিম জেরুসালেমে দূতাবাস খোলা উচিত এবং রিয়াদে খোলা উচিত ইসরাইলের দূতাবাস।
কেননা ইহুদিরা আমাদের চাচাত ভাই। পক্ষান্তরে ইরানি ও তুর্কিদের সাথে তো আমাদের দূরতম কোনো বন্ধনও নেই। আরব মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়ে গেছে যে, সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হওয়া উচিত কি না। সৌদি সরকার এ বিষয়ে বর্তমানে নীরব। কিন্তু এটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে শক্তির মহড়ায় ইসরাইলকে সৌদি আরবের জোট সদস্য হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে। সৌদি আরবের জন্য ইসরাইলকে মেনে নেয়া এত সহজ নয়। কেননা মুসলিম দেশগুলোর বিশাল অংশ এখনো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেনি।
এ দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, ইরান, ইয়েমেন, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়াসহ অনেক দেশ যুক্ত রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে যে, ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করো, যাতে অবশিষ্ট মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এ কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। পাকিস্তানকে বলা হচ্ছে যে, ইসরাইলকে মেনে নেয়ার দ্বারা ইসরাইল ও ভারতের পাকিস্তানবিরোধী জোট শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটা ইরানের বিরুদ্ধে গঠিতব্য নতুন জোটে পাকিস্তানকে যুক্ত করার প্রস্তুতি। পাকিস্তানের এ পদক্ষেপে কি আমাদের সংবিধানের ধারা ৪০ লঙ্ঘন হবে না, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামী জোট ও আন্তর্জাতিক শান্তি নষ্ট করতে বাধ্য করবে? আমরা পাকিস্তানের স্বার্থ দেখব, নাকি ভাড়াটিয়া গেরিলা হব?
কেউ মানুক আর না মানুক, আজ পাকিস্তানের জন্য ইসরাইলের নয়, ইসরাইলের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন। ইউরোপে ইসরাইলের সমর্থন খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ২৮টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মধ্যে ৯টি ইউরোপীয় রাষ্ট্র ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্পেন, ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চিন্তাভাবনা করছে। তবে ইসরাইল সরকার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে মেনে নেয়নি। আমেরিকাতেও ইসরাইলের বিরোধিতা বাড়ছে। কেননা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে, ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান ছাড়া উগ্রপন্থা খতম করা যাবে না। ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন প্রকাশ্যে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করছেন। ইন্টারন্যাশনাল জুইশ অ্যান্টি জায়োনিস্ট নেটওয়ার্ক (আইজেএএন) নামে ইহুদিদের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তৎপর এবং ইসরাইলি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করছে।
এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ লেখিকা সেলমা জেমস নিজেই একজন ইহুদি। আজ ইসরাইলের জন্য সেলমা জেমস ও নোয়াম চমস্কির মতো বুদ্ধিজীবীরা মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছেন। কিছু দিন আগে নেদারল্যান্ডসের সরকার সারা বিশ্বের ইহুদিদের লক্ষ্য করে বলেছে, তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে সোচ্চার হবে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া হলে ফায়দাটা হবে কার ? আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের সাথে হাত মিলিয়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানের কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। কেননা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কাশ্মির সমস্যার সমাধানের পথ খুলে দেবে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক শক্তির চাপে বা কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যে সে ভুল করা উচিত হবে না, যা ১৯৭০ সালে জিয়াউল হক জর্দানে করেছিলেন।
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা