২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী : সেকাল ও একালের প্রতিবিম্ব

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে যে আইন, সেখানে সত্য মামলায় ও মিথ্যা সাক্ষী না দিলে শাস্তি দেয়া যায় না। মিথ্যা দিয়ে শুরু করা হয়, আর মিথ্যা দিয়ে শেষ করতে হয়। যে দেশের বিচার ও ইনসাফ মিথ্যার ওপর নির্ভরশীল, সে দেশের মানুষ সত্যিকারের ইনসাফ পেতে পারে কিনা সন্দেহ!’
একই বইয়ে বিচারব্যবস্থার অপপ্রয়োগে রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে বন্দী করা হলে তার পরিবার ও সন্তানদের মধ্যে যে মানসিক দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় তা করুণ ও অমানবিক অবস্থা ও দৃশ্যের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। (পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে আর্থিক দৈন্যের কথা বলা হয়নি) “একদিন সকালে আমি ও রেনু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’

আমি আর রেনু দুইজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই, তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ, তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।”

বইটির পেছনের মলাটে হৃদয়গ্রাহী দ্বিতীয় মন্তব্যটিই শুধু উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে ছাপানো হয়েছে। দু’টি মন্তব্যই তার রাজনৈতিক জীবনে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের অন্যায়ভাবে মুখোমুখি করা বিচারব্যবস্থা এবং জেলজীবন থেকে প্রাপ্ত তিক্ত অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যের নির্যাসই বলা চলে।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিচার ও শাস্তি ব্যবস্থার কতটা মানবাধিকার সমর্থন করে যুগোপযোগী ও সংশোধন করা হয়েছে? স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দীর মধ্যে তা বিবেচনায় আনলে আমরা কী দেখি? আইন বিষয়ে আমেরিকার বিখ্যাত আইনজীবী ডায়ানে বি. শুলডার এবং একজন জার্মান দার্শনিকের মন্তব্য- Law is a reflection and a source of prejudice. It both enforces and suggests forms of bias. Law and order are always and everywhere. The law and order protect the established hierarchy.

ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইন ও শাস্তি ব্যবস্থাই ‘ব্রিটিশ’-এর স্থলে ‘পাকিস্তান’ আর বাংলাদেশ আমলে ‘পাকিস্তান’-এর স্থলে ‘বাংলাদেশ’ লিখে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইন গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সংস্কার ও যুগোপযোগী করার ফুরসৎ ও প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলব্ধি করেছি বলে মনে হয় না।

প্রচলিত আইন ভাঙলে এবং বিচারে প্রমাণিত হলে শাস্তির প্রকার ও পরিমাণ ঠিক করা হয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী। অনেকে ঘুষ খাওয়া শুরু করে যখন সম্পদে টইটুম্বুর হয়ে যায়, তখনো ঘুষ খাওয়ার স্বভাব যায় না। চাকরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ নষ্ট ধারা চলে। হানিফ সংকেতের ভাষায়- ‘আমি তো এমনি এমনিই খাই’। Shoplifting -এর অপরাধ সম্পদশালীরাই বেশি করে। স্বেচ্ছাকৃত খুনের অপরাধ প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানো এবং পথের কাঁটা সরানোর জন্য প্রভাবশালীরাই করে বা করায়।

অপরাধ এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে প্রাচীনকাল থেকেই মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন ছিল, এখনো অনেক দেশে আছে। সময়ের বিবর্তনে অপরাধের সংজ্ঞা বদলেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আওতা বেড়েছে বহুলাংশে। জেলখানা চালু হওয়ার পূর্বে গোত্রপতি বা নৃপতিরা লঘু অপরাধেও গুরুশাস্তি, তথা মৃত্যুদণ্ড দিতেন। জেলখানা চালু হওয়ার পর এই ধারায় পরিবর্তন আসে। অপরাধের ব্যাপ্তি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আইন প্রণয়নের ধারাও চলছে অবিরাম।

মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পদ্ধতি যুগে যুগে ভিন্ন ছিল। প্রাচীন সমাজে উপজাতিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে বসবাসকালে দোষী ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে গোষ্ঠীর কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধীর পরিবর্তে বাছাই করা যেত। ফলে সে নিরপরাধ লোকের দণ্ড না মেনে উপায় ছিল না। এই অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি (১৭৯২-১৭৫০) খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে উপজাতি বা গোষ্ঠীর পরিবর্তে শ্রেণীগতভাবে শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের আইন চালু করেন। অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও বিত্তবান শ্রেণীর জন্য এক ধরনের আইন ও শাস্তি; সাধারণ শ্রেণীর জন্য হয় আরেক ধরনের আইন ও শাস্তি। হাম্মুরাবির আইনের বৈষম্যের জন্য একই অপরাধে কারো মৃত্যুদণ্ড হতো; আবার কারো হতো না। ড্রাকো খ্রিষ্টপূর্ব ৬২১ সালে লিখে যে আইন প্রণয়ন করেন তা খুবই কঠোর প্রকৃতির ছিল। Draconian Law বা কঠোর শাস্তিমূলক আইন কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ড্রাকোর আইন থেকে।

বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য দু’টি- আমাদের আইনব্যবস্থা এবং এর অপপ্রয়োগে রাজনীতিবিদদের হেনস্তা করা সাংবিধানিক ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। সে ধারার কি পরিবর্তন হয়েছে? স্বাধীন এ দেশে সব দলের শাসন জনগণ দেখেছে। এ দেশে আত্মসমালোচনা না করে অন্য দলের সমলোচনাই রীতি। কাউকেই দোষ না দিয়ে বলতে চাই, চেষ্টা বা উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে হয়নি। এ দেশের দুর্নীতি কমিশন একজনের দোষ আরেক জনকে চাপিয়ে তিন বছর তাকে কারান্তরালে রেখে সুস্থ জীবন কেড়ে নেয়; হ্যাঁ, জাহালমের কথাই বলছি। তবু আশাবাদী হতে চাই, হতেও হবে। দেশ কোনো এনজিও বা ক্লাব নয়, যা না থাকলে কারও তেমন কিছু আসে যায় না। কোটি কোটি মানুষের দেশ ও জাতি, বহুজীবনের বিনিময় ও ত্যাগে কেনা। আমরা চাইলে দেশ ও জাতি ভালো হবে, এর বিকল্প নেই, আর এ ক্ষেত্রে পরাজয়ের সুযোগ নেই।

দুনিয়াতে আদালতের ওপর সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার কারো নেই। এই সিদ্ধান্তে কেউ দোষী, কেউ বা ‘শূচি’ হয়। কারো জীবনের ১০-১২ বছর কাটাতে হয় কারান্তরালে। এমনকি আয়ু পর্যন্ত শেষ হয় আদালতের সিদ্ধান্তে। আদালতে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই; অন্যথায় নেমে আসতে পারে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। একজন নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড না হওয়ার জন্য এক হাজার অপরাধীর মুক্তিকে শ্রেয়তর মনে করেছেন দ্বাদশ শতাব্দীর দার্শনিক।

It is better and more satisfactory to acquit a thousand guilty persons than to put a single innocent to death. That executing a defendant on anything less than absolute certainly would lead to a slippery slope of decreasing burden of proof until we would be convicting merely, according to the judges caprice.: Maimonides (Philosopher of 12th Century)

অর্থাৎ, একজন নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার চেয়ে এক হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া শ্রেয়। সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে একজন অভিযুক্তকে মেরে ফেললে আমরা একটা পিচ্ছিল পথে পড়ে যাবো এবং শেষ পর্যন্ত, বিচারকের অভিরুচি মোতাবেকই দণ্ড হবে।
I know method to secure the repeal of bad or obnoxious laws so effective as their stringent execution. : Ulysses S. Grant, 18th American President.

আমাদের দেশে বেশ ক’বছর ধরে চলছে ‘গুমের সংস্কৃতি’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেলেও তারা অস্বীকার করে। গুম হওয়া ব্যক্তিকে আর পাওয়া যায় না, কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও মুখ না খুলে অজ্ঞাত কারণে তারা হারিয়ে যান। কাউকে হত্যা করা হলে বা মৃত্যুদণ্ড দিলে, সে ব্যক্তির লাশ অন্তত আপনজনরা ফেরত পান। এরপর বিধাতার অসীম দয়ায় দুঃখবোধ কমে আসে, স্বাভাবিক নিয়মে আবার জীবনকে বয়ে চলা শুরু হয়। কিন্তু গুম হওয়ার ক্ষেত্রে বিষয় ভিন্ন, আপনজনরা আশায় বুক বাঁধেন- এই বুঝি অজ্ঞাত স্থান থেকে আপনজন ফিরে এলো।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আশ্বাস দেন, আপনজনরা আশায় বুক বাঁধেন, স্বজন আর ফিরে না এলে আশাহত হন। লাশ পাওয়া গেলে মৃত্যু ও ওয়ারিশান সনদ নিয়ে চাকরির পাওনা টাকা কিংবা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা তুলে বা স্থাবর সম্পত্তি থাকলে জীবন চালনায় সহায়ক হয় বেঁচে থাকা আপনজনে। কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে আশার মরীচিকায় বুক বাঁধা, আবার আশাহত হয়ে বুক ভেঙে খানখান হওয়াই যেন নিয়তি। মৃত্যু নিশ্চিত না হলে গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পত্তির বিষয়ে প্রচলিত আইনানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। কবির ভাষায় ‘জনম জনম গেল আশার পথ চাহি, দু’টি আঁখি নিশি জাগে’। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মুজিব কী বলতেন বা কী করতেন সহজেই অনুমেয়। যা হোক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন, উচ্চ আদালত থেকে ‘সুয়োমোটো’ বা স্বপ্রণোদিত নির্দেশনা দেবেন বলে প্রত্যাশা করা কি একেবারেই অস্বাভাবিক ও অসম্ভব?

লেখক : আইনজীবী, মুন্সীগঞ্জ


আরো সংবাদ



premium cement