১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১, ১৩ শাবান ১৪৪৬
`

আওয়ামী লীগের ডিএনএতে ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস

লেখক : আবদুল্লাহ আল-আহসান - ছবি : নয়া দিগন্ত

[আব্দুল্লাহ আল-আহসান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী স্কলার। তুরস্কের ইস্তাম্বুল সেহর ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তুলনামূলক সভ্যতার প্রাক্তন অধ্যাপক। তিনি মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন দশক শিক্ষকতা করেছেন। সমসাময়িক ইসলামী ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কয়েকটি বই ও অনেক নিবন্ধ লিখেছেন; সম্পাদনাও করেছেন। তার রচনা আরবি, বাংলা, বসনিয়ান, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার তিন পর্বের লেখার আজ প্রথম পর্ব]

আওয়ামী লীগের ডিএনএতে ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে দাবি করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ‘শুধু ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালের জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং লগি-বৈঠা হত্যাকাণ্ড নয়, আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের পর জাসদ ও সর্বহারা পার্টির সদস্যসহ হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নিখোঁজ এবং সিরাজ সিকদারকে হত্যার পেছনে ছিল আওয়ামী লীগ। এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগের ডিএনএতে ফ্যাসিবাদ নিহিত রয়েছে,’ বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক এক আলোচনা সভায় তিনি আরো ব্যাখ্যা করে এসব কথা বলেন। বৈঠকে বর্তমান সরকারের সাথে যুক্ত বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও অংশ নেন। ডক্টর আসিফের ‘সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা প্রমাণ’ দাবিটি তাৎপর্যপূর্ণ। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায়, ‘যৌক্তিক সন্দেহের বাইরে প্রমাণ’ ধারণাটি সর্বোচ্চ মান হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এটা মনে করিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী চরিত্র নিয়ে আমার দেখা অনেক ঘটনা। তিনি বাংলাদেশের অস্তিত্বের পর ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু একজন ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি তাকে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের বাইরে নিয়ে যেতে চাই : আর আওয়ামী লীগের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি।

আওয়ামী লীগের সদস্যদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে হত্যার কথা মনে রাখার জন্য আমি খুব ছোট ছিলাম, কিন্তু আমার কলেজের সময়, আমি দেখেছি আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (ইপিএসএল) ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, সাধারণত তাদের হাতে থাকত হকিস্টিক। সেই দিনগুলোতে, আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগ এনএসএফকে সমর্থন করে, যেটি ছিল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকারী আরেকটি সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন। বামভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপিএসইউ) সেই দিনগুলোতে এনএসএফ এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর মোকাবেলায় ইপিএসএলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল।

এরপর আসে ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন; এটি একটি ব্যাপক বিদ্রোহ ছিল। যদিও সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল, তবে এটি কাউন্সিল মুসলিম লীগ নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য অনেক ছোট দল এবং আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করেছিল। আমি আমার ছোট শহরে সেই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতাম, কিন্তু আমরা যেসব স্লোগান দিচ্ছিলাম তাতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। সেই স্লোগানগুলোর মধ্যে একটি ছিল : আগুন, আগুন জ্বালাতে হবে, জ্বালাতে হবে। আন্দোলনটি আজকের মানদণ্ডে সহিংস ছিল না, তবে তা শান্তিপূর্ণও ছিল না। আইয়ুববিরোধী মিছিলের একটি মজার ঘটনা ছিল যে, আমাদের মধ্যে অনেক অচেনা মুখ ছিল, কিন্তু তারা ছাত্রলীগের ক্যাডারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল।

আমি তখন ইয়াহিয়ার শাসনামলের দুই বছরের সাক্ষী ছিলাম যেটি বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিল। একটি সাধারণ ধারণা আছে যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তব সত্য নয়। তবে, আওয়ামী লীগ ও সরকার উভয়ই এই উপলব্ধিকে জোরালোভাবে রক্ষা করেছে। দীর্ঘ প্রচারণার সময়জুড়ে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা বিরোধীদের মিছিল ও সমাবেশে নাশকতা করেছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭০-এ, যখন ঢাকার পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় হামলা হয়েছিল, যেখানে দুই ব্যক্তি নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। জামায়াতের প্রধান সাইয়্যেদ মওদূদীর সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থিত শ্রমিক ও ছাত্ররা আক্ষরিক অর্থেই মাঠে আক্রমণ করে। সরকার এবং মূলধারা উভয়ই এই ঘটনায় জড়িত ছিল। এই আচরণ নির্বাচনী প্রচারের পুরো সময়জুড়ে অব্যাহত ছিল।

সময়ের সাথে সাথে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী চরিত্র আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নির্বাচনের দিন, আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা পূর্ব পাকিস্তানের অনেক স্থানে অ-আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আরো সহিংসতার ঘটনা ঘটে। যদিও পাকিস্তান সরকার ১ মার্চ থেকে সংঘটিত সহিংসতার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী ছিল। তবে বাঙালি সহিংসতাবাদীদের একটি অংশের দ্বারা সৃষ্ট উসকানিকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। তখন পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীর অবাঙালি কর্মীরা এবং তাদের পরিবারগুলো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং প্রদেশের বিভিন্ন অংশে অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অনেক জায়গায় বিহারি নামে পরিচিত অবাঙালি নাগরিকরাও সহিংসতার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। একটি মৃতপ্রায় বেসামরিক প্রশাসন তখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে এবং এক ধরনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পর গৃহযুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপ নেয়। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা উচিত যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আলজেরিয়ার স্বাধীনতার যুদ্ধ বা ফিলিস্তিনে আজ আমরা যে স্বনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করছি তার থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। অনেক বিহারি পরিবার জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়, যা ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে আরম্ভ হয় আর ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কয়েক মাস ধরে তা অব্যাহত ছিল। আজমত আশরাফের রিফিউজিতে এমন অনেক করুণ কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায়। আমি নিশ্চিত নই যে, ডক্টর আসিফের শ্রোতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ঠগচরিত্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবগত কি না।

এ প্রসঙ্গে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কিছু বাংলাভাষী ব্যক্তি যে আচরণের সম্মুখীন হয়েছিল তা আমি উপেক্ষা করতে পারি না। অনেক নামের মধ্যে নেজামে ইসলাম পার্টির মৌলভী ফরিদ আহমদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নাম আমাকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করে। একজন সুগভীর পণ্ডিত ও সংসদ সদস্য ফরিদ আহমদকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন পর অধ্যাপক সাজ্জাদের ‘লাশ’ গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে রাখা হয়। তবে তিনি ‘একাত্তরের স্মৃতি’ লেখার জন্য হয়তো অগ্নিপরীক্ষা থেকে বেঁচে যান।

আওয়ামী লীগ ও এর সমর্থকরা বাংলাদেশের ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করেছে। আমি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশ্ব ইতিহাস পড়িয়েছি, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের মতো বিকৃত অন্য কোনো ইতিহাস আমার কাছে এখনো আসেনি। আমি দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করছি যে, বর্তমান সরকার ইতিহাসের পাঠ্যক্রম সংশোধনের কাজটি গ্রহণ করবে। সম্প্রতি, সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু সরকার যদি নিষেধাজ্ঞার জন্য পর্যাপ্ত বৈধ কারণ না দেয় তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ব্যাকফায়ার হতে পারে। ইতিহাস পাঠ্যক্রমের একটি পুনর্বিবেচনা, যা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (এর পূর্বসূরি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগসহ) জঘন্য ইতিহাসকে যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবিকভাবে নথিভুক্ত করে নিষেধাজ্ঞার জন্য নিখুঁত ঐতিহাসিক পটভূমি এবং যুক্তি প্রদান করতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement