১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১, ১৩ শাবান ১৪৪৬
`

আইটি খাতের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাত বিগত দশকে দ্রুত বিকশিত হয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই খাতটি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বিগত সরকারের ব্যাপক লুটপাটের কারণে তথ্যপ্রযুক্তিতে সরকারের তেমন অগ্রগতি হয়নি, বেসরকারি উদ্যোগে এটি বেশ এগিয়েছে।

বর্তমান অবস্থা
আইটি শিল্পের অবদান : বাংলাদেশের জিডিপিতে আইটি এবং আইটিইএস (IT-enabled Services) খাতের অবদান ১ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালে আইটি খাত থেকে রফতানি আয় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।

ফ্রিল্যান্সিং এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি : বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সারভিত্তিক দেশ। প্রতিভাবান যুবকদের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে প্রযুক্তি স্টার্টআপ যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ফিনটেক এবং ই-কমার্স খাতে কাজ করছে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন : বিভিন্ন আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যেমন LICT প্রকল্প এবং কোডিং স্কুলের মাধ্যমে তরুণদের দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : সরকার ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে আইটি রফতানি আয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে। বীমা, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ডিজিটালাইজেশনের চাহিদা বাড়ছে।

এআই এবং অটোমেশনের ভূমিকা : এআই, মেশিন লার্নিং এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি সংক্রান্ত সেবা প্রদান করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণ : ই-গভর্ন্যান্স, স্মার্ট সিটি এবং ডিজিটাল শিক্ষা খাতের মতো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় আইটি খাত আরও বিস্তৃত হবে। হাইটেক পার্ক ও স্টার্টআপদের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা চলছে। বিদেশী বিনিয়োগ এলে খাতটি আরও বিকশিত হবে।

অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক : আইটি খাত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বেকারত্ব নিরসনে ভূমিকা রাখছে। ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির কারণে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রফতানি আয়ের নতুন খাত হিসেবে আইটি তৈরি করছে এক শক্তিশালী ভিত্তি। আইটিসংক্রান্ত বিভিন্ন পরিষেবা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

টেকসই উন্নয়ন : পরিবেশবান্ধব ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করছে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে আইটি খাত ভবিষ্যতে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে। দক্ষ মানবসম্পদ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বিদেশী বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়ে আইটি খাতের সম্ভাবনা সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো সম্ভব।

আইটি শিল্পের বর্তমান অবদান : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আইটি খাতের ভূমিকা ধীরে ধীরে বাড়ছে। দেশের লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার প্রতি মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সারের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

হাইটেক পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার : ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে দেশে আরও ১২টি হাইটেক পার্ক চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (BHTPA)-এর তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী বিভিন্ন হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য পার্ক : কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক (গাজীপুর) : এটি দেশের প্রথম হাইটেক পার্ক, যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।

যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক : আইটি স্টার্টআপ এবং সফটওয়্যার ডেভেলপারদের জন্য একটি অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন পার্ক হওয়ার কথা যা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।

সিলেট হাইটেক পার্ক : সিলেট অঞ্চলে আইটি খাতের প্রসারের জন্য এটি প্রয়োজন।

ইনকিউবেশন সেন্টার : তরুণ উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। এসব সেন্টারে প্রশিক্ষণ, ফান্ডিং এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হয়।

ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা : বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ ইউনিয়ন ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ১৩ কোটির বেশি হয়েছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবা ভারতনির্ভর হওয়ার কারণে দেশের ব্যান্ডউইথড শিল্প মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশকে অবশ্যই নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার পরিবার, লেস পেনসার এবং ভারতকে কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হাতে তুলে দিয়েছে যেখানে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : ক্লাউড কম্পিউটিং, এআই ও ব্লকচেইনভিত্তিক সেবা সম্প্রসারণের জন্য আরো অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করা হবে। প্রযুক্তি পার্ক এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশের আইটি খাত দ্রুত একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।

ফ্রিল্যান্সিং এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সারভিত্তিক দেশ। প্রতিভাবান যুবকদের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে প্রযুক্তি স্টার্টআপ, যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ফিনটেক এবং ই-কমার্স খাতে কাজ করছে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ : LICT প্রকল্প (Learning and Earning Development Project) : লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও ফিনটেক প্রতিষ্ঠান ফ্রিল্যান্সারদের সহজে পেমেন্ট গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে।

স্টার্টআপ সংস্কৃতি : প্রতিভাবান যুবকদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রযুক্তি স্টার্টআপের উত্থান ঘটছে। উল্লেখযোগ্য স্টার্টআপ সেক্টরের মধ্যে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (অও) : ডাটা অ্যানালিটিক্স, চ্যাটবট।

ফিনটেক : যেমন বিকাশ, নগদ এবং অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম। ই-কমার্স : যেমন দারাজ, চালডাল এবং শপআপ।

স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের উন্নতি : স্টার্টআপদের জন্য বিভিন্ন ইনকিউবেশন সেন্টার এবং এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম চালু হয়েছে।

বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য BD Venture Ges Startup Bangladesh Limited প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্বজয়ী উদ্যোগ : বাংলাদেশের কিছু স্টার্টআপ আন্তর্জাতিক বাজারেও সুনাম অর্জন করছে, যেমন Pathao, Shohoz। বেসরকারিভাবে AI এবং IoT-ভিত্তিক উদ্ভাবন আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ফ্রিল্যান্সিং এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং তরুণ সমাজের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভিন্ন আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যেমন খওঈঞ প্রকল্প এবং কোডিং স্কুলের মাধ্যমে তরুণদের দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে। আইটি খাতে জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে। তরুণদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার লক্ষ্য নিয়েই এই কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

আইটি প্রশিক্ষণ উদ্যোগ
LICT প্রকল্প (Learning and Earning Development Project)
উদ্দেশ্য : তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দিয়ে আয়ক্ষম করে তোলা। অর্জন : এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০,০০০ জন তরুণ এই প্রকল্পের মাধ্যমে আইটি এবং আইটিইএস খাতে দক্ষতা অর্জন করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র : ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডাটা অ্যানালিটিক্স, ডিজিটাল মার্কেটিং।

কোডিং স্কুল এবং বুটক্যাম্প : স্কুলের কার্যক্রম : তরুণদের প্রোগ্রামিং ভাষা শেখানো এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে দক্ষ করে তোলা। উদাহরণ : ইন্টারন্যাশনাল কোডিং স্কুল, কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ।

বুটক্যাম্প : বেসরকারিভাবে স্বল্প সময়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, যেমন মেশিন লার্নিং, এআই এবং ক্লাউড কম্পিউটিং শেখানোর উদ্যোগ। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ : ডিজিটাল ল্যাব : স্কুল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য প্রায় ১০ হাজার ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করার কথা। আইসিটি ডিভিশনের উদ্যোগ : সরকারি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষকে প্রশিক্ষিত করার কথা ছিল, কিন্তু ব্যাপক লুটপাটের জন্য লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় যা থাকা উচিত
এআই এবং মেশিন লার্নিং শিক্ষা : ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি, যেমন এআই, রোবোটিক্স এবং ব্লকচেইনভিত্তিক সেবা প্রদানের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রসার : গ্রামের তরুণদের আইটি দক্ষতা উন্নয়নের জন্য স্থানীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। গ্লোবাল মার্কেট ফোকাস : প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করা।

মানবসম্পদ উন্নয়নে এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের নামে জনগণের ঞবী-ঠধঃ এর টাকা ব্যাপক লুটপাট ও দেশের বাইরে পাচার হয়, হাসিনা সরকারের মদদে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ওঞ খাতে অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গেছে, সরকারি উদ্যোগে নতুন করে এই খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।

লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি


আরো সংবাদ



premium cement