০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১, ৯ শাবান ১৪৪৬
`

স্বৈরাচারের পরিণতি বড় নির্মম

-

স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বে দু’টি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। একটি ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন, অন্যটি একই বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পলায়ন। এমন ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে অনেকবার ঘটেছে। ২০২২ সালের ১৩ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে এবং ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পলায়ন করেন। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী পালিয়ে যান এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১২ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ পালিয়ে যান। জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধেই এরা ক্ষমতাচ্যুত হন। এদের সবারই পরিণতি অত্যন্ত নির্মম, অপমানজনক এবং শোচনীয়। এরা সবাই জালিম এবং স্বৈরশাসক ছিলেন। এদের কেউ কেউ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও পরে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছেন। এরা জনগণের প্রতি জুলুম করেছেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন। এরা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেন এবং জনগণের ওপর নির্যাতন চালান। কিন্তু কারোই শেষ রক্ষা হয়নি। জুলুম নির্যাতন এবং দমননীতি চালিয়ে ক্ষমতা কিছু দিনের জন্য দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হলেও, শেষে জনতার প্রতিরোধের মুখে চরম অপমানের সাথে বিদায় নেন।

স্বৈরাচারের পরিণতি কখনোই ভালো হয় না। এটা ইতিহাসের অনিবার্য সত্য এবং নির্মম বাস্তবতা। তবু কিছু মানুষ এই চিরন্তন সত্য ভুলে যায়। তারা পৃথিবীতে প্রভাব প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যায়। এরা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আইন মানে না এবং অন্যের অধিকার হরণ করে এবং শক্তির জোরে মানুষকে শাসন করে জালিমে পরিণত হয়।

কিন্তু দম্ভ এবং অহঙ্কারের মাধ্যমে তারা যে নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে চায় না। অবশেষে একদিন ধ্বংসের মুহূর্তটি এসে যায়। সবকিছু হারানোর পর তিনি ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু তখন আর শোধরানোর সময় থাকে না। ধ্বংসই হয় তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি, যা তাকে ভোগ করতেই হয়।

সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানুষের মধ্যে সত্য-মিথ্যা লড়াই বিদ্যমান। কিছু মানুষ মনুষ্যত্ব ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে ন্যায় ও সত্যকে বর্জন করে এবং অন্যায় ও মিথ্যার পথে চলে। কিছু মানুষ মনুষ্যত্ব এবং বিবেক দিয়ে চালিত হন। তারা অন্যায় ও মিথ্যাকে বর্জন করে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে চলেন। ন্যায় ও সত্যপন্থীদের সাথে অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের সব সময় দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত চলে। অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীরা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সবসময় ন্যায় ও সত্যের অনুসারীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্যপন্থীদের বিজয় হয় এবং অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের পরাজয় হয়। অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়, অপমান এবং লাঞ্ছনা। ইতিহাসের এই নিয়ম বহতা নদীর মতোই বয়ে চলছে। ফেরাউন-হজরত মুসা আ:, নমরুদ- হজরত ইবরাহিম আ:-এর দৃষ্টান্ত সবারই জানা। শেষ পর্যন্ত ফেরাউন, নমরুদের কী করুণ পরিণতি হয়েছে সেটি ইতিহাসের সত্য। আবু জেহেল এবং আবু লাহাবরা সবসময় হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর জুলুম নির্যাতন করেছে। তারাও করুণ পরিণতি ভোগ করেছে।

যুগে যুগে সব স্বৈরাচারেরই এরকম করুণ পরিণতি হয়েছে এবং তারা সবাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এরা মানুষের ভালোবাসা এবং সম্মান অর্জন করতে পারেনি; বরং ঘৃণা এবং অসম্মানই অর্জন করেছে ।

কিছু মানুষ সবসময় বিজয়ী হতে চায়। বিজয়ী হওয়ার জন্য তারা আইন-কানুন লঙ্ঘন করে এবং সত্যকে হত্যা করে। কিন্তু সব বিজয় বিজয় নয় এবং সব পরাজয় পরাজয় নয়। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে পরাজিত হলেও তা আসলে বিজয় এবং মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে চলে বিজয়ী হলেও তা আসলে পরাজয়। কারবালায় ইয়াজিদ এবং পলাশীতে মীরজাফর বিজয়ী হলেও, তারা আসলে পরাজিতই হয়েছে। এ জন্য বিশ্বজুড়ে ইয়াজিদ এবং মীরজাফর অতি ঘৃণিত। কোনো বাবা-মা তার সন্তানের নাম ইয়াজিদ এবং মীরজাফর রাখে না। কিন্তু ইমাম হোসাইন (রা:) এবং সিরাজউদ্দৌলা সেদিন পরাজিত এবং মৃত্যুবরণ করলেও, দু’জনেই বিশ্বজুড়ে অতি সম্মানিত এবং মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাদের স্মরণ করে। সন্তানের নাম ইমাম হোসাইন ও সিরাজউদ্দৌলা রাখে।

প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন, অবিচার এবং তাদের অধিকার হরণ করলে এর পরিণতি ভোগ করতেই হবে। যেভাবেই হোক এর প্রায়শ্চিত্ত জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে করতেই হবে। মানুষের ওপর জুলুম চালিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এটাই ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য। তাই প্রত্যেকেরই উচিত সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করা, মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করা। জুলুম এবং অবিচার কেবল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এবং সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাই করে তা নয়। নিজ নিজ অবস্থানে সবাই কিন্তু ক্ষমতাবান। কারো ক্ষমতা ছোট এবং কারো বড়। সবাইকে নিজস্ব পরিমণ্ডলে অধীনস্থদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সর্বত্রই শান্তি বিরাজ করবে। সবার জীবনই সুন্দর এবং সুখের হবে। স্বৈরাচারী হয়ে মানুষের প্রতি অবিচার করলে নিশ্চিতভাবেই নির্মম ও করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে । এ ধ্রুব সত্যটি সবারই বোঝা দরকার।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement