০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`

আত্মহত্যা ঠেকাতে পরিবারের ভূমিকা অগ্রণী

-

সবার অগোচরে দেশে নতুন এক স্বাস্থ্য সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জীবন যন্ত্রণায় ব্যস্ত থাকায় অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটি। এমনকি চিকিৎসক ও সমাজ কর্মীরাও এ ব্যাপারে অনেক সময়ই খেয়াল করে উঠতে পারেন না। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার ফাঁকে কোন সময় এ সমস্যাটি বাড়ছে টের পাওয়া যাচ্ছে না। জীবনাচারের জটিলতার কারণে ভবিষ্যতে এটি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে। সমস্যাটি হচ্ছে আত্মহত্যা।

১৮ জানুয়ারি আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করেছে। কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি এ ব্যাপারে তাদের তথ্যানুসন্ধানের ফলাফল নিয়মিতভাবেই প্রকাশ করে আসছে। তাদের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, এ দেশে অল্পবয়স্কদের বিশেষ করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে, যা সামাজিক ও পারিবারিক প্রথা ভঙ্গুর হওয়ার একটি লক্ষণ। ২০২৪ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছিল ৩১০ জন ছাত্রছাত্রী। এর প্রায় অর্ধেক ৪১.৪ শতাংশই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। এদের মধ্যে ছাত্রী ৬১ শতাংশ, ছাত্র ৩৮.৪ শতাংশ। কলেজ পড়ুয়াদের সংখ্যা ২৩.২ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের সংখ্যা ১৭.৭৪ শতাংশ। ১৩ থকে ১৮ বছর বয়সীদের সংখ্যা ৬৫.৭ শতাংশ। সংস্থাটি জানিয়েছে, আত্মহত্যার প্রধান কারণ হচ্ছে অভিমান। মা-বাবা, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবদের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে ১৮.৪ শতাংশ। মা-বাবা বা অন্যদের কাছ থেকে আবদারের বিপরীতে গঞ্জনা ও বকুনি খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার সংখ্যা বেশি।

ঢাকা মহানগরী তথা ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। পড়ালেখার চাপে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ১৪.২ শতাংশ। মানসিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ৫.৫ শতাংশ। প্রকাশিত তথ্যে একটা বিশেষ দিক উঠে এসেছে, তা হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের ভেতর মনোদৈহিক পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে এ সময়ে শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোনের নিঃসরণ এবং তার প্রভাবে কিশোর-কিশোরীদের ভেতর মানসিক অস্থিরতা তাদেরকে অভিমানী প্রকৃতির করে থাকে। সামান্য কিছুতেই তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে যেসব পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক শিথিল এবং পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধের অভাব, সেসব পরিবারের কিশোর-কিশোরীরা পারিবারিক অশান্তি ও অস্থিরতার কারণে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। অন্য দিকে এ সময়েই তাদের ওপর মা-বাবা, শিক্ষক, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের একটা চাপ লক্ষ করা যায় পড়াশোনার ব্যাপারে। পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করতে না পারলে শুনতে হয় মা-বাবার বা অভিভাবকের বকুনি। একসময় ব্যর্থতার গ্লানি, মা-বাবার বকুনি মানিয়ে নিতে না পারায় প্রচণ্ড অভিমান তাকে নিয়ে যায় আত্মহত্যার পথে।

আরো একটি তথ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এর আগের প্রতিবেদনে। যেসব পরিবারে ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলন ও আদর্শিক আবহ রয়েছে, সেসব পরিবারে আত্মহত্যার প্রবণতা কম। লক্ষণীয়, মাদরাসাছাত্রদের মধ্যেও এই প্রবণতা খুবই কম। মনোদৈহিক গঠনে পূর্ণতা ও মানসিক স্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এর প্রবণতা কম। এর আর একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।

স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যা প্রবণতা ঠেকাতে হলে প্রথমে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের অভিভাবকদের সময় দিতে হবে কিশোর-কিশোরীদেরকে। তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে বন্ধুর, সহযোগীর, সহযাত্রীর। অবিভাবকদের উচিত পরিবারের সাথে সময় ব্যয় করা। সবাইকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই বেড়াতে যাওয়া; পরিবারে অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার প্রচলন, গল্প বলা, কবিতার আসর প্রভৃতির ব্যবস্থা করা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের মানসিক গঠন এবং আত্মবিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি করা। কোনো বিষয়ে বিশেষ করে লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো রকম অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা। তাদের ভূমিকা পরামর্শ ও মন্তব্যকে গুরুত্বের সাথে নেয়া। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি এর অভাবে। কিশোররা যখন কোথাও কিছু করতে পারে না অথবা করার সুযোগ পায় না, তখনই তারা কিশোর গ্যাংয়ের খাতায় নাম লেখায়।

কিশোর-কিশোরীদের এ প্রবণতা থেকে ফেরাতে হলে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সাথে সাথে পরিবারকেন্দ্রিক ধর্মীয় ও নৈতিক চিন্তা ধারার প্রবর্তন অপরিহার্য। স্কুলের শিক্ষকদেরও এক্ষেত্রে রয়েছে বিরাট গঠনমূলক ভূমিকা। যেকোনো ছাত্রছাত্রীর ভিন্নমুখী আচরণ তারাই সবচেয়ে আগে বুঝতে পারেন। প্রতিটি উচ্চ বিদ্যালয়ে, মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নৈতিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি এই প্রবণতা কমানোর ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করতে পারে নিঃসন্দেহে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement