সংস্কারে প্রয়োজন দেশপ্রেম ও সততা
- মুহাম্মাদ শাহ আলম
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:১৮
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের দুটো সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদি কম সংস্কার হয়, সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিয়ে আমরা আরো বেশি কিছু সংস্কার করিয়ে নেবো সেক্ষেত্রে ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচনের কথা তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন। সত্যিকার অর্থে আমরা যে খুব বেশি সময় নিচ্ছি তা তো না। খুবই যুক্তিযুক্ত একটা সময়ের কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। অন্য দিকে বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে সংস্কার দরকার, পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মনে করেন। তিনি বলেন, যেহেতু নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে সেহেতু ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে আসার আহ্বান জানান তিনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব:) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপি চায় এ বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হোক। তিনি আরো বলেন, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী সংস্কারের নামে সময় কাটাচ্ছে। সংস্কার করবে জাতীয় সংসদ। জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়ন করেছে আবার জনপ্রতিনিধিরা সেটা সংস্কার করবে।
বস্তুত গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশবাসীর মাঝে এক ধরনের প্রত্যাশা ও স্বপ্নের সৃষ্টি হয় যে মানুষ তাদের হারানো রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আকাক্সক্ষা অনুসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক একটি সমাজ গঠন করা হবে। নিশ্চিত করা হবে বিগত ১৬ বছরের গুম-খুন, লুটপাট, গায়েবি মামলা- হামলা, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যাকারীদের বিচার। অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল তার অবসান ঘটিয়ে অবৈধ নির্বাচন আয়োজকদের বিচারের আওতায় আনা হবে। সর্বোপরি দেশবাসী ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির মাধ্যমে ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু গত ৫ মাসে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা গেলেও দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে অন্যান্য সেক্টরে হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে সংস্কারকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। পরে গত ১৮ নভেম্বর নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশসংক্রান্ত রিপোর্ট প্রদানের জন্য ৯০ দিনের সময় দেয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। জানুয়ারি মাসের মধ্যে কয়েকটি কমিশনসহ মোট ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের কাজ শেষ করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশ হস্তান্তর করেছে। পরে এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সমন্বয় করতে তাদের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।
কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবেন। আলোচনায় যেসব প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দু’বারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, চার বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন করা, জাতীয় সংবিধান পরিষদ গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বর্তমান প্রচলিত সংবিধান সংশোধন করে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রচলিত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ আছে। সংস্কার কমিশন এই চার মূলনীতির পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র এই পাঁচ মূলনীতি করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার সুপারিশ করছে।
যেখানে বিদ্যমান কাঠামোয় প্রয়োজনে কিছু সংস্কার করে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে এবং সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জণগণের কাক্সিক্ষত শাসনব্যবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব সেখানে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো জণগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নিম্নকক্ষে ৪০০টি ও উচ্চকক্ষ ১০৫ জন সর্বমোট ৫০৫ জন সদস্য করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করার সুপারিশ রেখেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ জন নির্বাচিত হবেন ১ শতাংশের বেশি ভোট যারা পাবে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসাবে। মোট ১০৫ জনের মধ্যে পাঁচজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি।
অন্য দিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবী প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করা। অর্থাৎ কমিশন যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচনে নিম্নকক্ষ এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে নির্বাচনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। আবারো সেই পুরনো মনোনয়ন বা কোটার খেলা। যে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে সেই কোটার পুনঃপ্রবর্তন! কিন্তু কেন? তা ছাড়া নিম্নকক্ষ যদি ৪০০ আসন নিয়ে হয় এবং নির্বাচনী এলাকা যদি ৩০০ থাকে তবে অবশিষ্ট ১০০ নারী সদস্যের এলাকা নির্ধারণ ও কাজকর্ম নিয়ে দ্বন্দ্বের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
অপর দিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে দেশের পুরনো চারটি বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাকে নিয়ে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা-কৃষ্টি কালচার কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় এক ও অভিন্ন। এই অবস্থায় প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা কি জরুরি? তা ছাড়া যে চার বিভাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন করা হয় তবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রদেশের মানুষের জীবন মান কেমন হবে?
যখনই সাবেক চার বিভাগ নিয়ে চার প্রদেশের বিষয়টি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে তখনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুটি। স্বাধীনতার পর থেকে যেসব দেশী বিদেশী শক্তি পার্বত্য অঞ্চলে অশান্তির বীজ বপন করেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে কুকি-চিনকে ব্যবহার করে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তারা প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা প্রদেশ, একপর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা দাবি করে বসতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের পাহাড়ি এলাকা এবং মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনার চেষ্টা চলছে বলে কিছু দিন ধরে প্রচারণা শোনা যাচ্ছে। অতীতেও পার্বত্য জনপদ নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী জুমল্যান্ড আন্দোলনের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। যদি প্রদেশ গঠন করা হয় তবে এই দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এতে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা হুমকিতে পড়তে পারে।
বস্তুত সংস্কার নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় চললেও এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। বর্তমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছাড়া ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন অসম্ভব। যদিও সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা বিদ্যমান। যা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। তবে শুধু আইন প্রণয়ন শেষ কথা নয়। এই আইন বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা ও দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা