বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় জ্বালানি নির্ভরতা বাড়ানো
- এ বি সিদ্দিক
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:২৭
সরকারি হিসাবে দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট (সূত্রঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃত উৎপাদন কত? গত ১৮ জানুয়ারি/২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র, সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। তাহলে চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি দাঁড়াল ৭ হাজার মেগাওয়াট।
শীত মৌসুমেও দেশে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় যদিও কম, গ্রামে বেশি। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বলছে, তাদের চাহিদা ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট; বিপরীতে সরবরাহ প্রায় ৮ হাজার মেগাওয়াট। যদিও অনেকে প্রকৃত হিসাব নিয়ে গরমিল আছে বলে মনে করেন।
বিপিডিবির তথ্য, গত সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারি বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে ১৫ বছরে ১৩ বার বিদ্যুতের (১২১ শতাংশ) দাম বাড়িয়েছে লোকসান ও ভর্তুকি কমাতে। কিন্তু লোকসান ও ভর্তুকি বেড়েই চলেছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে যথাক্রমে ৩ কোটি ৯৩ লাখ এবং ১৪৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা মুনাফা দেখানো হলেও প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা লোকসান দেখানো হয়েছে।
এ দিকে বিশাল অঙ্কের টাকা বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া রেখে গেছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার। বেসরকারি সংস্থার কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)।
টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না সরকার। অন্য দিকে ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশী কোম্পানিগুলোর পাওনা। এমন পরিস্থিতিতে মার্চে গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রয়োজনীয় বাড়তি গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আসলে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ খাতে সঙ্কট পুঞ্জীভূত করা হয়।
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেগুলো না করতে গত দেড় দশক ধরে বলা হচ্ছিল। কিন্তু পতিত সরকার তা অগ্রাহ্য করেছে। এর ফলে নানামুখী অভিঘাতের শিকার হতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার তেলের রিফাইনারি করে এস আলম গ্রুপের সাথে। এটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। গত সরকারের ভুল ও অদূরদর্শিতায় এ সঙ্কট ডেকে আনা হয়েছে; যা উত্তরণের চেষ্টা না করলে সঙ্কট আরো তীব্র হতে পারে।
হাসিনা সরকারের দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন তৈরি এ খাতে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতাহীন করে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়েছে। মুনাফা অর্জনকারীদের সুযোগ বাড়িয়েছে। এ খাতে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি করা হয়েছে। এটা অন্যায়-অযৌক্তিক হলেও শুধু বিনিয়োগকারী ও তাদের নেপথ্যে দৃশ্যে-অদৃশ্যে থাকা কমিশনভোগীরা এতে লাভবান হয়েছেন।
সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎসহ এলপিজি, এলএনজি ও কয়লার মতো জ্বালানির মূল্য বাড়ানোয় উৎপাদনকারীরা এটা কত দামে উৎপাদন করছেন এবং সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন সেগমেন্টে যে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে; সেটি যৌক্তিক হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করা দরকার। উপরন্তু বিইআরসি আইন পরিবর্তন করে সেখানে গণশুনানি রহিত করে প্রতি মাসে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তও ছিল আত্মঘাতী।
সরকারি মালিকানাধীন যেসব কোম্পানি আছে সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হয়। সেসব কোম্পানির মালিকানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা অবতীর্ণ হওয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে।
জ্বালানি খাতে উৎপাদন খরচ যেটা বেড়েছে সেটা এলএনজি আমদানি করায় এবং সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ও ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে। বিষয়টা অনিবার্যও ছিল না। এমন যদি হতো যে ঋণ না নিয়ে, এলএনজি না এনে আর কোনো উপায় ছিল না তাহলে একটা যুক্তি ছিল। রাজনৈতিক কারণে দেশী-বিদেশী কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে খুশি করতে গত সরকার এটা করেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে দেনার কথা বলা হচ্ছে; এর আসল পরিমাণ আরো বেশি হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক বিদ্যমান রয়েছে। এর ভেতর বিদেশী অর্থে অর্থাৎ ডলারে প্রাপ্ত দেনা আছে। আবার দেশে যারা আছেন তাদেরও বকেয়া পাওনা রয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করলে পরিমাণটা হয়তো আরো বেশি হবে। এখন বন্ড ছাপিয়ে সরকার টাকার চাহিদা আংশিকভাবে মেটানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু ডলারের যে সঙ্কট, সেটা পাওয়া কষ্টকর। উপরন্তু সরকার ঋণ নিয়ে এ ডলার পাওয়ার চেষ্টা করছে। অথবা কাউকে রিকোয়েস্ট করা হচ্ছে ডিলে পেমেন্টে। দুটোর কোনোটি এ মুহূর্তে কিংবা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। এ জন্য বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ শর্তে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের জ্বালানি আমদানিতে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক দিকে বিপুল অর্থ অনাদায়ী থাকায় রিজার্ভের যে পরিমাণের কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃত অর্থে নিট রিজার্ভ তার চেয়ে অনেক কম বলে আশঙ্কা করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তার মানে বৈদেশিক লেনদেনে আগামী দিনগুলোতে আরো চাপ তৈরি হতে পারে, টাকার বিনিময় হার আরো দুর্বল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এবার আসা যাক বিদ্যুতের জ্বালানি বিষয়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস গ্যাস। সরকারি হিসাবে ৪৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলার সূত্র বলছে,বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা ২ হাজার ৪২০ মিলিয়ন হলেও সরবরাহ করা যাচ্ছে মাত্র ৮৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক)। অন্য দিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ যার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩ লাখ টন। সেখানে সরবরাহ করা হয় এক লাখ ৭০ হাজার টন। কাজেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ কম।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র মতে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাত থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন কোম্পানি। প্রতিযোগিতা এড়িয়ে, যেমন খুশি তেমন দামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিক্রির মাধ্যমে লুটপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ক্যাবের দাবি, শুধু ২০২২ সালে বিদ্যুৎ খাতে লোপাট হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ সমস্যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যে সম্ভাবনা আছে, সেটি অর্জিত হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না। যেসব শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু আছে সেগুলোও তার পূর্ণক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। অপ্রতুল জ্বালানি সরবরাহে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে। বিনিয়োগের চিত্র খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি (গ্যাস, কয়লা) সঙ্কট আর প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন না থাকা। পিডিবির সূত্র মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট আছে মোট ১৮২টি, যার মধ্যে বন্ধ আছে ৪৮টি। বন্ধ ইউনিটের মধ্যে বেশির ভাগ বেসরকারি। এসব ইউনিটের মধ্যে বেশির ভাগ বন্ধ রয়েছে জ্বালানির অভাবে। এ ছাড়া বেসরকারি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, সেগুলো একেবারে অধিকাংশ উৎপাদনে যায়নি। যেমন সামিট গ্রুপের সব ক’টি বন্ধ, যেগুলো উৎপাদনেই যায়নি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ সঙ্কট অদূর ভবিষতে আরো জটিল আকার ধারণের তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এ সঙ্কট মোকাবেলায় জ্বালানি নির্ভরতা বাড়াতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা