২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭ মাঘ ১৪৩১, ২০ রজব ১৪৪৬
`

ইকবালের নোবেল পাওয়ার দরকার ছিল না

-

আপনি প্রতিদিন কোনো না কোনো ব্রেকিং নিউজ শোনেন। অধিকাংশ সময় ব্রেকিং নিউজ আগে থেকেই অস্থির থাকা হৃদয়কে আরো অস্থির করে তোলে। অনেক দিন পর আমি এমন ব্রেকিং নিউজ পাই, যা নিরাশার অন্ধকারে আশার আলো হয়ে ঝলমল করছিল। এ ব্রেকিং নিউজ কারো কাছ থেকে শোনা নয়, বরং সেটা আমি নিজ চোখে দেখেছি এবং অনুভব করেছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের তত্ত্বাবধানে দশম ইসলামাবাদ লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে প্রচুর সংখ্যক এমন তরুণ-তরুণী চোখে পড়ল, যারা বহু বই পড়ে ফেলেছেন এবং তারা আরো পড়তে চান। পাকিস্তানি যুবকদের কথাসাহিত্য, কাব্য ও ইতিহাসের গ্রন্থের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় হচ্ছে। ইসলামাবাদ লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে জেহরা নিগাহ ও কিশওয়ার নাহিদের কাব্যকীর্তি নিয়ে তরুণদের ঝাঁপিয়ে পড়া বলছিল, উন্মাদনা শুধু প্রতিষ্ঠিতই হয়নি, বরং দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ আকারে রীতিমতো জ্বলে উঠছে। বাতাসের একটি ঝাপটা ওই স্ফুলিঙ্গকে আগুনে পরিণত করতে পারে। শাফকাত নাগমির ‘সাত জনম’ উপন্যাসের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আসগর নাদিম সায়্যেদ গণতন্ত্রকে বারবার বন্দী করে রাখা ব্যক্তিদের ধমক দিয়ে বলেন, মানলাম, তোমরা অনেক শক্তিশালী। আর আমরা তোমাদের নাম নিয়ে তোমাদের নিন্দা করতে পারব না। চিন্তা করো না, আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে রূপক শব্দের ব্যবহার বাড়িয়ে দেবো। এ হুমকি প্রদানের পর পুরো লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল করতালিতে গর্জে ওঠে। তিন দিনব্যাপী লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে ইকবাল দিবসের ওপর সেশনে প্রফেসর ফতেহ মুহাম্মদ মালিক বলেন, আজ পাকিস্তানে যা কিছু হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক তামাশা। এটাকে আমরা জনগণের রাষ্ট্র বলতে পারি না। এক প্রবীণ বুদ্ধিজীবীর মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো তরুণদের কাছে যেভাবে গ্রহণযোগ্যাতা পেয়েছে, তাতে ওই সব ক্ষমতাবান ব্যক্তির জন্য ভাবনার বিষয় এটা যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের স্বপ্নের বাস্তবায়ন আখ্যা দিয়ে তারা কেবল জাতিকে নয়, বরং নিজেরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। এ লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে উর্দু ভাষার কবিদের পাশাপাশি পশতু, পাঞ্জাবি ও অন্য ভাষার কবিদেরও চোখের সামনে বসানো হয়েছিল।

বেলুচ, সিন্ধি, সারাইকি, বাল্টি ও কাশ্মিরি তরুণেরা ভাষাগত ও প্রাদেশিক জাতীয়তা থেকে ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তাভাবনায় পাহারা বসানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ দেখা গেল। বোরকা পরা এক পাখতুন ছাত্রী আমাকে বললেন, তিনি কয়েক বছর ধরে আমার কলাম পড়ছেন। ওই ছাত্রী অভিযোগ করলেন, আপনার কিছু কলামিস্ট সহকর্মী নিজেদের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য অকারণে আল্লামা ইকবালের সমালোচনা করেন। আপনি কখনো জবাব দেন, আবার কখনো দেন না। ছাত্রীটি বললেন, কিছু দিন আগে আপনার এক সহকর্মী দৈনিক জংয়ে লিখেছেন, ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, অথচ আল্লামা ইকবাল পাননি। এর কারণ ঠাকুর বড় কবি। ওই ছাত্রী অভিযোগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, আপনি এ ব্যাপারে কিছু লেখেননি। ছাত্রীটির কণ্ঠে বিদ্যমান কষ্ট আমার সব মনোযোগ গুটিয়ে ফেলে। আমি ওই মেধাবী মেয়েকে বললাম, কিছু ছোটো মানুষ নিজেকে বড় করে দেখানোর জন্য শুধু ইকবালের ব্যাপারেই মিথ্যা বলে না, বরং গুটি কয়েক নীচুমনা মানুষ ঠাকুরেরও ভিত্তিহীন সমালোচনা করে। ঠাকুর ও ইকবালের তুলনা শুধু আজ নয়, বরং কয়েক দশক ধরেই হচ্ছে। নোবেল পুরস্কার কোনো কবির শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতে পারে না। উর্দু, ফারসি ও হিন্দির কোনো বড় কবি আজ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পাননি। এর অর্থ এই নয় যে, ওই ভাষাগুলো কোনো মহান কবি জন্ম দেয়নি। ওই ছাত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি তার বাংলা কাব্যচর্চার জন্য নোবেল পুরস্কার পাননি? আমি বললাম, ঠাকুর তার বাংলা কাব্যগ্রন্থ নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং তাকে ওই ইংরেজি অনুবাদের ওপর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। আল্লামা ইকবালের ফারসি কাব্য সঙ্কলন ‘আসরারে খুদি’ ১৯১৫ সালে প্রকাশ হয় এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসির অন্যতম শিক্ষক প্রফেসর রেনল্ড নিকলসন সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ওই ইংরেজি অনুবাদে কমপক্ষে ১৫০টি ভুল ছিল। স্বয়ং ইকবাল তা চিহ্নিত করেন। নিকলসন ভুলগুলো সংশোধন করে ১৯৪০ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন, যেসময় ইকবালের ওফাত হয়ে গেছে। ছাত্রীটি প্রশ্ন করলেন, এর বিস্তারিত বিবরণ কোথায় পাওয়া যাবে? আমি বললাম, ডক্টর সালিম আখতারের ‘ইকবাল : মামদুহে আলাম’ (ইকবাল : যিনি বিশ^নন্দিত) গ্রন্থে আপনি সম্পূর্ণ বর্ণনা পেয়ে যাবেন। ওই ছাত্রী এক সরল অনুরোধ করে বসলেন, আপনি আপনার কোনো এক কলামে এ কথা অবশ্যই লিখবেন যে, ঠাকুর কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন, আর আল্লামা ইকবাল কেন পেলেন না।

এ অনুরোধ শুনে কয়েক সপ্তাহ আগে বৈরুতের আল হামরা এলাকায় এক লেবাননী সাহিত্যিকের সাথে আলোচনার কথা আমার মনে পড়ল। ওই লেবাননী সাহিত্যিকের নাম যায়েদ আবদুল ফাতাহ। তিনি বললেন, ১৯৮১ সালে বৈরুতে ক্যাফে ইউনুসে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও ডক্টর ইকবাল আহমাদের (আল্লামা ইকবাল নন) সাথে আড্ডায় বসতেন। একবার তিনি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা আপনি কিভাবে পেলেন? ফয়েজ বললেন, ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা তিনি আল্লামা ইকবালের কবিতা থেকে পেয়েছেন। ইকবাল ফিলিস্তিন ইস্যুতে ব্রিটিশের নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা না করলে তিনি অবশ্যই নোবেল পুরস্কার পেতেন। যে কবি এ কথা বলেন, ‘তেরি দাওয়া না জেনেভা মেঁ হ্যায়, না লান্দান মেঁ/ফিরিঙ্গ কী রাগে জাঁ পাঞ্জায়ে ইয়াহুদ মেঁ হ্যায়’- তোমার সমাধান না আছে জেনেভায়, না লন্ডনে/ইংরেজদের প্রাণ রয়েছে ইহুদিদের কব্জায়- সে কবি মূলত নোবেল পুরস্কারকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। এ পুরস্কার আলফ্রেড নোবেলের নামে দেয়া হয়ে থাকে, যিনি ডিনামাইটের আবিষ্কারক ছিলেন। ডিনামাইটের আবিষ্কারকের নামে ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের ধারা শুরু হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মারকান্ডে কাটজু ২০১৫ সালে অভিযোগ করেছিলেন, ঠাকুরের কবিতা ‘জনগণমন’ মূলত ব্রিটিশ রাজা জর্জ পঞ্চমের প্রশংসায় লেখা হয়েছিল। ১৯১১ সালে জর্জ পঞ্চম ভারত সফরে এলে অলইন্ডিয়া কংগ্রেস এক প্রস্তাবের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। ঠাকুর ১৯৩৭ সালে এ কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, তিনি জর্জ পঞ্চমের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেননি। ইকবালের বিরুদ্ধে এ ধরনেরই অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল। ইকবালের কবিতায় টিপু সুলতানের প্রশংসাকে ব্রিটিশ বিদ্বেষরূপে ব্যাখ্যা করা হতো। ইকবালের কিছু ব্রিটিশ সমালোচক অভিযোগ করেন, তিনি মুসলমানদের সারা দুনিয়ায় ইসলামের ঝাণ্ডা ওড়ানোর জন্য উসকানি দিচ্ছেন। ঠাকুরের ধারণামতে, ইকবাল উচ্চস্তরের মানবিক মূল্যবোধের কবি। ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন, বেশ ভালো হয়েছে। তবে ইকবাল পাননি। এটা ইকবালের নয়, তার নিন্দুকদের সমস্যা। অসলোতে শান্তি আলোচনা করাতে ইয়াসির আরাফাত ও শিমন পেরেজকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। ওই নোবেল পুরস্কারে কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চলে এসেছে? শান্তির আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেছে। আর তরুণরা এটা জেনে ফেলেছেন যে, তাদের সমাধান না আছে জেনেভাতে, না আছে লন্ডনে। ইংরেজদের প্রাণ রয়েছে ইহুদিদের কব্জায়।

পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement