১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬
`

আধিপত্যবাদ উৎখাতেই সংহত হবে স্বাধীনতা

-

স্বৈরাচারী শাসনে সর্বক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্যে চলত, নৈতিকতা-বিবর্জিত অনিয়ম, মেধার বঞ্চনা, যোগ্যতার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতা। ফলাফলে চরম বৈষম্য। যেসব মন্ত্রী ও দলীয় নেতার টাকার খনির সন্ধান এখন পাওয়া যাচ্ছে, তাদের আয়ের উৎসের মধ্যে সরকারি টেন্ডারবাজি যদি প্রধানও হয়, ওই সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর-পরিদফতরে, সব কর্মশাখায় নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগও কি কম ছিল? এর ওপর ছিল দলীয় সুপারিশ ও তৃণমূলের দুর্নীতির সরাসরি যোগসাজশ।

জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দুর্নীতির অনুষঙ্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকার এবং শাসক মহলের বেপরোয়া অর্থ আত্মসাৎ, তহবিল তছরূপ, বিদেশে অর্থ পাচার, সম্পদের অপচয়, জমি ও ঘের দখল, কারখানা দখল, ঠিকাদারদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে লভ্যাংশ দাবি, দখলদারদের আইনের সুরক্ষা দেয়া, পুলিশের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাদেরকে জবরদখল চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ও সুরক্ষা দেয়া, কলেজ কমিটি দখল, এমনকি মসজিদ কমিটিতেও জবরদখল কায়েম করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে মার্কেট নির্মাণ, ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে দুর্নীতি, ফলাফলেও হস্তক্ষেপ, প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের হেনস্তা করা, শিক্ষাঙ্গনে বিরোধী দল-মতের ছাত্রদের খুন, সিটবাণিজ্য, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে দিয়ে মারধর, কমনরুম দখল, ছাত্রীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, শ্লীলতাহানি এমনকি যৌন নিপীড়নের প্রাত্যহিক নিষ্ঠুরতা, হল সংসদ পরিচালনায় নৈরাজ্য, মাইকে আজান নিষিদ্ধ করা, টুপি দাড়ি দেখলেই নিগ্রহ ও মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা, হলে হলে মুজিব বন্দনা, মূর্তিপূজা ও এহেন নিকৃষ্ট শিরকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করা এ ছাড়াও অনেক অনৈতিক দুষ্কর্ম।

নিষ্ঠুর একনায়ক, রক্তপিপাসু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পাপের পেয়ালা পূর্ণ হয়ে উপচে পড়েছিল। গণরোষের বাঁধ ভাঙা জোয়ারে তার দল ও তার নিজের গদি যখন ভেসে যাওয়ার উপক্রম, সেই মুহূর্তেও সে তার এসএসএফ বাহিনীকে নির্দেশ দেয় সেনাবাহিনীর ওপর গুলি করতে, এমনকি ভারতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা দোভালকে সে বাংলাদেশ আক্রমণের প্রস্তাব পর্যন্ত দেয়। ভারতীয়রা আগ্রাসী আধিপত্যবাদী, তবে হাসিনার মতো এত বিবেকহীন স্টুপিড নয়। বাংলাদেশে আক্রমণ করার নতিজা তারা জানত। কিন্তু তারাও ভেবে অবাক হয়ে যায়, হাসিনা ভারতীয়দের চেয়েও বেশি ভারতীয়, পোপের চেয়েও বড় ক্যাথোলিক! তাই তাদের দেশে তারা ওই স্বৈরশাসককে রাজ-আতিথ্যে দালাইলামা করে রেখেছে। কেবল কোনো বেজন্মা/দেশবিরোধীর পক্ষেই সম্ভব একটি প্রতিবেশী দেশকে নিজের দেশ আক্রমণের প্রস্তাব দিতে। একজন দুর্নীতির মহারানী এবং পরদেশের সেবাদাসীর পক্ষেই এমন বিশ্বাসঘাতকতা করা সাজে। নিজে দুর্নীতিবাজ বলেই সে তার দলবলকে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে প্রকাশ্যেই বলত, এটি তার বাবার দেশ। তার বাবাই এ দেশ স্বাধীন করে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ভারতকে নজিরবিহীন সুযোগ দেয়া এসবকে সে মনে করত তার পৈতৃক অধিকার। দেশটিকে দুর্নীতি ও হরিলুটের মৃগয়াক্ষেত্র বানাতে তাই তার বিবেক বাধ সাধেনি এতটুকু।

লর্ড অ্যাকটনের সেই অমোঘ উক্তি সমকালীন বিশ্বে সবচেয়ে ঠিকঠাক খাটে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ব্যাপারে। যেখানে তিনি যথার্থই বলেছিলেন, ক্ষমতা মাত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে আর ক্ষমতা যতই বেশি হয়, দুর্নীতিও মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে (Power corrupts; absolute power corrupts absolutely)।

প্রস্তাবিত সংস্কার সুপারিশে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি সরকারপ্রধান হতে পারবেন না, দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধান আলাদা ব্যক্তি হবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে হবে যাতে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা যায় এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং Check & Balance-এর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বটে। স্বৈরাচারী হাসিনা একনায়কের একচ্ছত্র শাসন চালিয়েছিল এবং সে প্রহসনের নির্বাচনে ভোটবিহীন অবৈধতাকে গায়ের জোরে বহাল রাখতে ধরেছিল বিরোধী মত দলন, দমন, গুম, খুন, নির্যাতন, আয়নাঘর, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিচারিক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা, জনগণের অর্থে কেনা অস্ত্র জনগণের বুকে চালানো, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর নির্বিচার গণহত্যা, পঙ্গু করে দেয়া এমনকি বাংলাদেশে আক্রমণ করার জন্য ভারতীয়দের আহ্বান জানানোর মতো রাষ্ট্রদ্রোহ ও ভারতীয় নাগরিক সুলভ আচরণের ভয়ঙ্কর পথ। এই পথ দিয়ে ভারতে যাওয়া যায় কিন্তু দেশে ফেরা যায় না।

তবে গণদাবি হচ্ছে, তাকে যে করেই হোক দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তার যথাবিহীত প্রাপ্য বিচার নিশ্চিত করা ও রোমানিয়ার নিকোলাই চসেস্কুর মতো শাস্তি কার্যকর করা। বিচার যে তার হবেই হবে, এটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মতো অনিবার্য। এই দৃষ্টান্ত বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। স্বৈরাচার ধ্বংস করেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন, লুটেছে অর্থনীতি, ইতিহাসে সর্বাধিক অর্থসম্পদ পাচার করেছে; মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিষাক্ত করেছে সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দলীয়করণ, জনগণের ওপর ঋণভার চাপিয়ে আত্মম্ভরি প্রকল্প থেকে পুকুরচুরি এবং দলীয় লেজুড়দের কাজের ঠিকা/উপঠিকা ও দলীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো নির্বিচার হরিলুট, দলীয় সশস্ত্রবাহিনী দিয়ে নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ-সিট দখল ও ভর্তি বাণিজ্যের মহোৎসব ইত্যাদি।

‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ এভাবে তার পোষ্য মন্ত্রী, এমপি, নেতা-পাতি নেতা এবং উচ্ছিষ্টভোগী চাটুকারদের প্রশংসা এবং স্তাবকলীলা ছিল বিগত ১৭ বছরের বাস্তবতা, যার সূচনা স্বাধীনতার পর এবং পরিপূর্ণতা গত ১৭ বছরের দুঃশাসনামলে। দুর্নীতির বরযাত্রায় সঙ্গী হয়েছে নির্লজ্জ বেহায়া আমলাদের একটি বড় অংশ। যারা দুর্নীতির সাথে আপস করেনি তারা হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরের শিকার কিংবা পদাবনতির মতো অপমান ও অবিচারের শিকার। গোপালগঞ্জ-প্রীতিতে মোহাবিষ্ট স্বৈরাচার অবিচার করেছে অন্য জেলার প্রতি। জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে দেশের সব পেশাজীবী সংস্থা ও সমিতির নেতৃত্ব জবরদখল করেছে স্বৈরাচারের নির্লজ্জ পদলেহীরা। দেশকে একটি আবাসযোগ্য জাহান্নাম বানিয়েছে তারা। দেশের স্বার্থ এমনকি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে আধিপত্যবাদী ভারতের চরণে। বিরোধী দলগুলো যখন চোখের পানিতে নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছে তখন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতা হেনেছে মরণ আঘাত। এক নজিরবিহীন ছাত্র-জনতা-সিপাহি মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উৎখাত করেছে শেখ পরিবারের দুর্বিষহ স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসন। দুই হাজার ছাত্র-জনতা বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়ে, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করে পতন ঘটিয়েছে শেখ পরিবারের ‘বাস্তিল দুর্গ’।

লাখ লাখ মানুষ সাহসে বুক বেঁধেছে শহীদ আবু সাঈদের মতো। সবশেষে রক্তপাত ও গণহত্যার বিভীষিকা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছে বীর সন্তান দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীসহ পুরো প্রতিরক্ষা ফৌজ ‘আর একটি গুলিও চলবে না’ এই ঐতিহাসিক প্রত্যয়ে। সালাম জানাই কুমিল্লা সেনানিবাসের সেই তরুণ আর্মি অফিসার ও তার মতো বিবেকবান অফিসার এবং সৈনিকদের প্রতি, যারা তাদের অস্ত্র ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে আওয়ামী পুলিশ ও সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর গণহত্যার নির্মমতার প্রতিরোধে মৃত্যুভীতি, বিচার ও চাকরির মায়া ত্যাগ করে রাজপথে নেমে এসে জনতার সাথে কাতারবন্দী হন এবং গণসংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বীর সেনানিদের এই গৌরবময় ভূমিকা যেমন ছিল জনতার সাথে সংহতি, তেমনি ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের সময়োচিত প্রতিরোধ।

এই দেশপ্রেম এবং ঈমানী শক্তিই বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সমরাস্ত্র। এই শক্তি নিয়েই এ দেশের বীর যোদ্ধারা একদিন প্রতিরোধ করেছিল মোগল অভিযান, মগ ও মারাঠি অত্যাচার, ব্রিটিশদের দুই শতাব্দীর দুঃশাসন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর আক্রমণ, ১৯৭৫ সালের সফল রাষ্ট্র বিপ্লব, একই বছরের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহি-জনতা বিপ্লব এবং সর্বশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের দুনিয়া কাঁপানো গণবিপ্লব ও মহাবিদ্রোহে। এই জাতি চিরদিন পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে দেশের দেশপ্রেমিক ফৌজিয়ানদের এই অবদানের ঐতিহাসিক ধারা পরাম্পরা। যেমন স্মরণ করবে এ দেশের নতুন প্রজন্মের বীর শহীদ ও পঙ্গু ছাত্রছাত্রী, প্রতিবাদী সংগ্রামী জনতার জুলাই-আগস্ট মহাবিদ্রোহের বীর যোদ্ধাদের, যাদের রক্ত ও দুর্ভোগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নতুন দেশ, নতুন বাংলাদেশ, নতুন স্বাধীনতা। ভারতীয় আধিপত্যবাদের জিঞ্জির ভেঙে বের হওয়ার মতো বিরল অর্জন। এই অর্জন স্থায়ীভাবে ধরে রাখাই এখন দল-মত-পথ নির্বিশেষে পুরো ঐক্যবদ্ধ জাতির ঐকান্তিক আকাক্সক্ষা। এই অর্জন ধরে রাখতে হবে একমাত্র দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য দিয়েই। এখানে বিভেদ, বিতণ্ডা, অনৈক্যের সামান্যতম অবকাশ নেই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থের অনৈক্য মানেই হবে ‘পলাশী যুদ্ধের’ শোকাবহ পরিণতি, যার মাশুল দিতে হয়েছে বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশবাসীকে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। আজকের মীরজাফর, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ, জগতশেঠরা কিন্তু বসে নেই। বসে নেই বাংলাদেশের খেয়ে পরে বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকা ভারতীয় সেবাদাস, চর-অনুচর এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দাস-দাসীদের মতো উচ্ছিষ্টভোগী দালালগুলোও।

ভারতীয় আধিপত্যবাদ সমূলে উৎখাত করতে পারলেই কেবল সংহত হবে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ। এই সত্যটি ধারণ, লালন এবং রুহের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-উপজাতি-পাহাড়ি-সমতলবাসী-নবীন-প্রবীণ সব মত ও পথের দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীকে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement
আন্দোলনরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছাত্রদলের নিন্দা ফের ইউরোপের মাঠে ফিরতে যাচ্ছে মেসি! জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় সম্মেলন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাথে আপসের কোনো সুযোগ নেই : প্রেস সচিব গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল আমদানি খরচ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা খসড়া তালিকায় আল আমিন-জীবনরা এনআইডি সেবা হাতে রাখতে প্রধান উপদেষ্টা ও তিন মন্ত্রণালয়কে ইসির চিঠি বিশ্বকাপ খো খো : কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অগ্নি-প্রতিরোধ মহড়া ১৯ জানুয়ারি পাটগ্রামে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় মদের বোতল দিল বিএসএফ

সকল