১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬
`

দোষ বানানো : ট্রাইব্যুনালের বিচারে জবরদস্তিমূলক সাক্ষ্যের ভূমিকা

-

গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেতাদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার জালিয়াতির আশ্রয় নেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে সমর্থন করা যেতে পারে এমন একটি প্রত্যয় নিশ্চিত করার জন্য এটি করা হয়েছিল। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। মাওলানা নিজামীর মামলায় দু’জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসিকিউশন সাক্ষীর সাক্ষ্য তুলে ধরে যে কীভাবে প্রসিকিউটর ও তদন্তকারীরা ‘প্রমাণ’ নিজেরা তৈরি করেছে এবং সাক্ষীদের আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছে!

৩০ এপ্রিল ২০১৩, মো: শাহজাহান আলী মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ৬ হিসেবে সাক্ষ্য দেন। শাহজাহান সাক্ষ্য দেন, ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর মাওলানা নিজামীর নির্দেশে ২২ জনকে ইসামতি নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। তিনি সাক্ষ্য দেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। তিনি ট্রাইব্যুনালকে জানান, ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলা হয়েছে এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তবে হামলা থেকে কোনোরকমে বেঁচে যান শাহজাহান। তিনি প্রাথমিকভাবে এক মাস পাবনার একটি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি চার বছর চিকিৎসা নেন, অবশেষে ১৯৭৫ সালে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

তবে এর আগে ২০১২ সালের ১ জুলাই মো: শাহজাহান আলী পাবনার স্থানীয় এক প্রতিবেদককে দেয়া একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, তিনি জানেন না, মাওলানা নিজামী ১৯৭১ সালে কে ছিলেন। মো: শাহজাহানের এই সাক্ষাৎকার এখন ইউটিউবে ‘বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রকাশ-২’ শিরোনামে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার সাথে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব জড়িত ছিল না। মাওলানা নিজামীর কথা শুনে শাহজাহান উত্তর দিলেন, ‘১৯৮৬ সালে আমাদের সাঁথিয়াতে সে এমপিতে খাড়ায়ে তখন এমপি হইছিল, তখন থেকে চিনছি।’ এখন পাঠকরা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারেন, মো: শাহজাহান আলীকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হবে এমনটি অভিযুক্ত পক্ষের কৌঁসুলি কীভাবে জানলেন। তাকে প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হবে এমন তথ্য ডিফেন্সের কৌঁসুলির কাছে আসে, যখন তদন্তকারী কর্মকর্তা মো: আব্দুর রাজ্জাক খান, পিপিএম পাবনা সফর করেন এবং শাহজাহানের সাক্ষাৎকার নেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের সবারই জানা ছিল, তদন্তকারী অফিসার পাবনা সফর করেছেন এবং শাহজাহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। অনেক সাংবাদিক তখন শাহজাহানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি তদন্তকারী অফিসারকে কী প্রমাণ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, স্থানীয় সাংবাদিকরা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তার বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহজাহান উত্তর দেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা নিজামী সাহেবকে জড়ায়ে বলেছে, আমি নিজামী সাহেবরে জড়িত করিনি।’ এই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রদর্শিত হয়েছিল। তবে ভিডিও সাক্ষাৎকারটি ট্রাইব্যুনাল মোটেও বিবেচনায় নেয়নি এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার তৈরি মিথ্যা প্রমাণের ভিত্তিতে মাওলানা নিজামীকে মৃতুণ্ড দেয়া হয়। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহজাহানকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে যে বাধ্য করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়েছে।

এ ছাড়া প্রসিকিউশনের সাক্ষী শাহজাহান জেরায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন। যদিও তিনি জেরায় বলেছিলেন, তিনি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলেন, তবে তিনি পরে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তিনি ১৯৭২ সালে পাবনার মিয়াপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ সাঁথিয়া থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

সাক্ষী হিসেবে শাহজাহানের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টিও জেরায় ডিফেন্স টিম তুলে ধরে। তিনি জেরায় স্বীকার করেছেন, ব্যাংকের তহবিল আত্মসাতের কারণে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে যেখানে তিনি ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেছিলেন, ‘যে অভিযোগের ভিত্তিতে আমার চাকরি চলে যায় তা হলোÑ আমার ও ম্যানেজার সাহেবের যোগসাজশে ব্যাংকের টাকা লুট হয়েছিল।’ তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি বরখাস্তের বিরুদ্ধে আপিল করেননি বা আদালতে বরখাস্তকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আমার চাকরিচ্যুতির আদেশের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কোনো আপিল করিনি এবং কোনো আদালতে কোনো মামলাও করিনি।’

মো: শামসুল হক নান্নু ছিলেন আরেকটি কৌতূহলী প্রসিকিউশন সাক্ষী যিনি ২০ জুন ২০১৩ থেকে ২৭ জুন ২০১৩ পর্যন্ত মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। মাওলানা নিজামী রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলেন বলে প্রমাণ উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে এর আগে নান্নু পল্টনে ডিফেন্স টিমের কার্যালয়ে মাওলানা নিজামীর পরিবারের একজন সদস্যের সাথে কথা বলে তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন তাকে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি মাওলানা নিজামীর আত্মীয়কে বলেন, ছেলের পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শকের চাকরি বাঁচানোর জন্য তাকে মিথ্যা প্রমাণ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাকে জানিয়েছিলেন, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে তার ছেলের চাকরি নিরাপদ থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বসবাস করে যেতে চাইলে সরকারের প্রয়োজন অনুযায়ী সাক্ষ্য দিতে হবে। তিনি মাওলানা নিজামীর আত্মীয়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমি এখানে থাকলে আমাকে সাক্ষী দিতে হবেই। ওরা আমাকে আগে পিকআপ করে নিয়ে যাবে, রিহারসেল করাবে, যা যা বলবে, তা দাড়ি, কমা, সেমিকোলন অনুসারে সাক্ষী দিতে হবে।’

মাওলানা নিজামীর আত্মীয়কে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে ভুল করার গুরুতর পরিণতি হওয়ার কথাও জানান নান্নু। তিনি বলেন, যেদিন সাক্ষী... এলোমেলো কথা কই, অন্য একটি কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।’ নান্নু আরো বলেছিলেন, তাকে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছিলেন মেজর জেনারেল ইমরুল কায়েস। এই ব্যক্তি পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। নান্নু বলেন, শেখ হাসিনা নিজেই তাকে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে বলেছেন। মাওলানা নিজামীর আত্মীয়ের সাথে নান্নুর সাক্ষাৎ একটি গোপন আইপ্যাডে রেকর্ড করা হয়েছিল। এটি পরে ইউটিউবসহ অনেক ওয়েবসাইটে ‘ওয়্যার ক্রাইমস ট্রায়াল এক্সপোজড-৪(বি)’ শিরোনামে পোস্ট করা হয়।

সাক্ষাৎকারের ভিডিওগুলো যখন মিডিয়ার কাছে আসে, তখন নান্নু অস্বীকার করেন তিনিই ইউটিউব ভিডিওর ব্যক্তি ছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে ভিডিওটির সত্যতাও অস্বীকার করেন তিনি। তিনি চ্যানেল আইকে বলেছেন, ‘যে গলার স্বরটি দেয়া হয়েছে তাও আমার নয়। এটি আমার স্বরের অনুরূপ একটি দ্বিতীয় স্বর।’ তবে প্রাথমিকভাবে নান্নু মিডিয়াকে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি ছদ্মবেশে গোঁফ বড় করার পরই মিডিয়ার সামনে হাজির হন। যাই হোক, প্রতিরক্ষা কৌঁসুলি প্রেসে তার স্বীকারোক্তিমূলক সাক্ষাৎকারের অডিওর সাথে পল্টনে প্রতিরক্ষা দলের অফিসে মাওলানা নিজামীর আত্মীয় গোপনে রেকর্ড করা ভিডিওটির অডিওর সাথে তুলনা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ফরেনসিক অডিও বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেছিলেন। ১৮ অক্টোবর ২০১৩-এ, রাজ্য ও ফেডারেল কোর্ট বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক/প্রশিক্ষক, ক্যাপ্টেন জন পি স্লেটার (অব:), প্রদত্ত ভয়েস নমুনাগুলোর ওপর একটি শনাক্তকরণ বিশ্লেষণ পরিচালনা করার পর একটি ফরেনসিক ভয়েস বিশ্লেষণ প্রতিবেদন দেন। ক্যাপ্টেন স্লেটার মোট ৪৫টি মিলে যাওয়া শব্দ শনাক্ত করেছেন এবং উপসংহারে পৌঁছেছেন, মো: শামসুল হক নান্নু ৯৯.৯ শতাংশ নিশ্চিতভাবে গোপন রেকর্ডিংয়ে বক্তা ছিলেন।

ভয়েস বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন স্লেটার নান্নুর দেয়া প্রেস কনফারেন্স থেকে ছয়টি অডিও/ভিডিও টেপের একটি ‘ভয়েস স্ট্রেস অ্যানালাইসিস’ করে দেখেন গোপনে রেকর্ড করা ভিডিওর ব্যক্তি নন বলে যে কথা বলেছেন সে বিষয়ে নান্নু অসত্য ছিলেন। এই উপসংহারটি ক্যাপ্টেন স্লেটার ৯০ ও ৯৮ শতাংশের মাঝামাঝি নির্ভুল হিসেবে বর্ণনা করেন। ক্যাপ্টেন স্লেটার ৯০ শতাংশ নিশ্চিত হয়ে এই উপসংহারেও আসেন, নান্নু গোপনে রেকর্ড করা ভিডিওতে যখন তিনি দাবি করেছিলেন, শেখ হাসিনা তাকে সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন এবং যখন তিনি দাবি করেছিলেন, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো সরকারি তদন্তকারীদের দ্বারা বানানো হয়েছিল তাতে তিনি সত্যবাদী ছিলেন। ১৮ অক্টোবর ২০১৩-এর ক্যাপ্টেন সেøটারের রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছিল। তবে ট্রাইব্যুনাল প্রতিবেদনটি বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানায়। নান্নুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মাওলানা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

এই ভিডিওগুলো তুলে ধরে যে কীভাবে তৎকালীন সরকার এবং তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে শুধু তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রমাণ তৈরিতে জড়িত ছিল! তবে, অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী এবং বিরোধী নেতাদের পরিবারের চতুর অনুসন্ধানী কাজ নিশ্চিত করেছে, সত্যটি অবশেষে উন্মোচিত হয়েছে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি


আরো সংবাদ



premium cement