৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দেশের স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য চাই

-

বিএনপি ও জামায়াত বাংলাদেশের দু’টি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। দু’টি দলই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। যদিও ভারতীয় প্রচারণা ও তাদের এদেশীয় রাজনৈতিক এজেন্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও মিডিয়া সহযোগীরা এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ন্যারেটিভ তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়াতে সদা তৎপর। তারা দেশপ্রেমিক এই দুই শক্তিকে জঙ্গি ইত্যাদি তকমা দিয়ে কথিত রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই দু’টি দল যখন রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখনই তারা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত হয়েছে। আর যখনই এদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে তখনই নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রাষ্ট্রও ক্ষতির মধ্যে পড়েছে।

১৯৮৬ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত-বিএনপি ঐক্যের সাথে আন্দোলন না করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। তখন জামায়াত এরশাদের সাথে নির্বাচনে অংশ নেয় আর বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকে। ফলে এরশাদ আরো চার বছরের জন্য ক্ষমতায় টিকে যায়; অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে আরো চার বছর বেশি সময় লেগে যায়। তখন জামায়াত নির্বাচন করে ১০টি আসন লাভ করে। অন্য দিকে ১৯৯০ সালে যখন সব দল মিলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে তখন আন্দোলন সফল হয় এবং এরশাদের পতন হয়। এর ফলে ১৯৯১ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন লাভ করে আর জামায়াত লাভ করে ১৮টি আসন।

এ অবস্থায় বিএনপি জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। এটি ছিল জামায়াত ও বিএনপির রাজনৈতিক ঐক্যের দৃশ্যত প্রাথমিক যাত্রা। যার ফলে সেই সময় থেকে মূলত দেশের অর্থনীতির নতুন যাত্রা শুরু হয় এবং রাষ্ট্রও অর্থনৈতিকভাবে ও সার্বভৌমভাবে নিরাপদ হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়।

আর তখন থেকেই দেশবিরোধী শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের ঐক্যের ভবিষ্যৎ ফলাফল অনুধাবন করতে পারে এবং দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ তৈরিতে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে আন্দোলন করে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সেই বিরোধের ফলে জামায়াত ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচনে অংশ নেয়। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দু’টি দলই হেরে যায়। বিশেষ করে জামায়াত অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফল করে। বিএনপি ১১৬টি আসন পেলেও জামায়াত পায় মাত্র তিনটি আসন। অথচ তখন ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে তাদেরই ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত ছিল বলা যায়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন ও জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন পেয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গিয়ে ভারতপন্থী যে প্রশাসনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে তারই পরিণাম হলো বিগত প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার সূচনা। এর দায় কোনোভাবেই বিএনপি ও জামায়াত এড়াতে পারে না। যদিও ১৯৯৬ সাল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত ১৯৯৬ পরবর্তী সব আন্দোলনে একসাথে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আবারো তাদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে উভয়ই নির্বাচন-পূর্ববর্তী ঐক্য গঠন করে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। এর বিএনপি ১৯৩ ও জামায়াত ১৭টি আসন পেয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে এবং এ সময়ই জামায়াতের দু’জন প্রতিনিধিও মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেন। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যদি ১৯৯৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত বিরোধ না করে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করত, তবে ফলাফল অবশ্যই ভিন্ন হতো এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারত কি না সন্দেহ।

বাংলাদেশের বিরোধীরা বুঝতে পারে বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন করলে অন্য কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ জন্য তারা বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য ভাঙতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে যখন ষড়যন্ত্রকারীরা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ঐক্য ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে ২০০৬ সালে এক-এগারোর ঘটানো হয়। আর এই এক-এগারো সরকারের উদ্দেশ্যই ছিল মাইনাস টু, প্রকারান্তরে মাইনাস ওয়ান করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো। এই ষড়যন্ত্রের সত্যতা পাওয়া যায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্র্রপতি প্রণব মুখার্জির বইতে।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৮ সাল থেকেই জামায়াতের ওপর অত্যাচার শুরু করে তখন বিএনপি একেবারের চুপ থেকেছে। যখন জামায়াতের জাতীয় নেতাদের মিথ্যা অভিযোগে ক্যাঙারু কোর্টের মাধ্যমে ফাঁসি কার্যকর করা হলো তখনো বিএনপি ছিল নিশ্চুপ। আবার যখন বিএনপি একা একা তাদের আন্দোলন শুরু করল তখন জামায়াতও অভিমানে নীরবতার নীতি গ্রহণ করে। ফলে আওয়ামী লীগ এই দীর্ঘ সময় ধরে খুবই ভালোভাবে দেশের স্বাধীনতার প্রহরী দুই দলকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে এবং দেশটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।

এই দুই দল শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করলে আওয়ামী লীগ এতদিন অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারত না। অথচ এই চরম সত্যটি বিএনপি ও জামায়াত নিছক দলীয় স্বার্থে অস্বীকার করেছে। ফলে দুই দলই দিন দিন দুর্বল হয়েছে। আর শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ।

এর সব থেকে বড় প্রমাণ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি আয়োজিত জনসভা ব্যর্থ হওয়া। যদি সে দিন বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধ থাকত তবে হয়তো সে দিনই আওয়ামী সরকারের পতনের ঘণ্টা বেজে যেত। সেটি হলে জাতিকে ২০২৪ সালের এই মর্মান্তিক গণহত্যা দেখতে হতো না।

বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার একটি দর্শনগত ভিত্তি রয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন মূলত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার মূল চেতনা ইসলামী মূল্যবোধে সঞ্জীবিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্রপতি জিয়া এ দেশের মানুষের হাজার বছরের পথপরিক্রমায় গড়ে ওঠা মৌলিক সংস্কৃতির স্বরূপ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছুড়ে ফেলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, কেন ১৯৪৭ সালে এই ভূখণ্ড ভারতের সাথে যুক্ত হয়নি। কেন প্রায় হাজার মাইল দূরের একটি দেশের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা গ্রহণ করল। আর এর ভিত্তিতেই তিনি এই ভূখণ্ডের সীমানা দিয়েই জাতীয়তাবাদ তৈরি করলেন এবং জাতীয়তাবাদের নামকরণ করলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ জন্য তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ দেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকাঠামোতে নিতে পেরেছিলেন।

তিনি তলাবিহীন ঝুড়ি নামক দেশটিকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার সড়কে ওঠাতে পেরেছিলেন। তার সময়েই মূলত বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্পোন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি হয়। যার ধারাবাহিকতায়ই ২০০১ সালের দিকে এসে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ইমার্জিং টাইগারে রূপান্তর হতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তিনি শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাননি, মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন এবং এ চেতনার বলেই তিনি সফলভাবে পররাষ্ট্রনীতিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলেন।

অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামী দেশকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে জন্য সংগঠনটি তার অর্থব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তত্ত্বগত প্রস্তাবনা দিয়েছে। সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বিএনপি ও জামায়াতের দর্শনগত অবস্থান কাছাকাছি ও সহায়ক। যদিও অন্তর্নিহিত মূল্যবোধভিত্তিক অবস্থানটি কোনোভাবেই কোনো দলই সেভাবে প্রকাশ করে না। এর পেছনে অবশ্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ব্যাপকমাত্রায় কাজ করে। যদি এই দু’টি দল তাদের দর্শনগত ঐক্য বজায় রেখে দেশের রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কার্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে অনেক আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণেই সব সময় এই দু’টি দলের মধ্যে বিভেদ তৈরির ষড়যন্ত্র সর্বদা চলমান। আর দু’টি দলই প্রায়ই সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে যায় রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে।

দু’টি দল সব ধরনের রাজনৈতিক মতপার্থক্য এড়িয়ে দেশের স্বার্থে সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে না পারলে দেশ আবারো মহাসঙ্কটে পড়তে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৬ বছর আগে।

আমরা মনে করি বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশবিরোধী কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান সম্ভব হবে না এবং আন্তর্জাতিক কোনো শত্রু বাংলাদেশের দিকে চোখ তোলারও সাহস করবে না।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement