৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বানানো বিচার : সোহাগপুর ট্রায়ালে প্রসিকিউশনের অসদাচরণ

-

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন অবর্ণনীয় ভয়াবহতার সাক্ষী ছিল শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুরের শান্ত গ্রামটি। সেখানে পুরুষদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। নারীরা হন যৌন সহিংসতার শিকার। এ ট্র্যাজেডির উপর লেখা অসংখ্য বইয়ে নৃশংসতার বিস্তারিত বর্ণনা নথিভুক্ত ছিল। সাংবাদিকরাও নৃশংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া বিধবাদের সাক্ষাৎকার নেন। এত কিছুর পরও ২০১০ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে এসব অপরাধে জড়িত করার কোনো অভিযোগ উত্থাপন অথবা এ ধরনের কোনো প্রমাণ ছিল না। অবশেষে যে প্রমাণগুলো সামনে নিয়ে আসা হয় তার পুরোটা প্রসিকিউশন বা সরকার পক্ষ থেকে তৈরি করা। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের নেতৃত্বে এটি তৈরি হয়। বিচারের মাঝপথে তিনি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সন্ধানে শেরপুরে যান। এ নিবন্ধে সে সব বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে প্রসিকিউশন, তদন্তকারী ও ট্রাইব্যুনালের সহায়তায় বানোয়াট প্রমাণাদি তৈরির আয়োজন করা হয়েছিল।

সোহাগপুর গণহত্যার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘটিত নৃশংসতার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে তদন্ত প্রতিবেদনটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তাতে রয়েছে নানাবিধ অসঙ্গতি। তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা প্রাথমিকভাবে তিনজন সাক্ষীর বরাত দিয়েছেন। তারা হলেন, মো: জালাল উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম ও সুরুজ মিয়া। তাদের কেউ নিজেদের বক্তব্যে কামারুজ্জামানকে ঘটনার সাথে জড়িত করেননি। বিস্ময়করভাবে, যে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তাদের মধ্যে শুধু একজন, মো: জালাল উদ্দিন (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১০), মূল তদন্তের অংশ ছিলেন। এর পরও, মো: জালাল উদ্দিন ট্রাইব্যুনালের সামনে তার সাক্ষ্য পরিবর্তন না করা পর্যন্ত কামারুজ্জামানের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেননি। অন্য তিনজন সাক্ষী হাসেন বানু (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১১), হাফিজা বেওয়া (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১২) এবং করফুলি বেওয়া (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১৩) বিচারের মাঝপথে আদালতে হাজির হন। আগে তালিকাভুক্ত সাক্ষীরা হঠাৎ করে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে অস্বীকার করেন তখন মূল তদন্তে অনুপস্থিত নতুন সাক্ষীদের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে। বিদ্যমান সাক্ষীরা কামারুজ্জামানকে জড়িত করতে অস্বীকার করার সাথে সাথে, কার্যধারার বৈধতা ও ন্যায্যতার ওপর সন্দেহের ছায়া পড়ে।

মো: জালাল উদ্দিন যে পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এটি দেখায় কিভাবে প্রসিকিউশন সাক্ষীদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করতে পারে। প্রসিকিউশন সাক্ষীদের মধ্যে ১৫ জুলাই, ২০১২ হামিদুল হককে প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১ হিসেবে সাক্ষ্য দেয়া শুরু করে। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২, মো: জালাল উদ্দিন প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১০ হিসেবে সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল। তিনি সোহাগপুর গণহত্যার একজন সাক্ষী ছিলেন। তবে নির্ধারিত তারিখে প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে জানান, প্রসিকিউশনের কোনো সাক্ষীকে ডাকা হবে না। প্রসিকিউটর প্রথমে ব্যাখ্যা করেন, মো: জালাল উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাক্ষীর অসুস্থতা সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছিলেন, তাকে তার সাক্ষীদের ‘মানসিকভাবে প্রস্তুত’ করতে হবে। প্রসিকিউটর ব্যাখ্যা করেছেন, যে দু’জন সাক্ষী ইতোমধ্যে তার হেফাজতে রয়েছে এবং তিনি ইতোমধ্যে তাদের একজনের সাথে কথা বলেছেন যার ‘মানসিক প্রস্তুতির’ প্রয়োজন ছিল। অতএব, বিচার স্থগিত করা হয় এবং পরবর্তী তারিখ ১ অক্টোবর ২০১২ ধার্য করা হয়। এ তারিখে মো: জালাল উদ্দিন প্রসিকিউশন দ্বারা ‘মানসিকভাবে প্রস্তুত’ হওয়ার পরে হাজির হন এবং সাক্ষ্য দেন। তার সাক্ষ্যে, তিনি কামারুজ্জামানকে সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত করেন, যা তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আগে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রসিকিউটরিয়াল কোচিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত এ উদ্বেগজনক পরিবর্তন কামারুজ্জামানকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টায় ঘটা অনিয়ম তুলে ধরে।

সোহাগপুর গণহত্যা মামলার সাক্ষীদের পরিচালনায় আরো কিছু উদ্বেগজনক অসঙ্গতি প্রকাশ পায়। তদন্তকারী কর্মকর্তার সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন সাইফুল ইসলাম ও সুরুজ আলী। এই দু’জনেরই মো: জালাল উদ্দিনের পরে সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল। ২ অক্টোবর ২০১২, প্রসিকিউটর ঘোষণা করেনÑ সোহাগপুর গণহত্যার জন্য অন্য একজন সাক্ষী প্রস্তুত এবং একই দিনে দুপুর ২টায় তিনি সাক্ষ্য দেবেন। ট্রাইব্যুনালকে প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করানোর পর বেলা ২টা ২৭ মিনিটে প্রসিকিউটর হাজির হন এবং ট্রাইব্যুনালকে জানান, প্রসিকিউশনের সাক্ষী সুরুজ আলী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সুরুজ আলীর অবস্থা সম্পর্কে আর কোনো আপডেট খবর দেয়া হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি কখনোই সুস্থ হয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেননি। এতে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রসিকিউশন তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করাতে পারেনি। একজন প্রধান সাক্ষীকে হাজির করতে এ ব্যর্থতা মামলাটি নির্মাণে নিয়োজিত প্রসিকিউশনের সন্দেহজনক কৌশল তুলে ধরে এবং কার্যধারার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য সংশয়ের জন্ম দেয়। আসলে সুরুজ আলীকে হাজির করা হয়নি, কারণ প্রসিকিউশন তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করাতে পারেনি।

প্রসিকিউশনের একজন সাক্ষী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে দাবি করার ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, সাক্ষী তাদের নির্দেশনা মানতে অস্বীকার করেছে। এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২-এ ঘটেছিল, যখন প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে জানান, পাঁচজন প্রসিকিউশন সাক্ষী প্রস্তুত এবং তারা সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক। তবে দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, বাকি তিন সাক্ষীÑ মো: সাজিদুর রহমান, মো: শফিকুল ইসলাম ও মো: জাহাঙ্গীর কবির সবাই একসাথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই তিনজন সাক্ষীর কেউই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেননি। প্রসিকিউশন দ্বারা ‘অসুস্থ’ হিসেবে বর্ণিত সাক্ষীরা খুব কমই সাক্ষ্য দিতে ফিরে আসেন; তাদের সাধারণত বাড়িতে পাঠানো হয় এবং আর কখনো তাদের দেখা যায় না। এই প্যাটার্নটি স্পষ্ট করে যে, প্রসিকিউশন সাক্ষীদের মধ্যে যারা তাদের বর্ণনার সাথে সঙ্গতি রেখে সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না তাদের সাথে কীভাবে আচরণ করা হয়েছিল। বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা সম্পর্কে এটি গুরুতর উদ্বেগ উত্থাপন করে।

প্রসিকিউশনের সাক্ষীরা তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ ‘অসুস্থ হয়ে পড়ার’ প্রেক্ষাপটে, প্রসিকিউশন ৮ অক্টোবর ২০১২ সোহাগপুর গণহত্যার জন্য সাতজন নতুন সাক্ষীকে ডাকার জন্য আবেদন করে। এর আগে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২, প্রসিকিউটররা এই অতিরিক্ত সাক্ষীদের সংগ্রহের জন্য শেরপুরে যান। এই পরিদর্শনের সময় তারা সোহাগপুরের সাত বিধবাকে শনাক্ত করেনÑ করফুলি বেওয়া, জরিতন বেওয়া, হাসেন বানু, শামলা বেওয়া, জোবাইদা বেওয়া, মোসাম্মৎ হাফেজা বেগম ও আসিরন বেওয়া। প্রসিকিউশনের জমা দেয়া আগের কোনো নথি বা সাক্ষী তালিকায় এই বিধবাদের নাম ছিল না। এই সাক্ষীদের খুঁজে বের করার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বিচারের মাঝপথে প্রসিকিউটরদের শেরপুর যাওয়ার বিষয়টির সর্বজনীন রেকর্ড দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনকণ্ঠ এবং ১ অক্টোবর ২০১২ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়। এটি বিচারিক প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তদন্ত সংস্থা অভিযুক্তদের বিষয়ে ১৫ মাস ধরে তদন্ত পরিচালনা করে, এই দীর্ঘ সময়েও অতিরিক্ত সাক্ষীদের কারো সাক্ষাৎকার নেয়া হয়নি। প্রসিকিউশন কেন এই সাক্ষীদের আগে খুঁজে পায়নি বা কেন তাদের বিচারের মাঝখানে হঠাৎ উপস্থাপন করা হয়েছিল তার কোনো ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। সাক্ষীদের অসুস্থতার সময় ও প্রসিকিউটরদের শেরপুর সফর কার্যপ্রণালীতে কারচুপির চেষ্টার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবীরা আবেদন করে ট্রাইব্যুনালে এসব বিষয় তুলে ধরেন। তবে ডিফেন্সের এই আপত্তি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

প্রসিকিউশন দ্বারা উপস্থাপিত সাত নতুন সাক্ষীর মধ্যে শুধু হাসেন বানু (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১১), হাফিজা বেওয়া (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১২) এবং করফুলি বেওয়া (প্রসিকিউশন সাক্ষী নং ১৩) শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের বিবৃতিগুলোর একটি ঘনিষ্ঠ পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায়, যা একই বক্তব্যের অনুলিপি করা হয়েছে বলে মনে হয় এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে এটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। তিনজন সাক্ষীর অভিযোগ ছিল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় সোহাগপুরে নৃশংসতা চালিয়েছিল এবং রাজাকারদের নেতা ছিলেন কামারুজ্জামান। তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে কামারুজ্জামানকে জড়িয়ে ফেলার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা অনেকটাই একই রকম। হাসেন বানু দাবি করেছেন, ‘আমার চাচাতো ভাইদের থেকা জানবার পাইছি যে, পাঞ্জাবিদের (খান সেনাদের) সাথে আসানসা ও মজাফফার রাজাকারদের নেতা আছিল শেরপুরের কামারুজ্জামান।’ একইভাবে হাফিজা বেওয়া অভিযোগ করেছেন, ‘পরে লোকজনের মুখ থেকা জানবার পাইছি রাজাকার কাদির ডাক্তার ও বগাবুরাদের নেতা আছিল শেরপুরের কামারুজ্জামান।’ করফুলি বেওয়ার বিবৃতিটি হাফেজা বেওয়ার বিবৃতিকে প্রায় ভাষায় প্রতিফলিত করেছে : ‘পরে লোকজনের বগল থেকা জানবার পাইছি রাজাকার আসানসা ও বগাবুরাদের নেতা আছিল শেরপুরের কামারুজ্জামান।’ এই সাক্ষীদের দ্বারা কামারুজ্জামানকে যেভাবে জড়িত করা হয়েছিল তার অভিন্নতা অত্যন্ত সন্দেহজনক। কাছাকাছি অভিন্ন বাক্যাংশ তাদের দাবির সত্যতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং তাদের সাক্ষ্যগুলো স্বাধীনভাবে দেয়া হয়েছিল নাকি প্রসিকিউটরিয়াল কোচিংয়ের ফলাফল ছিল সে সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ উত্থাপন করে। তাদের বক্তব্যের এই লক্ষণীয় মিল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত প্রমাণের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ছায়া ফেলে। বক্তব্যের মিল থেকে বোঝা যায়, কামারুজ্জামানকে ফাঁসানোর জন্য প্রসিকিউশন সাক্ষীদের শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল।

আরো দেখা যায়, হাফেজা বেওয়া এবং করফুলি বেওয়া উভয়েই ২৫ জুলাই, ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলো সাংবাদিক মামুনুর রশীদের কাছে ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন। যিনি ২০১২ সালে প্রকাশিত তার বই, ‘সোহাগপুরের বিধবা কন্যারা ১৯৭১’-এ তাদের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বিবরণে উল্লিখিত নারীদের সাক্ষাৎকারে ঘটনার সাথে কামারুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার কোনো উল্লেখ নেই। তদুপরি, মামুনুর রশিদকে তিনি যে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে ডিফেন্স কৌঁসুলি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে করফুলি বেওয়া দাবি করেন, তিনি এমন একটি সাক্ষাৎকারের কথা স্মরণ করতে পারছেন না। উপরন্তু, সোহাগপুর গণহত্যার নথিভুক্ত অন্যান্য বই, যেমন আবদুর রহমান তালুকদারের ‘গল্পে গল্পে ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ী’-এ নৃশংসতার যে বর্ণনা দেয়া হয় তাতে কিন্তু কামারুজ্জামানের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এই বাদ পড়ার বিষয়গুলো গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে জড়িত করা সাক্ষ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহের জন্ম দেয়।

উল্লেখযোগ্যভাবে, যুদ্ধের বিধবাদের কেউই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানায়নি যে, তারা ১৯৭১ সালে সোহাগপুরে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। তবে, ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার সময় তিনজনই পরে দাবি করে, তাদের ওপর সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের সময় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দেয়া তাদের সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করে।

এভাবে সোহাগপুর গণহত্যার সাথে জড়িত করে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচার উল্লেখযোগ্য অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছিল, যা এর ন্যায্যতা ও সততা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। সাক্ষীর আগের বিবৃতির সাথে সাংঘর্ষিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভরতা, বিচারের অর্ধেক সময়ে নতুন সাক্ষীদের আকস্মিকভাবে হাজির করানো এবং তাদের সাক্ষ্য দেয়ার ভাষাগত অভিন্নতা দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে, প্রসিকিউশন সত্য উদঘাটনের চেয়ে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার উপর বেশি মনোযোগ দিয়েছিল।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি


আরো সংবাদ



premium cement