১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মৃত্যুহীন প্রাণ : শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার

শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার - ছবি : সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের নেতা, রাজনীতিবিদ যিনি মৃত্যুকে ভয় করেননি। তিনি শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করেছেন। ইয়াহিয়া আস সিনওয়ার নামের অর্থ হলো ‘জীবন’ এবং ‘নেতা’ বা ‘মহান ব্যক্তিত্ব’। এই মহান ব্যক্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়ে গেছেন।

গাজায় এখন গড়ে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি শিশু শহীদ হচ্ছে। প্রতিটি শিশুর জন্মই যেন হচ্ছে মৃত্যুর জন্য! ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালে গাজার দক্ষিণে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। খান ইউনিস সেকেন্ডারি বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তার জীবনের ২২টি বসন্ত দখলদার ইসরাইলের কঠিন কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৮২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে সিনওয়ার প্রথমবার ইসরাইলের হাতে গ্রেফতার হন। পরে ১৯৮৫ সালে তিনি আবারো গ্রেফতার হন। ১৯৮৮ সালে দুই ইসরাইলি সেনাকে জিম্মি এবং তাদের হত্যা করার অজুহাতে সিনওয়ারকে আটক করা হয়। পরে ২০১১ সালে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান।

তিনি অনন্য ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে কারাগারে বসেও নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কারাগারে বন্দীদের মধ্যে নিজের প্রভাববলয় সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন! নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বন্দীদের সমস্যা, অধিকার নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতেন এবং বন্দীদের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। গঠনমূলক কার্যক্রম ও কৌশলী ভূমিকার মাধ্যমে বন্দীরা তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বন্দিত্বের সময়গুলো তিনি যথাযথভাবে কাজে লাগান। কারাগারে বসেই তিনি হিব্রু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।

১৯৮৭ সালে যখন হামাস প্রতিষ্ঠিত হয় এর ঠিক দু’বছরের মাথায় ইয়াহিয়া সিনওয়ার দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা- ‘আল-মাজদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। আল-মাজদ নৈতিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের ভূমিকা পালন করত। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর জনশক্তি সংগ্রহ করার অপূর্ব চারিত্রিক দক্ষতা ছিল তার। ২০১৩ সালে, তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে ২০১৭ সালে হামাসের গাজা শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। গত জুলাইয়ে ইসমাইল হানিয়া ইসরাইলি গুপ্তহত্যার শিকার হলে সিনওয়ার হামাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলিদের ওপর যে আলোচিত হামলা চালানো হয়েছিল, সেটির ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে মনে করা হয় ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে! হামলায় হামাসের যোদ্ধারা সফলভাবে প্রায় এক হাজার ২০০ জন দখলদার ইসরাইলিকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে আসে। আসলে ইয়াহিয়া সিনওয়ার মৃত্যু খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ হাজার হাজার ইসরাইলি দখলদার সেনা-ড্রোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও গুপ্তচরের মাধ্যমে তার অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য দিনের পর দিন মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ইসরাইলি বাহিনীর (আইডিএফ) নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে গাজার রাফাহ শহরের একটি ভবনে অভিযান চালানো হয়। সেই অভিযানে তিনজন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন, শহীদ সিনওয়ার তাদের একজন। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী তার লাশের পরিচয় জানতে মৃতদেহ থেকে একটি আঙুল কেটে শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে ইসরাইলে পাঠিয়েছিল! পরে এক দিনের মধ্যে তার লাশটিও পাঠানো হয় তেলআবিবে। ডেন্টাল রেকর্ড এবং ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সিনওয়ারের মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়। ইসরাইলিদের কাছে সিনওয়ারের জেনেটিক ডাটা সংরক্ষিত ছিল। কারণ তিনি তার জীবনের কয়েক দশকই কাটিয়েছিলেন ইসরাইলের কারাগারে। সিনওয়ারের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

ইসরাইলি হামলায় হামাসের নেতা শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ইসমাইল হানিয়ার শাহাদতের পর এত শোকের মধ্যেও গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের কাছে সাহস আর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন।

সিনওয়ারের ঐতিহাসিক ভাষণ
২০২২ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক সমাবেশে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে সিনওয়ার ফিলিস্তিনের প্রতিটি ব্যক্তিকে ‘আল-আকসা রক্ষার জন্য, একটি ঝড়ের মতো জেগে ওঠার জন্য প্রস্তুত’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কবিতার ছন্দে ছন্দে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করছিলেন, ‘আমরা তোমাদের কাছে আসব এক গর্জন বন্যায়, রকেটের অন্তহীন এবং অসীম সৈন্যের বন্যায়। একের পর এক জোয়ারে আমরা আমাদের লাখ লাখ লোক নিয়ে আপনার কাছে আসব।’ আপসহীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সিনওয়ার দখলদারমুক্ত স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে জীবনের মিশন ও ভিশন করে নিয়েছিলেন।

মৃত্যুর আগে সহযোদ্ধাদের প্রতি নির্দেশনা
সিনওয়ারের বর্ণাঢ্য আন্দোলনী জীবন অনেকটাই যেন রাসূল সা:-এর সাহাবিদের মতো। রাসূলের সা: সুন্নাহর অনুসরণে শাহাদতের আগে, সহযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি কাগজে হাতে লিখে নির্দেশনা দিয়েছেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম আল-কুদস এক প্রতিবেদনে জানায়, তিনি ইসরাইলি জিম্মিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। এমনকি কয়েকজন বন্দীর নাম, বয়স ও লিঙ্গ লিখে গেছেন। ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম আল-কুদস সিনওয়ারের নিজ হাতে লেখা এমন তিনটি কাগজ প্রকাশ করেছে। সিনওয়ার প্রথম কাগজে লেখা শুরু করেছিলেন সূরা মুহাম্মদের ৪ নম্বর আয়াত দিয়ে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের বন্দী করার পর হয় তাদের অনুগ্রহ করে মুক্তি দাও, অথবা মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দাও।’ ব্যাখ্যা অনুসারে এর অর্থ হলো, ‘যদি শত্রুদের বড় ক্ষতি সাধন করার পর তাদের বন্দী করো, তবে হয় তাদের অনুগ্রহ করে মুক্তি দাও বিনিময়ে কিছু না নিয়ে, অথবা তারা মুক্তিপণ দিয়ে নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করুক।’ সিনওয়ার এই আয়াতের পর নবী মুহাম্মদ সা:-এর একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘রোগীদের দেখতে যাও, ক্ষুধার্তদের খাওয়াও এবং বন্দীদের মুক্ত করো।’ কাগজে লেখা বন্দী বলতে ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের বোঝানো হয়েছে।

সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে সিনওয়ার আরো লিখেন, ‘আমাদের বন্দীদের মুক্তির কর্তব্য তখনই পূর্ণ হয়, যখন শত্রুর বন্দীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়, আর তাদের মুক্তির পুরস্কার মুজাহিদদের জন্য লিপিবদ্ধ হয়।’ সিনওয়ার হামাস যোদ্ধাদের নির্দেশ দেন, ‘শত্রুর বন্দীদের জীবনের যত্ন নিতে এবং তাদের নিরাপদ রাখতে। কারণ তারা আমাদের কাছে একটি চাপে রাখার অস্ত্রস্বরূপ।’

হামাসপ্রধান শহীদ সিনওয়ার বলেন, ‘আমাদের নিজেদের বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তখনই সম্পন্ন হবে যখন আমরা শত্রুর বন্দীদের রক্ষা করতে পারব এবং বন্দীদের মুক্তির জন্য যে পুরস্কার রয়েছে তা মুজাহিদিনদের পক্ষে লেখা হবে।’

শহীদের মৃত্যু নেই
আমরা জানি আল কুরআনের ভাষায়, শহীদেরা চিরকাল বেঁচে থাকেন, তারা জীবিত। তাদের মৃত্যু নেই। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত। সিনওয়ারের শাহাদতের মধ্য দিয়ে ইসরাইলি দখল থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তির উদ্দেশ্য আরো বেশি জীবন্ত হয়েছে। শাহাদতের গৌরবময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি চির অমরত্ব লাভ করেছেন! নির্যাতিত মজলুম মানুষের হৃদয়াকাশে দ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন চিরকাল। তার গৌরবময় মৃত্যুতে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের চেতনা আরো বেশি শক্তিশালী ও শাণিত হবে ইনশাআল্লাহ!

অষ্টম হিজরির জুমাদাল উলা, আরবের মরুভূমির কোল থেকে মুতার রণক্ষেত্রের উদ্দেশে বেরিয়েছেন তিনজন জানবাজ বীরযোদ্ধা। তিন হাজার সাহাবির সমন্বয়ে গঠিত ছোট একটি সৈন্যদল নিয়ে তারা ছুটেছেন মদিনা থেকে উত্তরে সিরিয়ার দিকে। লক্ষ্য তাদের রোমান সা¤্রাজ্যের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করা। যে বাহিনী প্রকৃত অর্থেই বিশাল। তাতে রয়েছে প্রায় দুই লাখ সৈন্য। এই বিশাল বাহিনী বেরিয়েছে তিন হাজার সাহাবির ক্ষুদ্র বাহিনীকে কচুকাটা করার জন্য। অথচ মহান রবের ইচ্ছায় এই ক্ষুদ্র বাহিনীই বিজয় লাভ করেছিল সেই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে। পৃথিবীর ইতিহাসে সেদিন ঘটেছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়েছিল তিন মহাবীরের শাহাদতের বিনিময়ে।

মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘কত ছোট দল আল্লাহর অনুমতিতে বড় দলকে পরাজিত করেছে!’ রাসূল সা: যখন মুতার যুদ্ধে একে একে তিন সেনাপতি নির্ধারণ করেছিলেন, সবাই তখন বুঝে গিয়েছিল যে, সেনাপতি তিনজনই শহীদ হবেন। প্রথম সেনাপতি হজরত জায়েদ রা: শহীদ হওয়ার পর ইসলামের পতাকা হাতে তুলে নিলেন সেনাপতি জাফর বিন আবু তালিব রা:। সেই যুদ্ধের দ্বিতীয় সেনাপতি ছিলেন জাফর বিন আবু তালিব রা:। দুই লাখ রোমান বাহিনীর সাথে তিন হাজার অকুতোভয় মুসলিম সেনার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল মুতার প্রান্তরে। তিনিও বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদতবরণ করলেন। তৃতীয় সেনাপতি হয়ে এগিয়ে এলেন আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা। রাসূল সা:-এর কবি। আনসারি সাহাবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন। রাসূল সা: যার সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা দয়া করুন আবদুল্লাহ বিন আবু রাওয়াহার প্রতি। নিশ্চয়ই তিনি সেই মজলিসসমূহকে পছন্দ করেন, যা নিয়ে গর্ব করেন ফেরেশতারা!’ এভাবে একে একে তিনজন সেনাপতির শাহাদতের পর সৈন্যদের পরামর্শে খালেদ বিন ওয়ালিদের মতো বিশ্বজয়ী সেনাপতির নেতৃত্বে সেদিন বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন মুসলিম সৈন্যরা। তেমনি মুলসিম জাতি প্রত্যাশা করছে- হামাস নেতাদের একের পর এক শাহাদত আগামীর খালেদ বিন ওয়ালিদের আগমন ত্বরান্বিত করবে।


আরো সংবাদ



premium cement
রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা শিখলে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে বিসিএসের আবেদনে চিকিৎসকদের বয়স ৩৪ করা হোক : ড্যাব জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থী গুপ্তহত্যায় ছাত্রশিবিরের উদ্বেগ যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দাবি শিশু বিশেষজ্ঞদের ‘বাংলাদেশের উপজেলাসমূহের ডিজিটাল মানচিত্র প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের সেমিনার বাংলাদেশকে আরো ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দেবে আইএমএফ তদন্তে বেরিয়ে এলো মা-মেয়ে হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী বিকল্প টুর্নামেন্টের চিন্তা করছে বাফুফে যাত্রীদের প্রতাশা পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা চুয়াডাঙ্গার বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে জখম

সকল