১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব

-

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, যা কেবল ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং জাতীয় জীবনের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ দেশে ধর্মীয় শিক্ষা শুধু ঐতিহ্যের অংশ নয়, জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ ধর্মের প্রতি আবেগ এবং ধার্মিকতা নিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ এ কথা প্রমাণ করে যে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ধর্মীয় চেতনা দিন দিন বাড়ছে।

২০১৮ সালে আইআইআইটি এবং বিআইআইটির পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষক ধর্মীয় কার্যক্রমের সাথে যুক্ত। প্রথম আলোর ২০১৯ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেশের ৯৪ শতাংশ তরুণ ধর্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। এসব পরিসংখ্যান ধর্মীয় শিক্ষা এবং ধার্মিকতার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের গভীর আগ্রহ নির্দেশ করে।

একজন মুসলমানের জীবনে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে এবং সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতি মানুষকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ধাবিত করছে। বিভিন্ন মক্তব, এতিমখানা, নূরানি মাদরাসা প্রভৃতি এ দেশের জনগণের ব্যক্তিগত অর্থায়নে গড়ে উঠেছে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি না থাকার ফলে, অনেক সময় ধর্মীয় উগ্রবাদ, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

ইসলামে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে কল্যাণ দান করতে চান, তাকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন।’ পবিত্র কুরআনের সূরা জুমারে বলা হয়েছে, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ ইসলামী শিক্ষার এমন গভীর তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেক্যুলার মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ইসলামী শিক্ষার অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারছে না।

বর্তমানে সমাজে বিভিন্ন অপসংস্কৃতি, অশ্লীলতা, ও লিঙ্গবৈচিত্র্যের নামে সমকামিতার প্রসার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম টিকটক, রিলসের মতো সামাজিক মাধ্যমের আসক্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। পাশাপাশি র‌্যাগ ডে, গালা ডিনার ও হলি উৎসবের মতো বিজাতীয় সংস্কৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করেছে; যা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে এবং সমাজে অবৈধ সম্পর্ক ও পরকীয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একই সাথে কিশোর অপরাধ, কিশোর গ্যাং কার্যক্রম, মাদকাসক্তি, ছিনতাই ও রাহাজানির মতো অপরাধ ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ তরুণ, যা একটি দেশের জন্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হিসেবে বিবেচিত। এই তরুণদের যদি সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু যেখানে তরুণদের জনশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তাদের অপরাধ প্রবণতা থেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, তরুণ প্রজন্ম কেন বিপথে যাচ্ছে? এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক অপরাধপ্রবণতা এবং তরুণদের অপরাধমূলক কাজে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা একটি বড় কারণ। তরুণরা সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি কোনো অর্জন সাময়িক এবং কোনোটি দীর্ঘস্থায়ী, সে বিষয়েও তারা যথাযথ চিন্তা করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের নীতি ও নৈতিকতার মানদণ্ডে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।

২০২২ সালে ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট (নায়েম) পরিচালিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় পাঠ্যসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানোন্নয়নে শিক্ষকরা কিভাবে নিজেদের রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করবেন, সে বিষয়ে শিক্ষকদের সুস্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। পাশাপাশি অনেক শিক্ষক প্রথাগত সিলেবাস এবং পরীক্ষা-নির্ভর শিক্ষাকার্যক্রমের বাইরে ভিন্ন কিছু চিন্তা করতে সক্ষম নন।

এছাড়া, নৈতিক শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। নৈতিকতা শুধুমাত্র জ্ঞানের বিষয় নয়; এটি অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই শিক্ষার্থীদের নৈতিক আচরণ ও চর্চার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়নের একটি কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।

ওই গবেষণায় নৈতিক শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে একটি বিতর্ক উঠে আসে, ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে কি নৈতিক শিক্ষা দেয়া সম্ভব? প্রেক্ষাপট হিসেবে অনেকেই উল্লেখ করেছেন, যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে ধর্মীয় শিক্ষা বা নৈতিক শিক্ষা নামে আলাদা কোনো পাঠ্যসূচি নেই। তবুও এসব দেশের শিক্ষার্থীরা নৈতিকতার মানদণ্ডে অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ে অবস্থান করছে।

তবে এর বিপরীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো, ওই সব দেশে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে এমন একটি উন্নত নৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত। আমাদের দেশে উন্নত নৈতিকতার একটি জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এই বাস্তবতায়, আমাদের দেশের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা শুধু নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যম নয়, এটি তরুণ প্রজন্মকে সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। যারা ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প হিসেবে শুধু নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেন, তারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করছেন।

জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার সঠিক অন্তর্ভুক্তি এবং চর্চা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি স্তরের শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক ও শিক্ষা-উদ্যোক্তা
ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement