২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বেসরকারি স্কুল-কলেজে সাত পদে এনটিএসসির অধীনে নিয়োগ

- প্রতীকী ছবি

১৯৯৬ সালে বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজ যোগ দিই। এর কয়েক দিন পর আমার শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আতাউর রহমানের সাথে দেখা করতে যাই। তিনি পরামর্শ দেন, শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়ম বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করার।

সেই সূত্রে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি এবং আতাউর রহমান স্যারের সাথে যৌথভাবে ‘বেসরকারি কলেজসমূহে শিক্ষক নিয়োগ- একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে দীর্ঘ একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখি, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার ৬৯ সংখ্যায় ছাপা হয় ২০০১ সালে। এই প্রবন্ধে একটি আধুনিক শিক্ষক নিয়োগ মডেল প্রস্তাব করি। এই মডেলের বেশির ভাগ অনুসরণ করে ২০০৫ সালে ১৫ ফেব্রæয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ (এনটিআরসিএ) সংক্রান্ত আইন পাস করা হয়। এই মডেলের ৯৫ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা হয়েছে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু সালেহ অভিমত ও লিখিত সনদ দেন। ২০০৯ সালে ১৭ ডিসেম্বর বেসরকারি কলেজসমূহ স্বচ্ছ, যোগ্য ও আর্দশবান শিক্ষক নিয়োগে গবেষণায় প্রস্তাবিত মডেলে উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং এনটিআরসিএ’র গৃহীত পদেক্ষপগুলো তুলণামূলক আলোচনার উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়া সেমিনারের আয়োজন করেন।

এনটিআরসিএর শিক্ষক নির্বাচনী পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ পাস নাম্বার নির্ধারণ করা হয়েছিল। এত কম নাম্বারে কখনো যোগ্য শিক্ষক পাওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়াও কিছু দুর্বৃত্তের যোগসাজশে এবং দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে সহজে এ সনদ পাওয়া সম্ভব হতো। ফলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর পরিচালনা কমিটি সুযোগ বুঝে ঘুষের পরিমাণ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হতো সনদধারীদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে বেশি ঘুষ প্রদানকারীকে নিয়োগ দিত পরিচালনা কমিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

২০১৪ সালের ২৪ জুলাই নয়া দিগন্তে ‘শিক্ষা-জীবন ও জীবিকা নিয়ে কিছু কথা’ শিরোনামে এনটিআরসিএর নানা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাসমূহ এবং একটি গবেষণা প্রবন্ধে উল্লিখিত আধুনিক মডেলে শিক্ষক নিয়োগের বিধিবিধান ও পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করি। অতঃপর শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারি পিএসসি গঠনের কথা বলেন নানা সভা ও সমাবেশে। ২০১৪ সালে ১৫ অক্টোবর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা হারাচ্ছে পরিচালনা কমিটি- শিক্ষা সচিব (প্রথম আলো)। এর পাঁচ দিন পরে ২০ অক্টোবর শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন গঠনের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর।

২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালা-২০০৬ সংশোধন বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়, যথা- ১. সরকারি অনুমোদিত ও আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদরাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজে মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। ২. পৃথক বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন গঠন করা হলে এনটিআরসিএ-কে বিলুপ্ত করা হবে।

২০১৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আবারো নয়া দিগন্তে ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্য ও প্রতিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ করি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সুপার, সহকারী সুপার, অফিস সহকারী ও গ্রন্থাগারিক- এই আটটি পদে নিয়োগ ক্ষমতা রয়েছে সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা কমিটির হাতে। ফলে উল্লিখিত পদগুলো নিয়োগে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট পরিচালনা কমিটি।

একইভাবে যথাযথ প্রতিকার সম্বন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ করি। পরবর্তী সময়ে এ কপি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর পিএস-কে দিই। কয়েক দিন পরে বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভার নোটিশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সুপার এবং সহকারী সুপার (ছয়টি) পদে এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগের লক্ষ্যে নিয়োগবিধি প্রণয়নে ৪ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখ বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (মাধ্যমিক-২) সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সভা নির্ধারণ করা হয়। ওই সভায় সচিব-কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ; চেয়ারম্যান-এনটিআরসিএ; মহাপরিচালক-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাওশি) অধিদফতদর; মহাপরিচালক-মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর; মহাপরিচালক-কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর এবং চেয়ারম্যান-মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকাকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। ওই সভার নোটিশ ইস্যু পর্যন্ত। এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

২০১৫ সাল থেকে এনটিএসসির মাধ্যমে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি এবং এ তালিকার শীর্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে শিক্ষক নির্বাচন এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; কিন্তু আগে অর্থাৎ ২০০০-এর আইনে গঠিত এনটিআরসিএর বিধিবিধান প্রভৃতি একেবারে অকেজো, পুরনো ও বাদ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগে এনটিএসসির বিধিবিধান ও পদ্ধতি প্রভৃতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে আজো কেন এনটিআরসিএর নামটি সবখানে ব্যবহার করা হচ্ছে?

জরুরি ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সুপার, সহকারী সুপার ও অফিস সহকারী এ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদে এনটিএসসির মাধ্যমে নির্বাচন ও নিয়োগ দেয়া হোক। এতে যোগ্য ও আদর্শবানদের স্বচ্ছভাবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যোগ্য শিক্ষক ও প্রশাসন গঠনে মানসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব। তাই দায়িত্বশীল সব কর্মকর্তা বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়নে এগিয়ে এলে জাতি উপকৃত হবে।

লেখক : প্রফেসর ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement