অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ সুগম করা
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:০৫
সংস্কার, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা, পতিত স্বৈরাচারের বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি যা-ই বলি না কেন সবকিছুর মূলে রয়েছে অর্থনীতি। অর্থনীতিকে সচল করা, অহেতুক খরচ না করা, দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা, বেকারত্ব দূর করা এবং জীবনযাপনে স্বস্তি ফিরে আসা এগুলো সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। দেশটা সুন্দরভাবে চলুক, হিংসা ভেদাভেদ না করে একটি গতিশীল অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। দেশবিরোধী, ষড়যন্ত্রকারী বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। সবকিছু সম্ভব হবে তখন যখন দেশের অর্থনীতি একটি মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড়াবে। তাই অর্থনীতির পথ সুগম করতে হবে। এর সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। বাধাগুলো দূর করতে হবে। অবশ্য ইতোমধ্যে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে ইতিবাচক ধারায় এসেছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে রফতানি আয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওঠা-নামা এখনো রয়েছে। তবে সামনের দিনে এটা মানুষের সাধ্যের মধ্যে চলে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
বাস্তবতা হলো- খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। পাশাপাশি অস্থির ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিগত তিন মাসে আগের তুলনায় ভালো। সবমিলিয়ে ব্যাংক খাতের নাজুক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বস্তির দিকে আসছে। তবে নিত্যপণ্যের বাজার এখনো বেসামাল। দামের চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ দিশেহারা। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয়টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কর কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবু তেমন সুফল আসছে না। তবে শীত মৌসুম শুরু হওয়ায় সবজির বাজারে ধীরে ধীরে দাম কমে আসছে।
আশার দিক হলো- অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবর মাসে বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
রফতানি আয়েও সুখবর মিলছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে এক হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের অঙ্ক ছিল এক হাজার ৮২ কোটি ডলার। এ খাতে আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে আরো বেশি জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। অন্য দিকে রিজার্ভের কথা বলতে গেলে বলতে হয় এ ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে সাফলতা দেখা দেবে।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আইএমএফের বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৮.১৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাময়িকভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে দেশের রিজার্ভ। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করছে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে।
সমস্যা হলো বাজারে অস্বস্তি। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খুচরাপর্যায়ে প্রতি কেজি আলু এখনো ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর পাশাপাশি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বাড়তি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, খুচরাপর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা ও খোলা পাম তেল ১৬২-১৬৩ টাকায় বিক্রি হয়। এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৬-১৭ টাকা ও খোলা পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে কিছুটা সঙ্কট ছিল। মঙ্গলবার ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতিতে তিন ধরনের ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসাবাণিজ্য। মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য এই তিন ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি আলোচ্য সময়ে তিন রকমের সামাজিক ঝুঁকি রয়েছে। এগুলো হলোÑ বেকারত্ব, জ্বালানি ঘাটতি এবং হৃদরোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব; অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়।
অর্থনীতির গতি বাড়াতে হলে বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ করহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। অর্থনীতিকে টেকসই ও গতিশীল করতে সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে দূর করতে হবে। এ দিকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড ঋণমান বি১ থেকে অবনমন করে বি২তে নামিয়েছে মুডিস রেটিংস।
আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাটি বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের পূর্বাভাসকে এর আগে স্থিতিশীল বলেছিল, যা এখন নেতিবাচকে নামিয়েছে। মুডিস বলেছে, চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সরকারকে তার অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে স্বল্পমেয়াদি অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর আরো বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে, এতে বাড়ছে তারল্যঝুঁকি। আবার ব্যাংক খাতে ঋণ সম্পদের উচ্চ ঝুঁকি এবং এ খাতে মূলধন ও তারল্য দুই-ই কম থাকায় সরকারের ওপর এ খাতকে জরুরি অবস্থায় সহায়তা প্রদান বা আকস্মিক দায়বদ্ধতার ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মুডিসর সাম্প্রতিক রেটিংয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে দাবি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, পরিবর্তন সম্পর্কে মুডিস যে রেটিং করেছে, তা গাড়ি সামনে চলার সময় ‘রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে দেখার’ শামিল। অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির চলার পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা দূর করে অর্থনীতির গতিপথ মসৃণ করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ সব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে অর্থনীতির মজবুত ভিত।
লেখক : ব্যাংকার
ই-মেইল : main706@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা