১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আবাবিল এসেছিল

- প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগ গত সাড়ে ১৫ বছর দেশটিকে পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছিল। গণতন্ত্রের নামে দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। অন্য কোনো দলকে তারা দলীয় কার্যক্রম করতে দিত না। ফ্যাসিবাদের এই যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে এবং ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন চরমে পৌঁছে ২০১৪ সালের অবৈধ নির্বাচনের পর।

ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে মাঠে নামতে দেয়নি। বিএনপির সিনিয়র নেতাদেরকে পার্টি অফিসে পর্যন্ত যেতে দিত না। বিরোধী মতের কাউকে কোথাও সমাবেশ করতে দিত না।

এ সময় ফ্যাসিবাদের মন্ত্রীরা বিরোধী দলকে নিয়ে নানান তামাশা করতেন। দাঁত মুখ ভেঙচিয়ে বলতেন, বিএনপির সাহস নেই। সাহস থাকলে সামনে আসে না কেন? ফ্যাসিবাদের এসব দোসর অনলাইন ও অফলাইন মিডিয়ায় হাসাহাসি করত। বলত, বিএনপি ভিডিও বার্তার দলে পরিণত হয়েছে। দেশের তথাকথিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের সুরে সুর মেলাত! বিরোধী জোটের ভিডিও বার্তার আন্দোলনকে তারা রাজনীতি মনে করত না। অথচ তথাকথিত সুশীল সমাজ এ প্রশ্ন করার নৈতিক সাহস দেখায়নি যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে অন্য দল কেন অফিসে বসতে পারবে না? তারা নির্লজ্জভাবে আওয়ামী লীগের দালালি করেই গেছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তাকে গোপন স্থান থেকে গ্রেফতার করে ভারতে চালান করেছিল আওয়ামী পুলিশ। দীর্ঘ ৯ বছর পর ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর তিনি দেশে ফেরেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৫-১৭ বছর ধরে নির্বাসনে। বিদেশে বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দল পরিচালনা করেছেন। তিনি অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসতে পারেননি। ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। একের পর এক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিচারকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তার বিরুদ্ধে ফরমায়েশি রায় লেখানো হয়েছে।

ফ্যাসিবাদের নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার অনেক দেশপ্রেমিক অ্যাক্টিভিস্ট। এরা ফ্যাসিবাদের থাবা থেকে আত্মরক্ষা করতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আর যারা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন তারা রাজনীতি বাদ দিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে কোনোমতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে সার্ভাইভ করেছেন।

আওয়ামী আমলে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী। সারা দেশে তাদের একটি অফিসও খুলতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী সরকার। এ সরকার ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর অসংখ্য জামায়াত নেতাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে। সিনিয়র নেতাদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করেছে। বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পার্টি অফিসে মিটিং করতে না পেরে তারা যখন গোপনে কোথাও মিটিং করেছে, সেটিকে গোপন বৈঠক বা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে গ্রেফতার করেছে। দেশে তথাকথিত সুশীল সমাজের একজন বিবেকবান মানুষও ছিল না এ বিষয়ে কথা বলার। তাদের একজনও এ প্রশ্ন করেনি যে, কেন একটি গণতান্ত্রিক দলের পার্টি অফিস থাকতে তারা গোপনে মিটিং করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। গত ১৫ বছর বিরোধী ছাত্র সংগঠন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঘোষিত নিষিদ্ধ ছিল। ক্যাম্পাসে একটি স্বাভাবিক মিছিল মিটিং করতে দেয়া হয়নি তাদের কাউকে। যখনি কেউ দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিলের চেষ্টা করেছে তখনই তাদের উপর হামলা হয়েছে। এমনকি নারী কর্মীদের উপরও জঘন্য হামলা হয়েছে। কাউকে বিরোধী মতের মনে হলেই তাকে শিবির তকমা দিয়ে পিটিয়ে হল ও ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছে। পরিচয় গোপন করে থাকা কর্মীদেরও খুঁজে বের করে টর্চার করেছে।

২০১৩ থেকে ২০১৯ এই ছয় বছরে ঢাবি ক্যাম্পাসে নির্যাতনের প্রায় ৫০টি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যেগুলো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে । সেখানে ঢাবির হলগুলো থেকে শুধু সন্দেহের বশে অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থীকে রাতভর পশুর মতো নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দিয়েছে। জঙ্গি আখ্যায়িত করে তাদের পুলিশে দিয়েছে। ছাত্রদল বা শিবিরের কোনো সিনিয়র নেতার সাথে যোগাযোগের প্রমাণ পেলে কিংবা ফোনে কারো নম্বর পাওয়া গেলেই তাকে পেটানো হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থীর ফ্যামিলি বিএনপি বা জামায়াতের সাথে জড়িত থাকার খবর পেলেই তাকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পিটিয়েছে।

ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের রাজনীতি শেষ করে দিয়ে হামলা আর পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে উপহাস করত। আর বলত- কই, ছাত্রদল তো ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার সাহসই রাখে না। ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য মন্ত্রীরাও ‘বিএনপি আন্দোলন করার সক্ষমতা রাখে না’ বলে টিটকারি করত।

মূলত এসবের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং তার অনুচরেরা চেয়েছিল আজীবন ক্ষমতায় থাকতে। তবে এ কথা সত্য যে, জামায়াত-বিএনপি ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করলেও দেশবাসী জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়নি। বেশির ভাগ মানুষ ধরেই নিয়েছিল, শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে হাসিনা বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ আর্মি, বাংলাদেশ বিজিবি, বাংলাদেশ আনসার, বাংলাদেশের সচিবালয়, বাংলাদেশের বিচারালয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম- এক কথায় দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আওয়ামী কর্মী দিয়ে বিশেষত গোপালগঞ্জের ক্যাডার দিয়ে তার প্রশাসনযন্ত্র সাজিয়েছিল।

২০১৪-১৫ সালের দিকে একটা সময় এমন ছিল যে, বিভিন্ন হল থেকে একসাথে প্রায় চার-পাঁচ শ’ কর্মীকে নির্যাতন করে জেলে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। এ সময়জুড়ে শিবির ধরার মহোৎসব চলেছিল। এত ভয়াবহতার মধ্যেও শিবির হল ছাড়েনি। নানান সময়ে শিবির সন্দেহে বহু শিবিরকর্মী বা সাধারণ ছাত্রকে নির্যাতন করেছে। অনেক সময় ভয়ে কর্মীরা হল ছেড়ে দিতে চাইলেও দলের নির্দেশ মেনে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও রয়ে গেছে। তারা হলে থেকেই ফ্যাসিবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিল। এ গল্পগুলো থ্রিলার মুভির কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। নিত্যনতুন কৌশল করে তারা হলে থেকেছে এবং ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে ভেতর থেকে ছাত্রলীগকে দুর্বল করেছে। এভাবেই তারা ফ্যাসিবাদের দিন শেষ করে এনেছে। ২০১৮-এ কোটা আন্দোলন জমে উঠতে পারার পেছনেও এ অনুপ্রবেশ শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর সিরিজ স্টোরিগুলো বাইরে আসা শুরু করেছে। অবিশ্বাস্য এ বিপ্লবের স্বপ্ন কেউ দেখেনি। শেখ হাসিনা পলায়নের আধা ঘণ্টা আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, সে পালিয়ে যাবে। দীর্ঘ বছরের আলাপচারিতায় অনেক সাধারণ মানুষ বলত- হাসিনা রেজিম থেকে দেশ মুক্ত হবে না। যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন সে ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু অদৃশ্যের ইশারা ছিল ভিন্ন। বিপ্লবের নায়ক হয়ে উঠলো ছাত্ররা। যাদের বয়স ২৫-এর নিচে। কেউ ছিল নিষ্পাপ কিশোর। আপামর জনগণ তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপ্লবে শরিক হয়েছিল। মা তার কোলের শিশু নিয়ে বিপ্লবের মিছিলে শামিল হয়েছিল। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

বিপ্লবের মিছিলে শামিল হওয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা ছিল মূলত আবাবিল। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমের পতনে আকাশ থেকে নাজিল হয়েছিল। ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে ফ্যাসিস্ট বিদায় হলেও দেশে তার শিকড় রয়ে গেছে। এ শিকড় উপড়াতে না পারলে বিপ্লব ব্যাহত হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: dr.knzaman@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement