১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অনুচ্ছেদ ৭০ : সংসদীয় গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক

- ছবি : প্রতীকী

বিশ্বব্যাপী প্রতিটি গণতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিক দেশে দল-বদল অহরহই ঘটে। দলত্যাগবিরোধী আইনের প্রভাবও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট দৃশ্যমান। এই আইন মূলত কোনো সংসদ সদস্যদের নিজ দল ত্যাগ ও অন্য দলে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৫৪টি দেশে এ ধরনের আইন আছে, যার মধ্যে এশিয়ার ১৩টি এবং আফ্রিকার ২৮টি দেশ রয়েছে। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ব্রাজিল, ভারত প্রভৃতি উন্নত দেশগুলোতেও রাজনৈতিক দল-বদল যথেষ্ট লক্ষণীয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তার রাজনৈতিক জীবনে তিনবার দল বদল করেন। পুরনো গণতান্ত্রিক দেশগুলো দল পরিবর্তনকে রাজনৈতিক অধিকার মনে করে, যেখানে নব্য গণতান্ত্রিক দেশগুলো, বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়া, দলত্যাগের বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য অভিশাপ বলে বিবেচনা করে।

আমাদের সংবিধান কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের মূর্ত-প্রতীক এবং এটি জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে গণ্য। কিন্তু এটি প্রজাতন্ত্রের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত কিছু বিধানও ধারণ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত দলত্যাগবিরোধী আইন সংবিধানের অন্যতম বিতর্কিত ও ধ্বংসাত্মক উপকরণ, যা জনগণের ইচ্ছার আন্তরিক অভিব্যক্তি, সংসদীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন, দায়িত্বশীল সরকার প্রভৃতি সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস এবং সংবিধান কর্তৃক নিশ্চিত কিছু মৌলিক অধিকারও হরণ করে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় বৃথা যায় যখন আবু হোসেন সরকারের রাজনৈতিক দলত্যাগের কারণে সরকার গঠনের ১৫ মাসের মধ্যে সরকারের পতন ঘটে। ১৯৫৬ সালের জুন থেকে ১৯৫৮ সালের জুন পর্যন্ত, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার দলত্যাগের কারণে শিশুদের বর-বউ খেলার মতো চারবার পতন হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির এই লজ্জাজনক দৃশ্যপট ছিল পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল এবং মুহাম্মদ আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক অভ্যুত্থানের মূল কারণ। স্বাভাবিকভাবেই এই অস্থিরতার সময় আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কারণ দলটি দুবার বিভক্তির সম্মুখীন হয়েছিল এবং আইনসভায় অসংখ্য সদস্য ব্যক্তিগতভাবে দলত্যাগ করেছিলেন। এই দলত্যাগ কোনো মতাদর্শ বা নীতিগত দ্বন্দ্বের জন্য ঘটেনি; বরং সবটাই ঘটেছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পছন্দের জন্য।

ফলস্বরূপ, আমাদের সংবিধান-প্রণেতারা দলত্যাগের ফলে সরকার পতন রোধ করার জন্য অনুচ্ছেদ ৭০-এ দলত্যাগবিরোধী আইন প্রবর্তন করেন। বিদ্যমান বিধানটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দলত্যাগকে নিবারণ করে কিন্তু, সংবিধান প্রণেতারা রাজনৈতিক দলত্যাগ ঠেকাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কঠোর বিধান প্রণয়ন করেন। ফলে এই বিধানটি সংসদ সদস্যদের গলার টুঁটি চেপে ধরে। অনুচ্ছেদ ৭০ একজন এমপিকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা দল থেকে পদত্যাগ এবং তার বিরুদ্ধে ভোট দিতে নিষেধ করে, অন্যথায় সংসদীয় আসনটি শূন্য হয়। দলত্যাগবিরোধী আইনের কঠোর নীতির কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে ফ্লোর-ক্রসিংয়ের প্রথম ঘটনা ঘটে যখন এম এ মান্নান এবং মাহি বি চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিএনপি) থেকে পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক দিন আগে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য বিএনপি থেকে সরে এসেছিলেন। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বিল হলেও কোনো সংসদ সদস্য সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার ভয়ে সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার সাহস করেন না। এভাবে সংসদ সদস্যরা প্রজাতন্ত্রের কল্যাণ ভুলে নিজ দলের সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং সংসদ সদস্যরা তাদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে না পারায় গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যায়।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান রূপকার ড. কামাল হোসেন তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি এবং অনুচ্ছেদ ৭০ আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে বিতর্কিত বিধান। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং অন্যান্য কিছু বিধানের মধ্যে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে। খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলাম যে, আমার দৃষ্টিতে অনুচ্ছেদ ৭০-এর বিধান সংবিধানের অন্য বেশ কিছু অনুচ্ছেদের বিধানের সাথে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘আদালতের উচিত এই বিধানটি ব্যাখ্যা করা। আমি মনে করি সংবিধান ব্যাখ্যার ‘অভিপ্রেত নিশ্চিতকরণ’ নিয়মগুলো এ ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে, কারণ এ বিধানটি কেবল বিচ্যুতি রোধ করার লক্ষ্যে করা হয়েছিল।’

প্রবীণ আইনপ্রণেতা রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা (সংসদ সদস্যরা) কোনো আইন করছি না। আমরা একটি পূর্বনির্ধারিত আইনে সম্মতি দিই যা কার্যকর করার জন্য সংসদের অনুমতি প্রয়োজন, তা আমাদের মতামত হোক বা মতামতের বিরুদ্ধে হোক। ধরা যাক, (আওয়ামী লীগ সরকারের প্রসঙ্গ টেনে) আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখনই তা আইনে পরিণত হয় এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই এই আইনের সংসদীয় অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তাই প্রকৃত অর্থে সংসদ আইন প্রণয়ন করে এমনটি সম্পূর্ণ ভুল। সংসদ পূর্বনির্ধারিত একটি আইন অনুমোদন করে মাত্র এবং সংসদের বেশির ভাগ সদস্য সাংবিধানিকভাবে এটি অনুমোদন করতে বাধ্য হন। যেকোনো আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত ৭০ ধারার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা এটাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্ত না মানলে তাকে পদত্যাগ করতে হয় এবং যদি কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে সংসদে কোনো বিলে ভোট দেন তার এমপি পদ কেড়ে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে, সংসদের আইন প্রণয়নের পদ্ধতি ও মন্ত্রিসভার কার্যপদ্ধতির মধ্যে আলাদা কিছু দেখি না!’

আইন প্রণেতা জি এম কাদের তার বই ‘মিজারিজ অব মিসকনসিভড ডেমোক্রেসি’তে লিখেছেন, এই বিধানের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা এতটাই সীমিত করা হয়েছে যে, অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদটিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের চেতনার জন্য ‘বেশ ধ্বংসাত্মক’ বলে মনে করেন।

১০২ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ৩২৪ জন স্নাতকোত্তর ও স্নাতক (তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ) পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পৃথক দু’টি জরিপে দেখা গেছে, ৯৮ শতাংশ শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ৭৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই বিধানটিকে গণতন্ত্রের বাধা বলে মনে করেন। সমীক্ষায় আরো প্রকাশ পায়, শতভাগ শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ৬৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী চান তাদের সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন যদি দলের সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। বাকস্বাধীনতার জন্য ৯৬ শতাংশ শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ৮৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বিবেকের প্রশ্নে এই বিধানটিকে সমর্থন করেন না এবং ৯৬ শতাংশ শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ৮৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই বিধানের যুক্তিসঙ্গত পরিবর্তন আশা করেন।

লেখক : আইনজীবী
ashrafbinrab@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement