ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকের আস্থা
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪৪
ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাস পুনরায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোসহ অন্তত ১৫টি ব্যাংকের আমানতের ওপর একচ্ছত্র লুটপাটের আধিপত্য ব্যাংকগুলোর কাঠামোর ধস নামিয়েছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর পরিবারতন্ত্র ও আধিপত্য ভাঙতে ১১ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন পর্ষদ। কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় এস আলম থাকলেও পর্ষদ থেকে বিদায় হয়েছে। এক কথায়, গভর্নর নিয়োগের এক মাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ব্যাংক খাতে।
দেশের ব্যাংক খাতের লিডিং ব্যাংক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানকারী অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। আমদানি-রফতানির বাণিজ্য, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করে চলেছে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও এ ব্যাংকের তুলনামূলক কম। এই ব্যাংকের কর্মচারীদের সাথে গ্রাহকের আন্তরিকতা ও আস্থা বিরাট শক্তি। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস চালু ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েও ইসলামী ব্যাংক সেবা চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে অবদান রাখাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন গরিব মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, দরিদ্রদের মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা সাহায্য প্রদান, হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তন, ভারসাম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বাণিজ্য ব্যাংকসহ ইসলামী ব্যাংকগুলো যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ছিল তা জানা যায়। এত দিন টাকা ছাপিয়ে, তথ্য বিভ্রাট ও পরিকল্পিত রিপোর্টের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে দেখা দেয় ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট। মানুষ ব্যাংকে এসে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে হিমশিম খায়। ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। অথচ বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানত প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি যা ব্যাংকের মোট আমানতের ২৭ শতাংশ।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ প্রায় তিন লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা ব্যাংক খাতে মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেক অবদান রেখে চলেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশ আসছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে চলেছে। প্রবাসীদের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকের জন্য, দেশের জন্য যেসব কর্মচারী-কর্মকর্তা ও নির্বাহীবৃন্দ কাজ করেও এত দিন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ নজরে আনলে ব্যাংকের উন্নয়ন আশা করা যায় আরো বৃদ্ধি পাবে।
শুনা যাচ্ছে, পুরোনো আমানতকারীরা ও ভালো বিনিয়োগ গ্রাহক ব্যাংকে আসা শুরু করছে। ব্যাংক ফিরে পাচ্ছে তার সোনালি অতীত। কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। আসতে শুরু করেছে রেমিট্যান্স। কমতে শুরু করেছে হুন্ডি। ব্যাংকার ও পত্রিকার তথ্য সূত্রে জানা যায়, পর্ষদ ভেঙে দেয়ার আগে দেশের বৃহৎ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল; কিন্তু পুনর্গঠনের পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যাংকটির বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে থাকা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ধারায় পৌঁছেছে। কমছে তারল্য সঙ্কট ও মূলধন ঘাটতিও। গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এরপর এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে।
এর মধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর বাইরে সাবেক ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এক্সিম ব্যাংক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ স¤প্রতি একটি সেমিনারে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে ইসলাম থাকতে হবে। তাহলেই ইসলামী ব্যাংক ভালো চলবে। ব্যাংকটি যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিলেন। বিদেশী যেসব বিনিয়োগকারী এসেছিল, তারাও ইসলামের খেদমত করার জন্য এসেছিল। কিন্তু যখন তারা দেখেছে ব্যাংকটি অন্যায়ভাবে দখল হয়েছে, এরপর ব্যাংক থেকে ইসলাম বিদায় নিলো, তখন তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’ এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, যারা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা কর্মীদের কম বেতন দিতেন, কম খরচ করতেন। এভাবে তারা অনেক সম্পদ জমা করেছিলেন, যাতে ইসলামী অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে।
‘এটিই ইসলামী ব্যাংকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লুটেরা গোষ্ঠী যখন দেখল এখানে অনেক সম্পদ জমা আছে, তখন তারা সেটি দখলের পাঁয়তারা শুরু করল। একে একে সবগুলো ইসলামী ব্যাংক দখল হয়ে গেল। একসময় ইসলামী ব্যাংক অন্য ব্যাংককে ধার দিত।’ বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির যে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত করেছেন তারা বেশ দক্ষতার সাথে এ বৃহৎ ব্যাংকটিকে পরিচালনা করছেন। ব্যাংকারদের ভাষ্যমতে, ইতোমধ্যে পুরোনো অনেক আমানতকারী বাংকে তাদের টাকা জমা রাখতে শুরু করেছে। চলে যাওয়া অনেক ভালো ভালো বিনিয়োগ গ্রাহকও ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
ইতোপূর্বে এ ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক The Strongest Bank in Bangladesh হিসেবে স্বীকৃত ছিল। প্রতি বছর প্রায় ডজন খানেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভ‚ষিত হতো এ ব্যাংক। তা ছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক, যা একাধারে বিগত ১২ বছর ধরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য ব্যাংকার’ কর্তৃক বিশ্বসেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় নাম ছিল। এটি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। জাতীয় অর্থনীতিতে এ ব্যাংক বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছে। ব্যাংকটি বেশির ভাগ সূচকে অনেক আগেই দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত জুন ২০২৪ শেষেও ইসলামী ব্যাংক এক লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার আমানত নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করেছিল। শুধু তাই নয়, বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণেও সর্বোচ্চ অবস্থানে এ প্রতিষ্ঠান। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ৩.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান। দেশের মোট রেমিট্যান্সের ২৬ শতাংশ এসেছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। এটি এই ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করে চলেছে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এক্সিকিউটিভ, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশনের ব্যবস্থা করেছে। এতে সবার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ব্যাংকটির আমানত ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা মজবুত করার জন্য সবাইকে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি রোডম্যাপও দিয়েছেন। রোডম্যাপের প্রথম ধাপে নতুন বোর্ডের যাত্রার তারিখ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হবে ‘বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ’। এ ছাড়া ২০২৬ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় হবে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ বছর এবং তৃতীয় পর্যায় হবে ২০২৭ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ‘এগিয়ে যাওয়ার’ বছর।
তবে ইসলামী ব্যাংক যদি সর্বোত্তোম গ্রাহকসেবা দিতে পারে যেমন হাসিমুখে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্প সময়ে সেবা প্রদান, গ্রাহক যেন তার নগদ টাকা উত্তোলন ও জমায় প্রশান্তি পায়। এটিএম ও সিআরএমসমূহ ঠিকভাবে সচল রাখার চেষ্টা করে তাহলে গ্রাহকের আস্থা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক সচল হলে অর্থনীতিও সচল হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ক্ষমতার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ওঠা অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে দেশের অর্থনীতির আর যেন নিয়ন্ত্রণে না যায়। এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল : main706@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা