০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

বাঁকবদলের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ

- প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগ নামের দলটি যেসব সময় ষড়যন্ত্র এবং হত্যার সাথে জড়িত, সে কথা বাংলাদেশের ইতিহাস একটু-আধটু যারা পড়ার চেষ্টা করেন, তাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট। একই সাথে দলটি যে সময়ই দেশের ক্ষমতায় এসেছে, তখনই ফ্যাসিবাদী আদর্শে দেশ শাসন করেছে। শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনার দুই দফায় সাড়ে ২০ বছরের শাসনামলই তার প্রমাণ। আসলে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের মজ্জাগত একটি দুরারোগ্য ব্যাধি।

একাত্তরে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। পঁচাত্তরে সেনাবাহিনীর কিছু বিদ্রোহী অফিসারের নেতৃত্বে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের মৃত্যু পরবর্তী বাংলাদেশে আরো কয়েকটি সেনাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সেনাপ্রধান থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হন ১৯৮১ সালে। সেনাবিদ্রোহের এ সময়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতার মধ্যে স্থিতিশীলতা আনতে সচেষ্ট ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনি সফলও হয়েছিলেন অনেকাংশে। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার সময় দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ। তখন তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন কিছুদিন। তার ধারণা ছিল, ওই সময় ক্ষমতা গ্রহণ করলে জনরোষে পড়তে হবে। তার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না।

জিয়া হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে এরশাদের সংশ্লিষ্টতার জোরালো কথা শোনা যায়। জেনারেল এরশাদ কিছুকাল অপেক্ষা করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ৯ বছর পর গণন্দোলনের মুখে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে যাত্রা করে। ১৯৯১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদ জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার স্থলাভিষিক্ত হন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা।

শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার শাসনকাল ২৫ বছর। এই সময়কালে দেশে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে ফিরে এসে তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ধরনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েন। ১৯৭৩ সালে যখন তিনি পাকিস্তানের পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতা শওকত হায়াত খানকে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাননি।

শেখ মুজিব ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন প্রো-আমেরিকান। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশটির প্রতি ওয়াশিংটনের বিরূপ নীতি ও আচরণ তাকে বিপাকে ফেলে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় তিনি যেন গভীর সমুদ্রে পড়েন। দেখতে পান স্বাধীনতা অর্জনে মস্কোর সরাসরি সমর্থনে বাংলাদেশ দ্রুত লাল রঙে ছেয়ে যাচ্ছে। তিনি তার দল আওয়ামী লীগেও অসামঞ্জস্যতা লক্ষ করেন। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন নিজস্ব লোকজনই তার কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে। এমন অবস্থায় অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টে তিনি তার একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হন। তিনি তার একান্ত বিশ্বস্ত অনুসারীদের ওপর বেশি করে আস্থাবান হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি। শেখ মনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। একদিন তিনি মামার জায়গায় অধিষ্ঠিত হবেন এমন তার ভাবনা। পশ্চাতে থেকে মামাকে পার্লামেন্টারি রাজনীতির সড়ক থেকে একদলীয় পদ্ধতিতে সরে আসার বিষয়ে ভ‚মিকা রাখেন। মনি এতটা উচ্চাভিলাষী ছিলেন যে- নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে মার্কিন গোয়েন্দা এজেন্সির সাথে একজনকে সহায়তা করতেও রাজি হন।

শেখ মুজিব ক্ষমতার সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় বিভিন্ন কায়দা-কানুন করলেও মার্কিনিদের এই বলে আশ্বস্ত করছিলেন যে, তিনি কমিউনিস্ট নন। বাংলাদেশ কখনো সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটবে না। শেখ মুজিব দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ওয়াশিংটনের সাহায্য প্রত্যাশা করেন। তিনি ওয়াশিংটনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার জন্য অত্যুৎসাহী ছিলেন। তিনি একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু এতে তার বাম ঘেঁষা কমরেডরা ক্ষুব্ধ হন। তারপরও তিনি শীতল যুদ্ধের ক্রীড়নক হতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি ভালোভাবে জানতেন দেশের সমৃদ্ধি ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে কাকে তার বেশি দরকার। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বাংলাদেশের জন্য মার্শাল প্ল্যান তৈরি করতে অনুরোধ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের জন্য মার্শাল প্ল্যান তৈরি করে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল সে কথা শেখ মুজিব জানতেন। তেমনটা তিনি চেয়েছিলেন ওয়াশিংটনের কাছে। তিনি পাকিস্তানের সাথেও শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারত-ভীতি ছিল তার। তাই তিনি সন্তর্পণে এগোচ্ছিলেন।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বাহিনী। এই বাহিনী শুরু থেকে ভারতের প্রতি সন্দিহান হতে থাকে। ভারতের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষুব্ধ হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তাদের কাছে মনে হতে থাকে শেখ মুজিব নয়াদিল্লির সেবাদাসে পরিণত হচ্ছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বাঙালি গেরিলা বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গেছে। যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় বাহিনীর কিছু আচরণ তাদের মনে প্রশ্ন তোলে।

উনিশ শ’ পঁচাত্তরে সেনা বিদ্রোহে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মুজিব হত্যার পেছনে বিদেশী ইন্ধন ছিল। অনেক বছর পরে সা¤প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ভিন্ন রকম চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। নতুন এসব তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় ঘটনাটি ছিল অভ্যন্তরীণ। ‘তবে এ কথা সত্য যে, এমন সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে বেশ আগে থেকে আমেরিকা জানত। কিন্তু আমেরিকার এ সংক্রান্ত যেসব অফিসিয়াল দলিল-দস্তাবেজ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে এ ঘটনার সাথে ওয়াশিংটনের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ঘটনার অব্যবহিত পর আমেরিকার সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় প্রধানত দুই কারণে, প্রথমত, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্ট হন সেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন ‘প্রো-আমেরিকান’ বা মার্কিন ঘেঁষা হিসেবে। তিনি পশ্চিমা-ঘেঁষা রাজনীতিক বলে খ্যাত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ্যে আমেরিকার বাংলাদেশ-বিরোধী ভ‚মিকা যেহেতু দেশটিতে যেকোনো বড়ো ঘটনার পেছনে অদৃশ্য কোনো গোপন হাতের ভূমিকা খোঁজার ঐতিহ্য রয়েছে, সেহেতু এ ক্ষেত্রেও গোপন অদৃশ্য হাত হিসেবে আমেরিকার নাম সামনে এসেছে।

আসলে ঘটনা ঘটার অনেক আগে থেকে নানাবিধ পরিকল্পনা চলছিল। এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কিছু অফিসারের চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত আগুনে ঘি ঢালে। যারা ক্যু প্ল্যান করছিলেন তাদের মধ্যে মেজর আবদুর রশিদ ও ফারুক রহমান অন্যতম। এই দু’জন তাদের প্ল্যান কার্যকর করতে চাকরিচ্যুত অফিসারদের তাদের দলে নিয়ে আসেন। মনে করা হয়, শেখ মুজিব মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাজনৈতিক রিং লিডার হিসেবে এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তথ্য না পাওয়ায় এখনো তা অনেকটাই রহস্যাবৃত। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সাথে তার জড়িত থাকার বিষয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কখনো সরাসরি এর জবাব দেননি। ১৯৭৯ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খন্দকার মোস্তাক দাবি করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর বিদ্রোহী মেজরদের প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তার দলীয় সহকর্মীদের তিনি রক্ষা করতে পেরেছেন। ঢাকাস্থ আমেরিকার দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো রিপোর্ট এমন কথা বলে যে, সেনা বিদ্রোহ সম্পর্কে খন্দকার মোশতাকের কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল না। বিদ্রোহীরা যখন তাকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেয়, তখন তিনি তা জানতে পারেন। তবে এর বিপক্ষে মত যথেষ্ট প্রবল। পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি আগে থেকে জানতেন।

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহণ আকস্মিক। তিনি সেনানায়ক ছিলেন। জিয়ার শাসনামলে সেনা ছাউনিতে অশান্তি অব্যাহত ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে শীঘ্র দেশ শাসনে তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নামেন। আওয়ামী লীগ তখন তার প্রতিপক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখন এমন অবস্থায় যে, একে নিয়ে তার উৎকণ্ঠার কিছু ছিল না। তার চিন্তা ছিল, তার পক্ষে একটি রাজনৈতিক শক্তির সমর্থনের। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নেন নিজের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি গড়ার। নানা হিসেব-নিকেষ করে ঠিক করলেন তিনি তাদের জড়ো করবেন, যারা তার সাথে কাজ করতে রাজি হবেন। যারা সানন্দে তার নেতৃত্ব মেনে নেবেন। তিনি যাদের খুঁজে পেলেন, তারা দুই ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ। এক ধরনের- অতি বাম-ঘরানা, অন্যটি অতি ডান- ঘরানা। তারা তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি তার রাজনৈতিক সংগঠনে দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী ও মধ্যমপন্থীদের একত্র করেন। তবে যে রাজনৈতিক দলটি তাকে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ঘটাতে সহায়তা করে, সেই দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদকে বাইরে রাখেন।

জাসদের সশস্ত্র শাখার নেতা ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের। কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের সকাল থেকে কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক অভিলাষে শরিক হতে অস্বীকার করেন। কর্নেল তাহের যখন মুক্ত সেনাপ্রধান জিয়াকে তার সাথে ভাষা শহীদের স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনারে যেতে বলেন, ওখানে সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে বলেন, তিনি তা উপেক্ষা করেন। জিয়াউর রহমান পরের দিন ৮ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে বলেন যে সেনারা কয়েকজন আর্মি অফিসারকে হত্যা করেছে। জবানে তাহের বলেন, তিনি সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করবেন।

জিয়াউর রহমান ১১ নভেম্বর পর্যন্ত কর্নেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ রাখেন। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে পুনর্বহাল হওয়ার সময় থেকে তিনি ঘরে-বাইরে নতুন করে ঝামেলা মোকাবেলার স্নায়ুবিক চাপে ছিলেন। এমন চাপের মুখে অনেকটা পরোক্ষভাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি সেনাবাহিনীকে ভাগ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন ও শ্রদ্ধা দুটোই পাচ্ছিলেন, প্রয়োজন ছিল শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অফিসারদের অংশগ্রহণ। তারা যেন আহ্বান জানান সৈনিকরা স্বাভাবিক দায়িত্বে ফিরে আসুক।

জিয়াউর রহমান যেভাবে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, বিশেষ করে যেভাবে উপর-নিচের কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, তাতে তার ক্ষমতা সুসংহত হয়। জিয়া অতি দ্রæত সেনাবাহিনীতে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। তিনি ভালো করে জানতেন যে, দুর্ভাগ্য বরণের ঝুঁকি রয়েছে অনেক। দেশবাসী দেখছিল অবস্থা অনেকটা নড়বড়ে। তারাও সমভাবে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন।

জিয়ার শাসনামলের পুরো সময় আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটাই প্রধান কাজ ছিল। সেনাবাহিনীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সুসংহত বাহিনীর ভাবমর্যাদা গড়ে তোলা। জনগণের মধ্যে এমন আস্থা তৈরি করা যে সেনাবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় সক্ষম। প্রেসিডেন্ট জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে দেশের রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হন। তিনি সফলভাবে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেন। তার সংসদকে বলা হয়ে থাকে বর্ণীল সংসদ। নানা মত পথের নেতাদের সমাহার ঘটেছিল ওই সংসদে।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলের একেবারে শেষ দিকে শেখ হাসিনা স্বেচ্ছা-নির্বাসন থেকে দেশে আসেন। এর মাধ্যমে ভারতের সাথে জিয়া একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তখন ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে স্বামী সন্তানসহ অবস্থান করছিলেন। ১৯৭৬ সালের শেষভাগে জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বিশাল প্রতিবেশী ভারতের নির্মিত বাঁধের বিপক্ষে আড়াই মাসব্যাপী প্রচার অভিযান চালান। গঙ্গার পানির প্রবাহ আটকে দেয়ায় বাংলাদেশের পরিবেশ প্রতিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছিল। ফারাক্কা নিয়ে এমন প্রচার ও বিক্ষোভের অন্তরালে জিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে সমঝোতার টেবিলে আনা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী জিয়া ভারতকে আগ্রহী করতে পেরেছিলেন। তিনি নয়াদিল্লির সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কৃষিমন্ত্রী জগজীবন রাম ঢাকায় আসেন। জিয়াউর রহমান তার সাথে বৈঠকে মুজিব অনুসারীদের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে নয়া দিল্লির সমর্থন চান। জগজীবন রামের সাথে আলোচনায় জিয়াউর রহমান সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, অন্তর্ঘাত কর্মকাণ্ড নিবৃত করার ক্ষেত্রে ভারতের যেকোনো উদ্যোগে তিনি সমর্থন দিতে রাজি আছেন। শেখ হাসিনা ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকে তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন। তারা সীমান্তে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন। জগজীবন রাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করবেন। তবে অচিরে নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ভোটে হেরে যাওয়ায় এ নিয়ে অগ্রগতি হয়নি। ভারতের ক্ষমতায় আসেন মোরারজি দেশাই। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতির পরিবর্তন আসে। সঙ্ঘাতের স্থলে সমঝোতার নীতি চালু হয়। এর ফলে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে সাহায্য-সহযোগিতা দেয়ার ভারতীয় নীতির অবসান ঘটে

১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এবার জগজীবন রামের সাথে তার আলোচিত সমঝোতা প্রস্তাবের বাস্তবায়ন হয়। এর ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসতে দেন। জিয়াউর রহমানের মনে নিরাপত্তার ভুল ধারণা জন্মায়। তিনি মনে করেন ভারতের সাথে এমন সমঝোতায় তার শাসন ঝুঁকিমুক্ত হলো। কিন্তু ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার অল্পদিনের মধ্যে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এখন সারা দেশে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে । এখন দেশকে এবং এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বড় প্রয়োজন।

লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সাবেক নেতা


আরো সংবাদ



premium cement