২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কেমন হতে পারে পররাষ্ট্রনীতি

- প্রতীকী ছবি

আজকের লেখাটি লিখতে গিয়ে ছেলেবেলায় পড়া একটা ইরানি প্রবাদ মনে পড়েছে : ‘A good neighbour is better than one's relatives.’ আমার ধারণা, ইরানিরা এই প্রবাদের মর্মার্থ যতটা বুঝেছেন তার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ঢের বেশি উপলব্ধি করছেন, কখনো সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ হয়ে, কখনো পাখির মতো গুলি খেয়ে, কখনো শেয়াল-কুকুরের মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া লাশ হয়ে, কখনো বন্দী হয়ে, কখনো বা আহত হয়ে। অথচ সে দেশটি বলে বাংলাদেশ নাকি তাদের বন্ধু দেশ।

জুলাই ৩৬ এর শিক্ষার্থী ও জনতার বিপ্লবের পর দিল্লি প্রচার করে বাংলাদেশ তাদের জন্য ‘সিকিউরিটি থ্রেট’। এটা পুরোপুরি ইসরাইলি বয়ান। সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী ও জেনোসাইডাল। ইসরাইলের কাছে ফিলিস্তিন মাত্রই ‘সিকিউরিটি থ্রেট’। এই থ্রেট দূর করার জন্য তারা অসলো চুক্তির মাধ্যমে একটা বশংবদ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (Palestine Authority) পশ্চিমতীর ও গাজায় বসিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ২২ ভাগকে ফিলিস্তিন হিসেবে প্রচার করা (যেন ৭৮ ভাগ ইসরাইল নিয়ে কোনো কথা না ওঠে) এবং ওই ২২ ভাগের দৈনন্দিন বেসামরিক লোক প্রশাসনিক কার্যক্রম ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে করানো আর জলস্থল অন্তরিক্ষের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা। এটাকে আমরা বলতে পারি, জিওগ্রাফি মাইনাস ডেমোগ্রাফি।

তারা ফিলিস্তিনিদের নিজের করায়ত্তে রাখবে কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর কোনো দায়িত্ব নেবে না। ফিলিস্তিনিরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিধনযোগ্য এবং অধস্তন হয়ে থাকবে। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদসহ অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এই পরিকল্পনাকে বলেছিলেন, আরাফাতের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মাধ্যমে ফিলিস্তিন মুক্তির সংগ্রাম ঠিকাদারি আর পৌরসভা পরিচালনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চিন্তার বিষয় হলো, অবিকল না হলেও এই মডেলের সাথে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের মিল দেখা যায়। তারা এখানে একটা আজ্ঞাবহ সরকার বসাবে আর নিরাপত্তা হুমকির নামে বাংলাদেশের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকবে।

পাঠক খেয়াল করুন, দিল্লি এখন নিজেদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ দাবি করছে, অথচ একজন পতিত ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে। এটা শুধু বিজেপির নীতি নয়, কংগ্রেসেরও নীতি। আপনি যদি নিপাট ভদ্রলোক, লেখক কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের কথা খেয়াল করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাথে নাকি দিল্লির ‘ঐতিহাসিক সম্পর্ক’। এখন তাদের ‘ঐতিহাসিক বন্ধু’ হাসিনা বিপদে পড়েছে, তাই তাকে আশ্রয় দিয়ে বিজেপি সরকার ভারতীয় গণতন্ত্রের মান রক্ষা করেছে!

গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দিল্লি উষ্মা ও ক্ষোভ তৈরি করছে। তারাই আবার প্রচার করছে বাংলাদেশের জনগণ ভারতবিরোধী।

আদতে বাংলাদেশের জনগণ ইন্ডিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে নয়; দিল্লির বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে। আপনারা বাংলাদেশকে ‘সিকিউরিটি থ্রেট’ হিসেবে বিবেচনা করবেন, অথচ হাসিনাকে আশ্রয় এবং প্রতিবিপ্লবী কাজ করতে দিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করবেন আর বলবেন বাংলাদেশের মানুষ ভারতবিরোধী! বাংলাদেশের জনগণের সাথে সুসম্পর্ক চাইলে এটা বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশের আগের যেকোনো সরকারের চেয়ে কাঠামোগতভাবে ইউনুস সরকার আলাদা। কাগজে-কলমে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’। কিন্তু এই স্লোগানের বাস্তবায়ন হয়নি কখনো। আর হওয়ার সম্ভাবনাও কম, কারণ রাষ্ট্র থাকলে শত্রুও থাকবে।

শেখ মুজিবের সরকার চীনা ব্লাক, সৌদি ব্লককে কাছে টানতে পারেনি; জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সরকার সোভিয়েত আর ভারতের বিপক্ষে ছিল। এরশাদের সরকার অবশ্যই ভারতবিরোধী ছিল না। হাসিনা সরকার পাকিস্তানকে কাছে টানতে চায়নি, ভারতের অন্যায় আবদার রাখতে গিয়ে সার্ক অকার্যকর করে দিয়েছে। আর যেভাবে বাংলাদেশকে তিনি ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছিলেন সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা।

ড. ইউনুস স্বাভাবিকভাবেই উনাদের চেয়ে বেশ আলাদা কারণ তার মতো কেউ কখনো বাংলার মসনদে বসেনি। পৃথিবীতে মোট পাঁচজন ব্যক্তিত্ব আছেন যারা আগে নোবেল পেয়েছেন আর পরে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। ড. ইউনুস সেই পাঁচজনের একজন। আর সেই পাঁচজনের মধ্যে উনি একমাত্র অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

ড. ইউনুস ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটেছে। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব-পশ্চিমের বড় বড় দেশগুলো থেকে অভিনন্দন এসেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে ল্যাটিন আমেরিকা, কোনো দেশ এই অনির্বাচিত ইউনূস সরকারকে নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি। দেশ-বিদেশে সবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

ক্ষমতায় আসার পর ইতোমধ্যে ৬০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে ড. ইউনুস সরাসরি দেখা করেছেন। এর বাইরে জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক আর তাদের বিভিন্ন সংস্থার আবাসিক প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার কথা বাদ দিলাম। এই সাক্ষাৎগুলো সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না। প্রায় প্রতিটিতেই কৌশলগত আলাপ হয়েছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে এতগুলো লোকের সাথে দেখা করা, কথার লাইন ঠিক রাখা, টানা দাবা খেলার চেয়েও কঠিন মনে করি। এত এত সাক্ষাতের মানে ইউনুসের ফার্স্ট প্রায়োরিটি ডিপ্লোম্যাসি। আগে দেশের নিরাপত্তা আর অর্থনীতি ঠিক রেখে পরে উনি সংস্কারে হাত দিয়েছেন।

আর দিল্লির সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে ড. ইউনূস স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন মোদিকে, হিন্দুদের নির্যাতন নিয়ে কথা হয়েছে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল সাউথ সামিটে শতাধিক রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন, তার বক্তৃতায় ঢাকায় শিক্ষার্থীদের দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকার ব্যাপারটা বেশ সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, তার বক্তব্যের থিমই ছিল তারুণ্য।
বন্যার পর ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন। স্বাভাবিক আশা ছিল তিনি হয়তো রাষ্ট্রদূতকে দু’টি কথা শোনাবেন। তা না করে উনি বললেন, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা চাই’। এই বক্তব্যের কারণে গোদি মিডিয়ার অপপ্রচারে সমস্যা হয়েছে। ইউনুসবিরোধী প্রচারণা করা যাচ্ছে না। অন্য দিকে শব্দচয়নে ইউনুস-তৌহিদ বেশ সাবধানী। ফলে বাংলাদেশ থেকেও কোনো আওয়াজ উঠেনি যে ইউনুস ভারতের দালাল।

তা ছাড়া পাকিস্তানের সাথে গত ১৫ বছর অপ্রয়োজনীয় দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছিল হাসিনা। ৫৪ বছর আগের যুদ্ধ দিয়ে ইতিহাস চলে, জাতীয় চেতনা বা সংস্কৃতি চলে, পররাষ্ট্রনীতি চলে না। মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে হাসিনা সরকার অযৌক্তিকভাবে আমাদের স্বাভাবিক ট্রেড পার্টনার পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ইউনুস পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে সবার সামনেই বললেন, ‘আমরা সার্ক পুনরুদ্ধার করতে চাই’। উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৬ সালের সার্ক সামিট ইসলামাবাদে হওয়ার কথা ছিল। হাসিনা আর মোদি তখন প্ল্যান করে যেতে রাজি হননি। তখন থেকেই সার্ক অকার্যকর। এর বাইরে ইউনুস সরকার পাকিস্তান থেকে অস্ত্র কিনতে যাচ্ছে। আগামী মাসেই আসবে অস্ত্রের প্রথম চালান। এতে আসবে ৪০ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ, ২০০০ ট্যাংকের গোলা, ৪০ টন বিস্ফোরক, ২৯০০ কামানের গোলা। ড. ইউনুস এগুলো গোপনে কিনতে পারতেন। অস্ত্রের চালান বেশির ভাগ সময় গোপনে আসত। যে কারণে আমরা এতদিন জানতাম না যে শেখ হাসিনা পাকিস্তানের কাছ থেকে অস্ত্র কিনত, যদিও এত বেশি পরিমাণে না। কিন্তু ইউনুস পাকিস্তান থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র কিনছেন। এর উদ্দেশ্য ভারত আর মিয়ানমারকে স্পষ্ট বার্তা দেয়া।

জাতিসঙ্ঘের ৯৯তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ICPPED চুক্তিতে সই করল। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে গুম হলে ICPPED কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। আয়নাঘর ধরনের কোনো কিছু যেন আবারো বাংলাদেশে না ঘটে, তার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন কোনো সরকারের আর এটা বলার সুযোগ নেই যে কে নিখোঁজ বা কে খুন হলো, সেটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, জাতিসঙ্ঘ এটা নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

ড. ইউনূস আসিয়ানের সভাপতি দেশ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন উনি বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্য করতে চান। তা ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের রয়েছে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং মালয়েশিয়াতে সাতটি ইউনূস সেন্টার রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন ৫৩ সদস্যবিশিষ্ট এক বিশাল বহর নিয়ে এবং সেখানেও আসিয়ানের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে মনে করি। এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মুক্তির পথ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটস্থ প্রতিবেশী ভারত। ভারত আর বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে দুটো আলাদা সত্তা হতে পারে কিন্তু ভ‚গোল, জাতি, ইতিহাস, রাজনীতিতে মিল আছে। এর সাথে যুক্ত নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান। এসব দেশের মধ্যে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা, কাঁটাতারের বেড়া দেয়া মানে অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়, বরং দেশের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে অস্বীকার করা। এর ফলে ভারত ছাড়া বাকি সব দেশ, এমনকি নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাও ছোট ছোট খাঁচায় পরিণত হয়েছে। এই খাঁচাগুলোর আকার ছোট। যার কারণে কেউ কোনো দিন স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। প্রত্যেকটাকেই ভারত উপনিবেশ মনে করে। এই অবস্থার জন্য মোদি, হাসিনা, খালেদা বা অন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না। ভ‚গোলটাই এরকম যে এই খাঁচাগুলোর নির্ভরশীলতা ভারতের ওপর।

বাংলাদেশে ড. ইউনূস আসুন বা অন্য কেউ, আমাদের ভারত যাওয়া কমবে না। বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, পড়াশোনা, খাবার, পর্যটন, প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে আমরা ভারত যেতে বাধ্য। পাকিস্তানও অর্থনৈতিকভাবে ভারতের কাছে জিম্মি। এই জিম্মি হওয়ার প্রতিদান হিসেবে ভারত কিছুটা সদয় হতে পারত। কিন্তু হয়নি। যার ফলে প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষ ভারতবিদ্বেষী। তাহলে উপায় কী? ভারতের কলোনি হয়ে বসে থাকা? নাকি ভারতের নাগরিকদের সমান সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিলুপ্ত করে ভারতের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া? কোনোটাই না।

ভারত-নির্ভরতা সম্পূর্ণ না কাটলেও ভারতের প্রভাব অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনার, দেশকে অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত করার একটা পথ হতে পারে আসিয়ান। আমরা আসিয়ানের ঠিক বর্ডারে বাস করি। সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের কোনো মিল না থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোগতভাবে অনেক মিল আছে।

যেকোনো আঞ্চলিক সহযোগিতার প্লাটফর্মে যদি একটা দানব বাস করে তাহলে সে প্লাটফর্ম কাজ করে না। যে কারণে চীন, রাশিয়া বা আমেরিকা নিয়ে কোনো আঞ্চলিক জোট করা যায়নি। এই একই কারণে সার্কও খুব একটা কাজ করবে বলে মনে হয় না। কারণ ভারতও একটা দানবের নাম।

ভারত নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে খালেদা জিয়ার সরকার ‘লুক ইস্ট’ পলিসি হাতে নিয়েছিল যা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। লুক ইস্ট বাস্তবায়ন হলে বা আমরা আসিয়ানে ঢুকতে পারলে কী হবে? আপনি হানিমুনে আর কাশ্মির যাবেন না। কারণ বাই রোড অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে ব্যাংকক যেতে পারবেন, ৫০ হাজার টাকা খরচে ইন্দোনেশিয়া ঘুরে আসা যাবে। চিকিৎসা করাতে আর চেন্নাই যাবেন না, যাবেন ব্যাংকক, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর। এমনকি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সম্প্রতি সফরে এসে বাংলাদেশীদেরকে দাওয়াতও দিয়ে গেছেন মালয়েশিয়ায় সস্তায় চিকিৎসা নেয়ার জন্য।

আর সুবিধা হলো, চীনের সাথে আমাদের BICM করিডোর হওয়ার কথা ছিল গত দশকে। এটা হলে কলকাতা, ঢাকা, বার্মার মান্ডালায় এবং চীনের কুনমিং সড়কপথ ও পরে রেলপথ যুক্ত হতো, আমরা অনেক সহজে চীন যেতে পারতাম, চীন থেকে পণ্য আনতে পারতাম। এই ভয় থেকেই ভারত BICM বাতিল করে দিয়ে নতুন প্রকল্প করেছে যেখানে চীন, বার্মা, ভারত আছে কিন্তু বাংলাদেশ রাখে নাই ।

চীনের BR প্রকল্প তখন বঙ্গোপসাগরকেও যুক্ত করতে পারবে। এবার আর আকিয়াব দিয়ে না, পায়রা আর মংলা এতে যুক্ত হতে পারবে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে আমাদের শ্রমবাজার প্রসারিত হবে। প্রযুক্তির দিক থেকে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়বে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আসিয়ানের দেশগুলোতে পড়তে যেতে পারবে। আমাদের এখানে ওরাও পড়তে আসতে পারবে। ভারতের খাঁচানীতি বা ‘বিশ্বের সাথে যুক্ত হতে চাও তো আমার ওপর দিয়ে যাও’ নীতি বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশ একটা গ্লোবাল ভিলেজে প্রবেশ করবে।

কিন্তু আসিয়ানে প্রবেশের পথ খুব কঠিন হবে বাংলাদেশের জন্য। আসিয়ানভুক্ত দেশ ১০টি। এর মধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া নিশ্চিত আমাদের পক্ষে ভোট দেবে। দু’টো দেশ থেকেই আমরা প্রচুর পরিমাণে আমদানি করি। তারাও বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। ব্রুনেই এর সুলতান বাংলাদেশকে অত্যধিক পছন্দ করেন। তিনিও পক্ষে থাকবেন বলে মনে করি।

ফিলিপিন্স বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কথা। কারণ তাদের সাথেও আমাদের বাণিজ্যের আরো সুযোগ রয়েছে। আর বাংলাদেশ-ফিলিপিন্স দুটোই এখন ইউএস ও চীনের বন্ধু। এখানে নিশ্চিত চার ভোট। অন্য দিকে নিশ্চিত বিপক্ষে যাবে মিয়ানমার। এর কারণ ব্যাখ্যা করার জরুরত নেই। বিপক্ষে থাকবে ভিয়েতনাম। কারণ উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এটি। তারা চাইবে না আসিয়ানে চীনের বিনিয়োগে বাংলাদেশ ভাগ বসাক। অথবা বাংলাদেশ আসিয়ানের মুক্তবাজার অর্থনীতির চুক্তিতে আসুক। ঐতিহাসিকভাবে লাওস পররাষ্ট্রীয় প্রায় সব ক্ষেত্রে ভিয়েতনামকে অনুসরণ করে তাই লাওস বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দেবে। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই এ তিনটি দেশের ভোট আমরা পাবো না।

বাকি রইল সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া। প্রথম দুটো দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। আর থাইল্যান্ড যা বলবে কম্বোডিয়া তাই করবে। কিন্তু এদের ভোট কোনদিকে যাবে তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ আসিয়ানে ঢুকলে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড দু’টো দেশেরই লাভ আছে কারণ বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে বাংলাদেশের সাথে। ভারত থেকে সরে আমরা অনেক বেশি আসিয়ানের দিকে যেতে পারব। থাইল্যান্ডে পর্যটক ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক আয় হবে।

কিন্তু এখানে রাজনৈতিক ঝামেলা আছে। বাংলাদেশ কিন্তু একেবারে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ না। এটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ। আমাদের ভাষা, ভ‚গোল, সংস্কৃতি ও জাতি কিছুই মিলে না আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথে, যদিও কয়েকটি দেশের সাথে ধর্মীয় দিক থেকে মিল রয়েছে। আর এ জন্য আমাদের প্রতি কিছুটা রাজনৈতিক অবিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। ওরা যেভাবে বিশ্বকে দেখে, অবশ্যই আমরা সেভাবে দেখি না। ফলে কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অবস্থান আসিয়ানের পুরো প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেবে কি না, প্রশ্নবিদ্ধ করবে কি না সেটা চিন্তার বিষয় হতে পারে।

অন্য দিকে আসিয়ান অত্যন্ত শান্ত এলাকা। এখানে বড় বড় শক্তির আধিপত্য নিয়ে মারামারি নেই। চীন আর ইউএসের প্রভাব কোথায় কতটুকু তা নির্ধারিত ও স্থিতিশীল। এর বিপরীতে বাংলাদেশ নিয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়ার বেশুমার মাথাব্যথা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো একটা দেশকে যুক্ত করলে আসিয়ানের শান্ত পরিবেশ আবার নষ্ট হয়ে যায় কি না। বাংলাদেশ আসিয়ানকেও আবার ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের চিপায় টেনে আনে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন আকারে হাজির হতে পারে।

এর বাইরে আরেক বড় সমস্যা ভারত। ভারত বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য চাপ দিলে মনে হয় না থাইল্যান্ড বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে। তাহলে কি আসিয়ানে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা শেষ? আমার মনে হয় না। এই যুগ রাজনীতির না, অর্থনীতির যুগ। প্রতিটা দেশ এখন তার বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেয়। সেখানে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি আর বিশাল এক বাজার আসিয়ানের জন্যও নতুন সম্ভাবনা। বাংলাদেশ সরকারের এখন অত্যন্ত ধীরগতিতে আগানো দরকার এবং নতুন পরিস্থিতিতে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রকে একসাথে রাজি করতে হবে যেন তারা বাংলাদেশকে আসিয়ানে ঢুকাতে ভূমিকা রাখে।

ভারতকেও কোনো একটা লোভনীয় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যেন সে প্রভাব খাটানো বন্ধ করে। আসিয়ানে ঢোকার আগেই আসিয়ানের সাথে নন এফটিএ চুক্তির আওতায় বাণিজ্য রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। আর একটা কঠিন ক‚টনৈতিক ফাইট দিতে হবে যেন দ্বিপক্ষীয়ভাবে কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়।

আমি অনেক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ছি শুধু এই দিনটা দেখার জন্য যে একদিন ভিসা ছাড়া ভিয়েতনাম যাবো, শুল্কমুক্তভাবে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা দেশে আসবে, লাওসের ছেলেমেয়েরা এই দেশে আসবে মেডিক্যাল ডিগ্রি নিতে। এটা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক স্বপ্নের দিন, মুক্তির দিন এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে স্বাধীন ও আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর দিন।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও ভাষাবিদ
Email : sahidsams7@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement