২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

খেলাপি ঋণ আর কত বাড়বে

- প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ আবর্তিত হয় ব্যাংক খাত ঘিরে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সমৃদ্ধি ও দুর্বলতা অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। অর্থ মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ব্যাংক খাতের গতি-প্রকৃতি জীবন ও জীবিকায় প্রভাব রাখে। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ব্যাংক খাতের যে ভয়াবহ ক্ষতি করে গেছে তা দেশের ব্যবসায়ী ও আমানতকারীসহ কারো বুঝতে বাকি নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তার শাসনামলে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন।

তিনি আরো জানান, এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার সহযোগীরাই নিয়েছেন অন্তত ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। তিনি জানান, এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক দুই লাখ কোটি টাকা (এক হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ভয়াবহ খাদের কিনারে পতিত হয়। যার ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বিরাট শূন্যতা দেখা দেয়। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত খেলাপি ঋণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের উৎপাদনমুখী সব শিল্প খাতে। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশিই তথা ৫৪.৩২ শতাংশ রয়েছে পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া, জাহাজ নির্মাণসহ উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৩ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৫৬ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ৭২ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৫৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এত দিন যা স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর কারসাজিতে চাপা পড়েছিল। আরেকটি বিষয় হলো- পুনঃতফসিল যা খেলাপি ঋণ হিসেবে রিপোর্ট হয় না অথচ ব্যাংক বিনিয়োগের এটি ভয়াবহ ক্যান্সার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সালের শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরী পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এ ছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল), ব্যবসায়িক (ট্রেডিং) ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে। ব্যাংকগুলো ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এছাড়া ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংক খাতের মোট পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পুনঃতফসিল করা ঋণের সাথে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে পাঁচ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর সাথে অনেক ব্যাংকের পরিচালকদের নেয়া ঋণ বিবেচনায় নিলে প্রকৃত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। বিগত সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে শিল্প উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। আবার দাম বাড়ানোর পরও চাহিদামতো সরবরাহ মেলেনি। উদ্যোক্তারা বলছেন, এর ফলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ে ব্যবসায়ীদের ওপর। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। অবস্থায় শতভাগ উৎপাদন না হলেও জ্বালানি ও জনবলের ব্যয় ঠিকই মেটাতে হয়েছে। আর দিন শেষে তা মালিকের মূলধন থেকেই যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সে সক্ষমতাও কম। এ অবস্থায় তারা খেলাপি হচ্ছেন। সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে।

পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এছাড়া নির্মাণ শিল্প ও কৃষি উৎপাদন খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্প রয়েছে যেগুলো শিল্প খাতের কাঠামোকে ধারণ করে। দুর্ভাগ্য হলো- এ সব খাতেও খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তৈরী পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও বাণিজ্যিক খাতে। যদিও সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে আছে চামড়াশিল্প। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে জাহাজ নির্মাণ ও তৈরী পোশাক খাত। এসব খাতে খেলাপির হার প্রায় ১৪ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৩ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি হঠাৎ সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা সমস্যারই ধারাবাহিকতা। কারণ কয়েক বছর ধরে প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অথচ এ সময় ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ সব ধরনের সুবিধার দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে। কোনো সুবিধাই খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন থেকে খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণ এবং এর বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার জানা যায়। এতে দেখা যায়, উৎপাদনশীল শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে তৈরী পোশাক খাতে। ২০২৩-এর শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এক বছর আগেও এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১২ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় তিন হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরো বেশি, প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এই খাতটি খেলাপি ঋণের হারে বর্তমানে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০২৩ সাল শেষে বস্ত্র খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩০ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। নির্মাণ খাতেও এক হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপি ঋণ। কৃষি খাতেও গত বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২৩ সাল শেষে কৃষি খাতেও খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে চার হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ৫০১ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ফলে গত বছর খাতটিতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১৪১ কোটি টাকা, যা গত বছর কমে হয়েছে আট হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। মূলত শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্য খাতে ঋণ দিয়ে বিপাকে আছে ব্যাংক। পুরো ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ ঋণখেলাপি হয়েছে তার ৬৬ শতাংশই শিল্প ও পোশাক খাতে। যদিও খাত দু’টি ব্যাংকের ব্যবসার প্রধানতম খাত। এসব খাতে অনিয়ম ও জালিয়াতির ঋণ ব্যাংককে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত সরকার কিছু প্রভাবশালী বড় ব্যবসায়ীকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার বিভিন্ন চিঠি, সার্কুলার ইস্যু করেও খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি। যে হারে পুনঃতফসিল হয়েছে যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। প্রভাবশালী শিল্প উদ্যোক্তারা পুনঃতফসিল করেছেন কোটি কোটি টাকার ঋণ। বিপরীতে কিস্তি পরিশোধ করেননি। যার প্রভাব গোটা ব্যাংক খাতকে নাড়া দিচ্ছে। ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট ও ঋণের বিপরীতে আদায় কম, খেলাপি ঋণ বিশেষ করে শিল্প ও পোশাক খাতে পুনঃতফসিলের বিপরীতে কিস্তি কম আদায় ব্যাংক খাতকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণের এ ভয়াবহ জঞ্জাল থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের আইনানুগ পদক্ষেপ জোরদার করা উচিত। অর্থ ঋণ আদালতের কার্যক্রম বেগবান করা যেতে পারে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মানুযায়ী ঋণ আদায়ের জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও খেলাপি ঋণের হার কোনোভাবেই কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। এটি আমাদের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। সময়মতো এর ব্যবস্থা না নিলে তা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

আর একটি বিষয় হলো বেনামি ঋণ। আমাদের দেশে বেনামি ঋণের আলাদা হিসাব হয় না। বেনামি ঋণের পরিমাণ কত, তা বের করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে, খেলাপি ঋণ প্রকৃত অর্থে কত। বেনামি ঋণের দায়ভার ব্যাংকারদের ওপর পড়ে না। কারণ, ব্যাংকারদের বাধ্য করা হয় এসব ঋণ দিতে। প্রভাব খাটিয়ে ঋণ দেয়া বন্ধ করতে হবে।

খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে রোডম্যাপ ঘোষণা করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো বাছ-বিচার না করে সবার বিরুদ্ধে সমানভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে শিল্প ও পোশাক খাতসহ সব ধরনের বিনিয়োগ কাঠামো টেকসই করতে হবে। এ জন্য কার্যকর পদক্ষেপের বিকল্প নেই।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement