পরবর্তী টার্গেট কি প্রশাসনিক বিদ্রোহ
- মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
- ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০:০১
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এর মোকাবেলা করতে না পারলে ’২৪-এর স্বাধীনতা বিফল হতে পারে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে পতিত স্বৈরাচার আবার দেশের রাজনীতিতে ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও তেমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিগত স্বৈরাচারী সরকার যে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছিল সেই অর্থ ও সম্পদের বিনিময়ে তারা আবারো রাজনীতিতে ফিরে আসতে চায়। স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দোসরদের মাধ্যমে সরকার বিপুল অর্থ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। যেমন প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী বিদেশে তিন শতাধিক বাড়ির মালিক হয়েছেন। শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছেন, তার গৃহকর্মী ৪০০ কোটি টাকার মালিক এবং হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না।
বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিগত সরকারের মন্ত্রী আমলারা বিদেশে পাচার করেছেন।
গত জুলাই ২০২৪-এ কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটিকে সরকার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় আন্দোলনটি আরো বেগবান হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ভ্যাকেট করার মাধ্যমে এ আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হলে সেটি দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলে আন্দোলনটি চূড়ান্তভাবে এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয় ও সর্বশেষ ৫ আগস্ট ২০২৪ এ তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানে বসেও তিনি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এর প্রথম পদক্ষেপ ছিল বিচার বিভাগীয় ক্যু ঘটানোর চেষ্টা। কিন্তু ছাত্র জনতার সতর্ক পদক্ষেপে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সম্প্রতি শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয় সোস্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তিনি বলছিলেন, তিনি বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করছেন এবং যেকোনো মুহূর্তে চট করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বেন। দেশের মানুষ বুঝতে পারে, তিনি আবারো ফিরে আসার ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি বাইরে থেকে তার অনুগত প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে বর্তমান সরকারকে অবৈধ ও অকার্যকর করতে চান। যাতে আবার রাজনীতিতে ফিরতে পারেন।
সম্প্রতি মিরর এশিয়ার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর যে বিশেষ পরিকল্পনা বিগত দিনগুলোতে চলে আসছিল সেটিকে আরো জোরদার করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অকার্যকর করার লক্ষ্যে তাদের ষড়যন্ত্রের একটি দিক হলো সরকারকে জঙ্গিবাদ সমর্থিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা। তাই তারা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জামায়াতের ভূমিকা বড় করে দেখানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। এ ছাড়াও নানা মহলে বিদ্রোহ সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলা চরমভাবে বিঘিœত করা। সেটি গোপালগঞ্জে আওয়ামী সমর্থকদের বিক্ষোভে স্পষ্ট হয়। তারা এক ব্যক্তিকে হত্যা করে, এমনকি সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে তাদের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা, আনসারদের বিদ্রোহ। ছাত্র-জনতা তাদের এই দুরভিসন্ধিও নস্যাৎ করে দেয়। তৃতীয়ত, পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দেশে সুবিধাপ্রাপ্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একটি বড় ধরনের প্রতিবিপ্লব করতে চেয়েছিল।
এখন পরবর্তী টার্গেট কী হতে পারে সে বিষয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করলে কিছুটা অনুমান করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। যেমন- একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল অফিসার সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে লক্ষ করে শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি শহীদ আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী বলে কটাক্ষ করেছেন। বিচার প্রশাসনের একজন সিনিয়র অফিসার চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার সাহস ও শক্তি কোথা থেকে পান? এটি জনগণের প্রশ্ন। বোঝা যাচ্ছে, প্রশাসনে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এখনো সক্রিয়। বাইরের নির্দেশনা পেলেই তারা স্বৈরাচারকে ফিরিয়ে আনার জন্য মাঠে নামবে।
এটি প্রশাসনিক বিদ্রোহের ইঙ্গিত বহন করে। প্রশাসনে বিগত সরকারের কর্মকর্তাদের বহাল রাখার মাধ্যমে তাদের বিদ্রোহ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনই মন্তব্য করছেন বিদগ্ধজন। আমাদের মনে থাকার কথা, বিএনপি সরকারের পতনের পেছনে সিভিল প্রশাসনের অসহযোগিতা ও বিদ্রোহ বড় কারণ ছিল।
বর্তমানেও ১৭ বছর ধরে বিন্যাসকৃত প্রশাসনে স্বৈরাচারের অনুসারীরাই বসে আছে এবং কোনো নাজুক সময়ে তারা সম্মিলিতভাবে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে অন্তর্বর্তী সরকার বিপন্ন হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমনটি হলে ছাত্র-জনতার বিপ্লব, সহস্রাধিক শহীদের রক্ত বৃথা যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, এটি কি আদৌ সম্ভব বা সম্ভব হলে কিভাবে?
‘আওয়ামী লীগের আরেকটি যুদ্ধ ঘোষণাকে কোন চোখে দেখব’ শিরোনামে গত ৭ অক্টোবর প্রথম আলোতে লিখেছেন অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দিন। তিনি দেখিয়েছেন,
বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের পর বিপ্লবে পরাজিত শক্তি কিভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীতিতে ফিরে আসে। তিনি ১৯৮৬ সালের ফিলিপাইন ও ১৯৯১ সালে হাইতির উদাহরণ তুলে ধরেন। এ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন- মেক্সিকো, কলম্বিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, সুদান, জিম্বাবুয়ে ও নাইজেরিয়াসহ আরো বিভিন্ন দেশে যেখানে স্বৈরশাসকের পতন হয়েছিল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেখানে জনগণ মনে করেছিল যে, এ সব স্বৈরশাসক আর কখনোই ক্ষমতার মেইন স্ট্রিমে আসতে পারবে না কিন্তু দেখা যায় তারা অতি অল্প সময়ের ভেতরে আবারো পুনরায় মূল রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে এবং কোথাও কোথাও ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ও দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছে। কিন্তু কিভাবে তারা এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন? এ মাধ্যমটি হলো দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল যে অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছিল তার যথাযথ ব্যবহার। ওই সব স্বৈরশাসক গণ-অভ্যুত্থানে দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশের বাইরে থেকে পরিকল্পিতভাবে ওই সব অর্থ দিয়ে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্রয় করে তাদের ওপর ভর করে আবারো ফিরে এসেছিলেন।
বিভিন্ন রিপোর্টের বরাতে জানা যায়, বিগত স্বৈরাচারী সরকার ও তার মন্ত্রী আমলারা এ দেশ থেকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এই অর্থ দিয়ে প্রশাসনের সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের প্রত্যেককে কিনে ফেলা সম্ভব। তারা স্বৈরাচারের ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নাশকতা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে।
এটি এ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এ জন্য সবার আগে দরকার, স্বৈরাচারী সরকারের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ চিহ্নিত করে তা ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। যাতে স্বৈরাচারীরা সে অর্থ ব্যবহার করার সুযোগ না পায়। বিদেশে বাংলাদেশী মিশনে দ্রুত মিশনপ্রধান পরিবর্তন করা দরকার। কারণ, তাদের অসহযোগিতার কারণে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার হওয়া ব্যাহত হতে পারে।
যাদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দেশে রয়েছে তাদের সেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী ও আধুনিকায়ন করতে হবে। সেখানে সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে। সরকারকে এসব অবৈধ লেনদেনের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং যারা বিপুল অর্থের বিনিময়ে স্বৈরাচারীদের সুরক্ষা দিচ্ছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতোমধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে জনসমাজে আলোচিত হচ্ছে।
এগুলো ছাড়াও সরকারকে আরো নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় ও ভূমিকা খতিয়ে দেখতে হবে। তাদেরকে নীতি নির্ধারণীমূলক পদ থেকে সরাতে হবে। যারা নিয়ম ভঙ্গ করেছেন এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকেছেন, দুর্নীতি করেছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সবপর্যায়ের সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনিক কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি বা শিথিলতা দেখা গেলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনে যারা সৎ ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয় তাদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ ক্ষেত্রে যদি তারা জুনিয়র হয় তাদেরকে প্রমোশন দিয়ে উচ্চ পদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। ইতঃপূর্বে স্বৈরাচারী সরকার যেসব সৎ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত অফিসারদের বাধ্যতামূলক অবসর অথবা চাকরিচ্যুত করেছেন তাদেরকে পুনরায় দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে হবে।
পুলিশ ও র্যাব প্রশাসনের ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব পুলিশ অফিসার বিগত ১৫ বছরে সরকারদলীয় কর্মী হিসেবে মানুষকে গুম, খুন ও হত্যা করেছে তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পুলিশ ও র্যাব সদস্যদেরকে নিয়মিত নৈতিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পিএসসির মাধ্যমে এক বা একাধিক বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণ করে শূন্য পদ পূরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সততা ও নিষ্ঠার সঠিক তদন্ত করতে হবে এবং সততা ও দক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। একইভাবে বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে এক বা একাধিক বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণ করে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৎ ও মেধাবী প্রার্থীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
এসব সংস্কার ধাপে ধাপে করতে হবে। প্রথমে টপ মোস্ট পজিশনগুলোর পরিবর্তন করতে হবে এবং ধীরে ধীরে নিম্নপর্যায়ে আসতে হবে তবে সব ক্ষেত্রেই সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে পারলে কাক্সিক্ষত সংস্কার সম্ভব হবে। অন্যথায় স্বৈরাচারের দোসররা সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য যেকোনো সুযোগ কাজে লাগাবে। আর তাতে ’২৪-এর স্বাধীনতা বিফলে যাবে শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অনেক গুরুদায়িত্ব। একই সাথে আছে জনগণের বিপুল প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে যথাসময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছপা হওয়া চলবে না।
লেখক : অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা