জাতিসঙ্ঘে ভেটো ক্ষমতার বিলোপ চাই
- জালাল উদ্দিন ওমর
- ২২ অক্টোবর ২০২৪, ২০:১০
আগামী ২৪ অক্টোবর জাতিসঙ্ঘের ৭৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৫ সালের এই দিনে জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যুদ্ধ-সঙ্ঘাত স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জাতিসঙ্ঘের লক্ষ্য বাস্তবতার নিরিখে পূরণ হয়নি; বরং সংস্থাটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকন্তু এটি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ আরো বেড়েছে। বেড়েছে হিংসা-বিদ্বেষ, বৈষম্যও। জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পর অনেক দেশ স্বাধীনতা হারিয়েছে। ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো বৃহৎ রাষ্ট্রের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তাই বিশ্ব এখনো অশান্তি ও অস্থিরতায় ভরা।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতে জর্জরিত বিশ্ব এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। নিরপেক্ষ ও যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে জাতিসঙ্ঘের প্রতি বিশ্ববাসীর সৃষ্টি হয়েছে চরম আস্থাহীনতা। সংস্থাটি এখন আস্থার সঙ্কটে পতিত। তাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে এর সংস্কার দরকার। এ অবস্থায় জাতিসঙ্ঘের কাছে বিশ্ববাসী আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং গঠনমূলক ভূমিকা আশা করে। স্বাভাবিকভাবেই জাতিসঙ্ঘের কার্যক্রম পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং নৈরাজ্য থেকে মুক্তির দেয়ার জন্য ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় লিগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জ। কিন্তু বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর অবাধ্যতা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় সেই লিগ অব নেশনস কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ক্রমে সেটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে লিগ অব নেশনস চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ভেঙে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অশান্তি দূর করার জন্য আবার ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসঙ্ঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তি- যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্স জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠাকালে জাতিসঙ্ঘের সদস্য ছিল ৫১টি দেশ। বর্তমানে ১৯৩টি। শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রগুলো অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে জাতিসঙ্ঘের সদস্য হলেও বিশেষ করে এর সদস্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কখনো নিরপেক্ষ ছিল না। তাই জাতিসঙ্ঘ বৃহৎ শক্তিগুলোর হাত থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ- জাতিসঙ্ঘ সনদেই এটির প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য নাকচ করা হয়েছে। সেটি হলো ভেটো ক্ষমতা। ভোটা ক্ষমতা আছে বৃহৎ পাঁচ রাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (এখন রাশিয়া), ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্স। এরা সম্মিলিতভাবে কৌশলে এই ভেটো ক্ষমতা প্রবর্তন করেছে এবং মালিকানা চিরস্থায়ী করে নিয়েছে। এই ভেটো ক্ষমতার মাধ্যমে সব রাষ্ট্রের সমানাধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। বলা যায়, বৃহৎ পাঁচটি রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। জাতিসঙ্ঘ কখনোই এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি; বরং তারাই জাতিসঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই পাঁচটি রাষ্ট্রের মধ্যে যার ক্ষমতা যত বেশি সে জাতিসঙ্ঘকে তত বেশি নিয়ন্ত্রণ এবং নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী তাই যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে গেছে জাতিসঙ্ঘের সার্বিক নিয়ন্ত্রক। এই বৃহৎ পাঁচটি রাষ্ট্রের কৃতকর্মের জন্য যখনই জাতিসঙ্ঘে তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব এসেছে তখনই এরা ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাতিল করে দিয়েছে। ফলে সংস্থাটি দিনে দিনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর আস্থা হারিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ সনদের মূল কথাই ছিল সব রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি বা রাষ্ট্র্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। কেউ অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করবে না, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে সমাধান হবে এবং জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। কিন্তু বাস্তবে বৃহৎ শক্তিগুলো বরাবরই বিপরীত ভূমিকা নিয়েছে। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য বৃহৎ শক্তিগুলো সবসময় গায়ের জোরে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন অন্যায়ভাবে দখল করেছে ইরাক-আফগানিস্তান। লিবিয়ায় আগ্রাসন চালিয়ে মোহাম্মদ গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করেছে। জাতিসঙ্ঘকে পাশ কাটিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালিয়েছিল। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন চালিয়েছিল আফগানিস্তানে আগ্রাসন। প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
আজ থেকে ৭৬ বছর আগে ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘে কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য গণভোট অনুষ্ঠান এবং গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়ন হয়নি বৃহৎ শক্তিগুলোর অনীহার কারণে। বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দূর ভবিষ্যতেও নেই। সেই ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবৈধ রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে সীমাহীন বর্বরতা। এটি তো বিশ্ববাসীর কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ফিলিস্তিনের ওপর পরিচালিত ইসরাইলি গণহত্যা ও নির্যাতন জাতিসঙ্ঘ বন্ধ করতে পারেনি। কারণ জাতিসঙ্ঘে এ পর্যন্ত যতবারই ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব এসেছে ততবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। একই কারণে বসনিয়ার দুই লাখ মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ সার্বদের বর্বরতা থেকে বসনিয়ার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। চেচনিয়া, কসোভো, আর মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি সেই একই কারণে। অথচ জাতিসঙ্ঘ ঠিকই পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সেখানে গণভোট করেছে। সেই গণভোটের রায় অনুযায়ী পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করে দিয়েছে। পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদান যেহেতু খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা এবং এটি যেহেতু মুসলিমপ্রধান ইন্দোনেশিয়া ও সুদানের অন্তর্ভুক্ত, তাই মুসলমানদের কাছ থেকে খ্রিষ্টানদের স্বাধীন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা একাট্টা ছিল। তারা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে গণভোট করে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।
অতএব এটা স্পষ্ট, জাতিসঙ্ঘ আজ সম্পূর্ণভাবে বৃহৎ শক্তিগুলোর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে জাপানে আণবিক বোমা হামলা চালিয়ে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করে। দেশটি হাজারবারেরও বেশি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এবং মজুদ করে রেখেছে ১০ সহস্রাধিক পারমাণবিক অস্ত্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রই আবার পরমাণু প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টার দায়ে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৭৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এই ৭৯ বছরে জাতিসঙ্ঘের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কেবল ব্যর্থতা ও পক্ষপাতিত্বের ইতিহাস। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও জাতিসঙ্ঘ তা কখনোই পালন করতে পারেনি। পরিণত হয়েছে বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে। এভাবে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর ন্যায্য অধিকার বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
তাই জাতিসঙ্ঘে বৃহৎ শক্তিগুলোর ভেটো ক্ষমতার অবসান ঘটানো দরকার।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ভেটো ক্ষমতার বিলুপ্তি কাম্য। বিশ্ববাসী জাতিসঙ্ঘের কাছে সবসময় নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও বলিষ্ঠ ভূমিকাই আশা করে। আগ্রাসন ও যুদ্ধ থেকে জাতিসঙ্ঘ ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসহ সবার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে বিশ্ববাসীর সেটিই চাওয়া। বৃহৎ শক্তির তল্পিবাহক না হয়ে দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আশা-ভরসার প্রতীকে পরিণত হবে সেই আশাবাদ সবারই। জাতিসঙ্ঘ বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল হোক, এই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল- omar_ctg123@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা