১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩০, ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সরকারের মেয়াদ ও আগামী নির্বাচন

- ফাইল ছবি

কিছু দিন ধরে নানা মহলের মানুষের মধ্যে একটি বিষয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলোÑ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন বা কখন নির্বাচন হবে। অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব হঠাৎ ঘটে গেছে। আসলে তা নয়। বিখ্যাত একজন জার্মান দার্শনিক বলেন, বিপ্লব কখনো হঠাৎ করে ঘটে না, এর জন্য একটি দীর্ঘ প্রস্তুতি দরকার হয়। বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই একটি বিপ্লবের অবস্থায় ছিল এবং সেই বিস্ফোরণটা ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্টে) ঘটে গেল। পৃথিবীতে আমরা অনেক বিপ্লব দেখেছি। ১৭৭৯ ফরাসি বিপ্লব, ১৭৭৬ আমেরিকান বিপ্লব, ১৯১৭ রুশ বিপ্লব, ১৯৭৯ ইরান বিপ্লব, ১৯১০ আরব বসন্ত, সবশেষ আমাদের ২০২৪ আগস্ট বিপ্লব। বিপ্লবের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে তারাই একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছে। তবে কিছু সরকার এমনও দেখা গেছে, যারা প্রচলিত সংবিধানের কিছুটা পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করে।

বস্তুত, গণ-অভ্যুত্থান বিদ্যমান সংবিধানকে অকার্যকর করে দেয়। তাতে উদ্বেগের কিছু নেই। দুনিয়ার বহু দেশে এমন ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ গাঠনিক ক্ষমতায় (constituent power) রূপান্তরিত হতে থাকে যার আইনি-রাজনৈতিক তাৎপর্য বিপুল। এই গাঠনিক ক্ষমতার বলেই জনগণ নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (constitution) প্রণয়ন করে। ঘটনাটা ঘটে গঠনতন্ত্র সভায় (Constituent Assembly).

তাহলে ইন্টেরিম পর্যায়ের আইনি (legal) ভিত্তি কী? অন্তর্র্বর্তী পর্যায়ে দৈনন্দিন কাজ বিদ্যমান আইনি বিধান মোতাবেকই চলতে পারে। তবে বিদ্যমান আইনের যেসব ধারা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলো আপনাআপনি বাতিল হয়ে যাবে।

গঠনতন্ত্র প্রণয়নের আগ পর্যন্ত অন্তর্র্বর্তী পর্যায়ে কাজ চালানোর জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি প্রণয়ন করা যেতে পারে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের আগে এমন বিধান প্রণয়নের নজির রয়েছে। অথবা সাম্প্রতিক চিলির মতো অন্তর্র্বর্তী পর্যায়ে সামাজিক শান্তি সম্মতিপত্র (Agreement for Social Peace) বানানো যায়। আমাদের বাস্তবতায় আমরা এটিকে অন্তর্র্বর্তী আইনি ফ্রেমওয়ার্ক (interim legal framework) বলতে পারি।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার গণক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে। আর গণক্ষমতাই নতুন আইনি ও গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর বৈধতার ভিত্তি। এটুকুই যথেষ্ট।

তবু আইনি বৈধতার বিতর্কের মীমাংসার জন্য অস্থায়ী বিধানাবলি কিংবা অন্তর্র্বর্তী আইনি ফ্রেমওয়ার্ক কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা সহজ হতে পারে।

গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে বড় কোনো সংবিধান নেই। কাজেই গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধান দেখিয়ে লাভ নেই। ‘সংবিধান’ কী? জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের লিখিত দলিল।
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তার সামনে লিখিত সংবিধান নস্যি। কাজেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে কেবলমাত্র প্রতিবিপ্লবী শক্তি।

অভ্যুত্থানকারী শিক্ষার্থী-জনতা অভ্যুত্থানের আগেই বলেছে, হয় শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন না হলে তাকে পতনের মুখোমুখি হতে হবে। হাসিনাপুত্র জয় দিল্লির এস্টাবলিশমেন্টের মদদে এই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সে বলেছিল, সংবিধান অনুযায়ী তার মা নাকি এখনো প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ঘটেছে। এর মানে হচ্ছে সংবিধান অপ্রাসঙ্গিক ও অকার্যকর। বাংলাদেশে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হবে।

নতুন সরকারের বৈধতার ভিত্তি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত গণঅভিপ্রায় ও ইচ্ছা; সংবিধান নয়। শপথ গ্রহণের পরের বক্তৃতায় বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার সৃষ্ট’। মানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা দিয়ে এই সরকারকে বোঝা যাবে না, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত গণরায় আমলে নিতে হবে। কাজেই ‘as far as the constitution goes...’ বলে কোনো লাভ নেই। কারণ শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে এই সংবিধানেরও পতন ঘটেছে।

তবু যারা আইন, সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে ফ্যাটিশে ভোগেন; ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র দোহাই দেয়ামাত্র কুপোকাত হয়ে যান, তাদের জন্য বলছি- বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তথাকথিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে আসছে। কেন? কারণ ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদীয় ব্রæট মেজরিটির বলে আদালতকে দিয়ে সংবিধানের তত্ততত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তখন বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরো দু’টি সংসদ নির্বাচন হতে পারে। সাতজন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে চারজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মানেননি।

কাজেই গায়ের জোরে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠিয়ে দিয়ে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ‘অসাংবিধানিক’ কাজ করেছিলেন। অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা আওয়ামী লীগ সরকার তখন থেকেই অবৈধ ও অসাংবিধানিক।

আজকে যারা আমাদেরকে সংবিধান শেখাচ্ছেন, তারা স্মরণ করুন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে তারা কিভাবে বলপূর্বক দেশছাড়া করেছিল। তার ‘অপরাধ’ কী ছিল? তিনি শেখ হাসিনার নির্বাহী হুকুমের বাইরে গিয়ে একটি রায় দিয়েছিলেন মাত্র (ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করার রায়)। সংবিধান জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের লিখিত দলিল। কার্যকর ও অবিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ জনগণের ইচ্ছা এবং অভিপ্রায়ের প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র। ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি কি খোদ ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বদলে দিতে পারে? না, পারে না। কিন্তু এতদিন তাই করা হয়েছে।

অর্থাৎ- সংসদের আসনভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার-যা আবার ভোট পার্সেন্টেজে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় বলে সংবিধান সংশোধন করা একটি অসাংবিধানিক ও গণবিরোধী কাজ। সেই হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাতিল করাটা ছিল অসাংবিধানিক।

বিএনপি মহাসচিব বললেন, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের বক্তব্যে নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ নেই। তার কিছুদিন আগে বললেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের লোক। তো প্রশ্ন হলো- ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদি আপনাদেরই লোক হন, তাহলে তার ওপর আস্থা রাখতে এবং ধৈর্য ধারণ করতে আপনাদের সমস্যা কোথায়? আসলে বিএনপির সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আদতে বিএনপির সমস্যাটা হলো- তারা ভাবছে, নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে ততই জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বাড়বে। আর বিএনপির ভোটের যে তরঙ্গ আছে সেটি থাকবে না। কারণ বিএনপি বড় দল হিসেবে নেতাকর্মীদের কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ফলে তাদের সুনামহানি হবে এবং তা ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে।

বস্তুত প্রফেসর ইউনূস তার কথায় স্পষ্ট করেছেন, তিনি ছাত্রদের ডাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং ছাত্ররা যদি বলে অথবা দেশের আপামর জনতা যদি বলে তখনই তিনি দায়িত্ব ছাড়বেন। কারো কথায় সরকারপ্রধানের তেমন কিছু আসে-যায় না।

পাঠক একটি বিষয় খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন। প্রফেসর ইউনূসকে ২০০৭ সালে সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, এমনকি সেনাবাহিনী তার বাসায় সারারাত ছিল তাকে কনভিন্স করার জন্য, কিন্তু রাজি হননি, এরপর সেনাবাহিনী বলল আবার পরের দিন আসবে। তিনি তখনো বলেছিলেন, আপনারা আবার এলে একই উত্তর পাবেন। অথচ তিনি ২০২৪ সালে ছাত্রদের কথায় দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন।

এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে আমাদের ধারণা। যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন, একটি বিপ্লব তথা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার এসেছে এ সরকারের প্রতি বলতে গেলে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। মানুষের মন-মানসিকতাও পরিবর্তন হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- যে শহীদ ও আহতদের রক্তেদানের বিনিময়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে, তাদের অনেক আশা-আকাক্সক্ষা আছে এই সরকারের কাছে। এ সরকার অল্প সময়ের মধ্যে এসব আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে না। এ জন্য সময় লাগবে। সুতরাং এ সরকার কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য সময় পেতেই পারে। যখন তারা মনে করবেন, দেশে নির্বাচন দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন।

দুই-এক বছর পর নির্বাচন হলে বিএনপিই এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে, এমন নাও হতে পারে। কারণ বিগত বছরগুলোতে মানুষ বিএনপির শাসন দেখেছে। দলটি সম্পর্কে মানুষ সম্যক অবগত। তরুণ প্রজন্মের সাথে তাদের সম্পর্ক শিথিল। জামায়াতে ইসলামীর সাথে দেশের ইসলামিক দলগুলোর যে জোট হতে যাচ্ছে, সেটি নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলেও সমীকরণটা নতুন করে করতে হবে।

এখানে আওয়ামী লীগ বড় ফ্যাক্টর। গণহত্যার বিচার হলে আওয়ামী লীগ হয়তো সামনে নির্বাচন করতে পারবে না। অথবা নির্বাচন করার মতো প্রার্থীই থাকবে না। আওয়ামী লীগের ভোট বিভক্ত হয়ে যাবে। বেশ কিছুটা জামায়াতের বাক্সে পড়তে পারে। কারণ আওয়ামী ভোটাররা বিকল্প হিসেবে তাদের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপিকে বেছে নেবে না।

আগামী নির্বাচনের আগে নতুন গঠনতন্ত্র রচনা করা হবে। তাতে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকতে পারে। তেমনটি হলে বিএনপি একচেটিয়া কিছু করতে পারবে না। কোনো দল নির্বাচনে সরকার গঠন করতে না পারলেও সংসদে খুব জোরালোভাবে ভ‚মিকা রাখতে পারবে।

লেখক : প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
ইমেল : sahidsams7@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement