২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি

- প্রতীকী ছবি

ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকার রাষ্ট্রসংস্কার এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে কাজ করছে।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এ শাসন ছিল মূলত চরম দুঃশাসন, যাকে অনেকে স্বৈরশাসন কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন বলছেন। এই ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল নিরঙ্কুশ। ক্যা¤পাস বলতে ছাত্রলীগই সব। গায়ের জোরে তারা ক্যাম্পাস থেকে ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠনকে বিতাড়িত করেছে। তারা আবাসিক হল নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা হলের সিট বণ্টন করেছে। ছাত্রলীগ নেতারা হলে বিলাসী জীবনযাপন করেছে। ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী চাঁদাবাজি করত, ফ্রি খেত এবং ছাত্রজীবন শেষ হওয়া সত্তে¡ও হলে অবস্থান করত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতাদের কথা ছিল আইন এবং তা মানতে সবাই বাধ্য হতো। হলগুলোতে টর্চার সেল ছিল, যেখানে ভিন্নমতের ছাত্রদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা ছিল না। তাদের রাজনীতি এবং উপস্থিতি ছিল এক প্রকার নিষিদ্ধ।

ক্যা¤পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে সহাবস্থান বলতে কিছু ছিল না। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি এবং নেতৃত্বের কোন্দলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরাও মারামারি করেছে। অস্ত্র ছিল অনেক ছাত্রনেতার নিত্যসঙ্গী। তারা অস্ত্র চালানোয় বেশ পারদর্শী ছিল।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মকর্তা নিয়োগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সবসময় নিয়োগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মেধা এবং একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বড় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর, ট্রেজারার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, হল প্রভোস্ট সব ছিল সরকারদলীয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার কোনো পরিবেশ ছিল না। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সবসময় একটি ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছিল। এ সময়ে ছাত্রলীগের হাতে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী হতাহত হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়েছে।

কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর পর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। দেশের সব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আবাসিক হল থেকে ছাত্রলীগ নেতারা পালিয়ে যায়। ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যা¤পাস এবং হল ছাত্রলীগের দখলমুক্ত হয়। শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক ভয় ও আতঙ্ক দূর হয়। লেখাপড়ার মুক্ত পরিবেশ ফিরে আসে। এখন হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বসবাসের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। নির্বিঘেœ পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় অনুগত ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর পদত্যাগ করেন। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম স¤পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে সরকার প্রায় সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি নিয়োগ দিয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। দেশবাসী আশা করছেন, এখন দেশের সব শিক্ষাঙ্গনে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার বিষয়টি আবারো বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আমাদের চাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির নামে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দলীয় রাজনীতিমুক্ত এবং শিক্ষানির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাই। এ দেশের মতো শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল পড়াশোনা আর গবেষণা চলে। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সেখানে কেবল ছাত্ররাজনীতি বিদ্যমান।

ছাত্রজীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কর্মজীবন গড়ার ভিত্তি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান কাজ পড়াশোনা করা। এর মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে তোলা। যত বেশি পড়বেন, তত বেশি জানবেন এবং তত বেশি যোগ্য হবেন। সুতরাং ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান কাজ হচ্ছে বেশি বেশি পড়াশোনা করা। কিন্তু আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। রাজনৈতিক দলের দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা ছাত্ররাজনীতি করে। ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে অনেক ছাত্র পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যায়। ফলে তারা রেজাল্ট খারাপ করে এমনকি ফেলও করে। অনেকে চার বছরের অনার্স কোর্স আট বছরেও শেষ করতে পারে না।

ছাত্র নেতাদের অনেকে রাজনীতির মওকা নিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য করে অর্থবিত্তের মালিক বনে যায়। ছাত্ররাজনীতি অনেকের কাছে প্রতিষ্ঠিত ও ধনী হওয়ার হাতিয়ার। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির কারণে অনেক সময় ক্যাম্পাসে প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, মারামারি হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়। এতে সেশনজটের সৃষ্টি হয়। যার কারণে সবার শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হয়। সেশনজটে পড়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে অতিরিক্ত যে সময়টুকু ব্যয় হয় তা কিন্তু একজন ছাত্রের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল এবং চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য এবং বিয়ে সংসার সব কিছু তার দেরিতে শুরু হলো।

যথাসময়ে ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারলে ছাত্রটি তার পরিবারকেও সাহায্য করতে পারে। সেশনজট না থাকলে শিক্ষাজীবন যথাসময়ে শেষ হবে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে হবে না।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জ্ঞান বিজ্ঞানে যে জাতি যত বেশি উন্নত, সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। পৃথিবীতে তারা তত বেশি নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ধারা চির বহমান। শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকলে কখনো কেউ এগিয়ে থাকতে পারে না।

জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত এবং সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে কিছু দেশ বিশ্বের নেতৃত্বের আসন দখল করতে পেরেছে। অন্যরা পারেনি। পারিনি আমরাও। সুতরাং জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞান অর্জনে পড়ালেখার কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য প্রয়োজন দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতিমুক্ত এবং শিক্ষা ও গবেষণানির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমাদের সবাইকে আজ একটি জ্ঞাননির্ভর প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে।

ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। বেশি বেশি পড়াশোনা এবং গবেষণা করতে হবে। হাতে অস্ত্র আর লগি-বৈঠা নয়, বই কলম খাতা তুলে নিতে হবে। পড়াশোনা করা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করা হবে তাদের প্রধান কাজ। নিজেকে যোগ্য করে তোলার বাইরে তাদের কোনো লক্ষ থাকতে পারে না। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুললে দেখা যাবে বিশ্ব তাদের খুঁজবে। বিশ্বজুড়ে হাজারো চাকরি তাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীরা যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠলে দেশের উন্নতি হবে। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে না পারলে শুধু চাকরির বাজারে নয়, বস্তুত কোথাও তারা মূল্য পাবে না। সুতরাং ছাত্রজীবনের মূল্যবান সময় অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করা উচিত হবে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা সমাধানে এসব সমস্যাকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু থাকবে।

শিক্ষার মান বাড়ানো, নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা নেয়া, আবাসিক সমস্যার সমাধান ইত্যাদি দাবি আদায়ে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং কাজ করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দলীয় ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে এবং ছাত্র সংসদ চালু থাকবে। ছাত্র সংসদের উদ্যোগে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, গানের আসর, কবিতা আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং পিকনিক এক্সকারশন হবে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার বিকাশ হবে, তারা সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

আমরা চাই, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। আবরার ফাহাদের মতো কোনো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাবে, তা চাই না। অনেকে হয়তো বলবেন, ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের পথ ধরে কিন্তু স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বলতে চাই, এ আন্দোলন কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের নেত্বত্বে গড়ে উঠেছে। এ ছাত্রদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। অধিকার আদায়ে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং আসুন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি পরিহার করি। শিক্ষা ও গবেষণানির্ভর ক্যাম্পাস গড়ে তুলি। এর মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করি। দেশকে উন্নত করি।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
E-mail: omar_ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement